চিরতরে তলিয়ে যাচ্ছে জোশীমঠ! বন্ধ হোটেল, কেন বাড়ি ঘর ছেড়ে পালাচ্ছেন মানুষ?
Joshimath Sinking: সোমবার মধ্যরাতে মাটির নিচ থেকে শব্দই শুধু শোনা যায়নি, মাড়োয়ারির জেপি আবাসিক কলোনির আশেপাশের একটি এলাকায় একটি ভৌমজলাধারও ফেটে গিয়েছে।
নববর্ষে দ্বিতীয় দিন। শীতে ঢাকা প্রাচীন শহরে গভীর রাত নেমেছে। হঠাৎ মাটির তলা থেকে চড়চড় আওয়াজ! মধ্যরাতে জেগে উঠেছে ঘুমন্ত সকলেই। ভূমিকম্প তো নয়, কাঁপছে না, দুলছেও না। কেবল চড়চড় আওয়াজ। ভয়ে বেরিয়ে এসেছেন বাসিন্দারা। আতঙ্কে বাড়িছাড়াও হয়েছেন অনেকে, এখনও হচ্ছেন। উত্তরাখণ্ডের প্রাচীন শহর জোশীমঠ এখন বিভীষিকার ডাকনাম! ধর্মীয় সংস্কারক আদি শঙ্করাচার্য অষ্টম শতাব্দীতে এখানেই জ্ঞানলাভ করেছিলেন বলে জানা যায়, এইখানেই আছে এশিয়ার দীর্ঘতম রোপওয়ে। তবে তা পর্যটকদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, জোশীমঠের দু'টি হোটেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন মানুষ, প্রায় ৬৬ টি পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। জোশীমঠের এই ঘটনা পার্বত্য অঞ্চলে এই নিয়ে দ্বিতীয় বড় ধাক্কা। ইতিমধ্যেই উচ্ছেদের নোটিশ নিয়ে উত্তপ্ত হয়েছে হালদোয়ানি। জোশীমঠের বাসিন্দারা বৃহস্পতিবার বদ্রীনাথ জাতীয় সড়ক অবরোধ করেছেন। ‘জোশীমঠ শিলা’ থেকে জল বেরিয়ে আসার ঘটনায় বেড়েছে আতঙ্ক, বাড়ির দেওয়ালে, রাস্তায়, জমিতে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ ফাটল! আসলে কী হচ্ছে জোশীমঠে?
সোমবার মধ্যরাতে মাটির নিচ থেকে শব্দই শুধু শোনা যায়নি, মাড়োয়ারির জেপি আবাসিক কলোনির আশেপাশের একটি এলাকায় একটি ভৌমজলাধারও ফেটে গিয়েছে। আতঙ্কিত স্থানীয়রা, নিজেদের বাঁচাতে, নিজেদের এই ডুবতে থাকা শহরকে বাঁচাতে সমস্ত নির্মাণ বন্ধ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছেন। অদ্ভুত একটি সত্য সম্ভবত উঠে আসছে সব ঝুলো ঝেড়ে, এতদিন পর। পার্বত্য এই শহরটি আসলে পুরনো ভূমিধসের উপর অবস্থিত, স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এখানে বসবাস করা। বাসিন্দাদের শান্ত করার চেষ্টায় উত্তরাখণ্ড সরকার বৃহস্পতিবার বিজ্ঞানীদের একটি দল গঠন করেছে জমি ধসে যাওয়া এবং বাড়িতে ফাটলের কারণ খুঁজে বের করার জন্য। এই দলটি ঘটনাস্থলে গিয়ে কারণ অনুসন্ধান করবে। পাশাপাশি, চামোলি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হেলাং বাইপাস নির্মাণ এবং তপোবন-বিষ্ণুগড় হাইড্রো প্রকল্পের কাজও অবিলম্বে স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই প্রকল্পগুলিই শহরের তলিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে উঠে আসছে।
আরও পড়ুন- পাহাড় ধ্বংস করে উন্নয়নের ছক ঠেলছে কোন বিপদের মুখে?
সংবাদ সংস্থা এএনআই এর তথ্যানুযায়ী, প্রায় ৫৬১টি বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। সিংধর এবং মারওয়াড়িতে ফাটল বাড়ছে। বন বিভাগের চেকপোস্টের কাছে সিংধর জৈন এলাকা এবং মারওয়াড়িতে জেপি কোম্পানি গেটের কাছে বদ্রীনাথ জাতীয় সড়কে ক্রমাগত ফাটল ধরছে, প্রতি ঘণ্টায় এই ফাটল বাড়ছে। ২০২৩ এই যে প্রথম এই ঘটনা ঘটেছে এমনটা মোটেও না।২০২১ সালে যখন চামোলিতে বেশ কয়েকটি ভূমিধস দেখা দেয় তখনই ঘরবাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছিল। বাসিন্দারা কাঠের খুঁটি ব্যবহার করে বাড়ি ঘরকে ঠেস দিয়ে রাখতে শুরু করেন। পরের বছরও, মানে ২০২২ সাল জুড়ে প্রায়ই ভূমিকম্প দেখা দেয়। গতবছরই উত্তরাখণ্ড সরকার বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেল তৈরি করে। এই বিশেষ দলটিই জানিয়েছিল, জোশীমঠের বেশ কয়েকটি অঞ্চল মনুষ্যসৃষ্ট এবং প্রাকৃতিক কারণে তলিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, ভূপৃষ্ঠের উপাদান, মানে জঙ্গল জমি ইত্যাদি সরিয়ে বা খনন করে বসতি স্থাপন হয়েছে, শহর, হোটেল ও অন্যান্য নানা কাঠামো গড়ে উঠেছে। পাথরে প্রাকৃতিক চ্যুতির কারণেও জোশিমঠের প্রায় সমস্ত ওয়ার্ডের ক্ষতি হয়েছে। সারা শহরটিই আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছে। গত বছর জোশীমঠ পৌরসভা একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে, এক বছরে শহরের ৫০০ টিরও বেশি বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। জোশীমঠের গান্ধীনগর, রবিগ্রাম এবং সুনীল এলাকায় ৪০ টিরও বেশি পরিবার বাড়ির ভাঙন আটকাতে কাঠের খুঁটি দিয়ে কোনও মতে বাড়ি ধরে রেখেছে।
উল্লেখ্য, চামোলি জেলার জোশীমঠ শুধুমাত্র ইন্দো-তিব্বত সীমান্তের নিকটবর্তী হওয়ার কারণেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি বদ্রীনাথ, ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স এবং হেমকুণ্ড রুটের শেষ প্রধান শহর হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে এত দুর্বল জায়গায় বারেবারে নানা সতর্কতা সত্ত্বেও টনক নড়েনি প্রশাসনের। অতিরিক্ত নির্মাণ, টানেল কাটা, শহরের বৃদ্ধির কারণে এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি বড়সড় ভূমিধস হয়েছে। CSIR-এর প্রধান বিজ্ঞানী ডিপি কানুনগো জানিয়েছেন, ২০০৯ থেকে ২০১২ অবধি চামোলি-জোশীমঠ অঞ্চলে ১২৮ টি ভূমিধস ঘটেছে!
আরও পড়ুন- পুড়ে খাক জঙ্গল, মরছে বন্যপ্রাণী! কী কারণে ছারখার হিমাচল প্রদেশের প্রকৃতি?
টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালের মিশ্র কমিটি একটি রিপোর্ট পেশ করে। প্রায় ৫০ বছর আগেই ওই রিপোর্টে সতর্ক করা হয়েছিল যে, এমন তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটবে অচিরেই। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, রাস্তা মেরামত এবং অন্যান্য নির্মাণের জন্য, পাহাড়ের পাশে খনন বা ডায়নামাইট বিস্ফোরণ করে পাথর সরানো যাবে না। এই পাহাড়ের গাছগুলিকে শিশুদের মতো লালন-পালন করতে হবে। এসব সুপারিশযে ফাইলবন্দি হয়েই পড়েছিল, তা বলাই বাহুল্য।
জোশীমঠের পুরনো বাসিন্দারা অবশ্য মনে রেখেছে, ১৯৭৬ সালের এই সতর্কতাকে তখন অনেকেই পাত্তা দেননি। বিশেষজ্ঞরা যখন জানিয়েছিলেন শহরটার আয়ু বেশিদিনের নয়, রেগেই গিয়েছিলেন স্থায়ী বাসিন্দারা। আজ তাঁরাও বুঝছেন, ফাঁকা শব্দ ছিল না সেসব। সেই সময়েই বলা হয়েছিল, "জোশীমঠ একটি 'প্রাচীন ভূমিধসের' উপর অবস্থিত।" এখানে কোনও ভারী নির্মাণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল.
১৯৭৬ এর পর, ২০২২ সালেও ফের সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। ২০২১ সালের হড়পা বানে ২০০ জন মারা গিয়েছিলেন রাইনিতে, জোশীমঠ থেকে এক ঘণ্টার পথ। বিজ্ঞানীরা তখনও বলেছিলেন, বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের জন্য খনন অবিলম্বে বন্ধ না করা হলে সবটাই শেষ হয়ে যাবে তলিয়ে গিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তপোবন-বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, চারধাম রাস্তা এবং দ্রুত নগরায়ণের ভুক্তভোগী হচ্ছে ভৌগোলিক এবং পরিবেশগতভাবে দুর্বল এই অঞ্চলটি। গাছ বাঁচিয়ে নির্মাণ, যথেচ্ছভাবে হোটেল বা অন্যান্য শহুরে উন্নয়নের হার কমানোর সতর্কতা এর আগে কখনই কাজে আসেনি, সচেতনতার পাঠকে ভুলে ক্ষতির মুখে পড়েছে মানুষই। তবু... প্রকৃতি চিৎকার করে না, মিছিলও না। মাঝে মাঝে শুধু রেগে ওঠে- সেটুকুই মানুষের পক্ষে যথেষ্ট!