যুক্তির ধারকাছ এড়িয়ে, ব্যোমকেশ-ফেলুদাদের ধাক্কা মেরে খাদে ফেলেন দেবালয়ের গোয়েন্দা দীপক

Shri Swapankumarer Badami Hyenar Kobole : পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় (পড়ুন শ্রী স্বপন কুমার) তারার মতো মিটিমিটি হাসেন। কলকাতার বুকে আবিরকে ফিরতে হয় গোয়েন্দা দীপক চট্টোপাধ্যায় হয়ে।

দু'হাতে বন্দুক আর এক হাতে টর্চ! অজানা শত্রুর হাত থেকে শহরকে রক্ষা করতে হাজির গোয়েন্দা দীপক চট্টোপাধ্যায়! সঙ্গে রতনলাল। প্রথম লাইন পড়েই খটকা লাগল?  এতদিনে গোয়েন্দা-থ্রিলারের সুবাদে বাঙালির মগজাস্ত্রের ধার ঢের বেড়েছে। খটকা হয়তো এই গল্পের নায়ক দীপক চট্টোপাধ্যায়েরও লেগেছিল। তাই হয়তো নিজের স্রষ্টার সঙ্গে বোঝাপড়ার তাগিদেই ফিরে আসা। ম্যাজিশিয়ান সমরেন্দ্রনাথ পাণ্ডে দূর আকাশে মিটমিট করে হাসতে থাকা তারার মতো চেয়ে মনে করিয়ে দেন লজিকের চেয়ে ম্যাজিকের প্রয়োজনীয়তাকে।

আমাদের প্রজন্ম হয়তো স্বপন কুমারের পরিচিত নন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ষাট থেকে আশির দশক এই শহরের বুকে তিনি রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিলেন। চটি বই হয়ে নিজেকে মেলেছিলেন পড়ার বইয়ের ফাঁকে। আবালবৃদ্ধবনিতা স্বপন কুমারের সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিল রুদ্ধশ্বাস অভিযানে। যদিও বিদ্ব সমাজকে লুকিয়ে; পাছে যদি কালচারভ্রষ্ট হতে হয়! অথচ বাঙালি দিব্যি গিলেছে জেমস বন্ডের অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চকর অভিযানকে। যদি তাঁকেও বাঙালি বইয়ের তাকে সসম্মানে রবীন্দ্র রচনাবলীর পাশে একটু জায়গা দিত তাহলে হয়তো ‘দু'হাতে বন্দুক আর এক হাতে টর্চ’-এর মত ভ্রান্তি তিনি এড়াতে পারতেন। রাত জেগে স্টেশনের হলদে আলোয় গল্প শেষ করার তাড়া থাকত না। খুব জানতে ইচ্ছে হয়, শ্রীভৃগু কি কখনও স্বপন কুমারের হাত দেখেছিলেন? সমরেন্দ্রনাথ পাণ্ডে তারার মতো মিটিমিটি হাসে!

আরও পড়ুন- সেক্স জার্নাল, জ্যোতিষ থেকে গোয়েন্দা গল্প! বর্ণময় জীবন ছিল স্বপনকুমারের

স্রষ্টা ও সৃষ্টি একে অপরের পরিপূরক। কেমন হয় সৃষ্টি যদি তার স্রষ্টার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়তে শুরু করে? বিশেষ করে সৃষ্টি যদি হয় এক গোয়েন্দা চরিত্র। সেই চরিত্র যদি স্রষ্টাকে ক্রমাগত দাবি জানায় তাকে বাঙালির মননে গেঁথে ফেলার উপযোগী আদর্শ গুণাগুণ সম্পন্ন চরিত্র করে তুলতে? যে চরিত্র মগজাস্ত্রে বিপক্ষকে ঘোল খাওয়াবে, যার শিরায় শিরায় ফল্গুধারার মতো বইবে কালচার! স্রষ্টার কীর্তিকলাপে সে আজ বিরক্ত। কিন্তু শ্রী স্বপন কুমার চেনেন বাঙালির দ্বিচারিতাকে। কল্পনার ঘুড়িকে মধ্যগগন থেকে গোঁত্তা মেরে পৌঁছে দেন ঘরে ঘরে। পকেটে-বইয়ের ফাঁকে-চিলছাদে জন্ম নেন বাঙালির প্রথম পাল্প ফিকশন লেখক- স্বপন কুমার! আমৃত্যু যে পরিবর্তে পাবে শুধুই অবজ্ঞা এবং অবহেলা। জাতে উঠতে না পারা খাজা লেখকের খেতাব! অথচ আমেরিকায় এর বেশ কিছু বছরেই আবির্ভাব হবে কোয়েন্টিন ট্যারেন্টিনোর- পাল্প জঁর নিয়েই যার বাস। আমাদের দেশে এই মুহূর্তে শ্রীরাম রাঘবন দুর্দান্ত সব পাল্প ছবি বানিয়ে চলেছেন। একের পর এক ইন্টারভিউতে মৃদু হেসে সগর্বে নিজের পাল্প গল্পের বই, সিনেমাপ্রীতির কথা স্বীকার করছেন। আমরা সেই ধুতি-পাঞ্জাবী পরিহিত নারীবর্জিত গোয়েন্দায় আচ্ছন্ন। গন্ধরাজ মোমোর প্লেট হাতে জাবর কেটে চলেছি। সময়ের কাছে কি আমাদের কোনও দাবি নেই? যদি থাকে, তবে অবশ্যই বাংলা ছবির সামনে এসে বসতে হবে; পাশে দাঁড়ানোর দরকার নেই।

আরও পড়ুন- পাতায় পাতায় রোমাঞ্চ, রক্ত গরম গোয়েন্দাগিরি! কেন স্বপনকুমারকে ভুলে গেল বাঙালি?

পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় (পড়ুন শ্রী স্বপন কুমার) তারার মতো মিটিমিটি হাসেন। কলকাতার বুকে আবিরকে ফিরতে হয় গোয়েন্দা দীপক চট্টোপাধ্যায় হয়ে। হ্যাট-লংকোট-লেদার বুট পরিহিত আবির ব্যাটম্যানের মতো নেমে আসে ক্ষয়ে যাওয়া এই শহরে, ইতিমধ্যেই বাংলার সব রকম গোয়েন্দা চরিত্র যার ঝুলিতে। এখানেই পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য করেছেন কিস্তিমাত। তিনি সন্তর্পণে লজিকের ধারকাছ এড়িয়ে বাঙালির গোয়েন্দা আইডলদের ধাক্কা মেরে ফেলেন খাদে। ব্যাকড্রপে বেজে ওঠে ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে, কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে’! একটা ফেলে আসা সময় এবং ঝিমিয়ে পড়া শহরকে চেষ্টা করেন ঝাঁকুনি মেরে জাগাতে। পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বর ম্যাজিক দেখায়। একজন বিস্মৃত লেখক কোন বিশ্বাসে এরকম রুদ্ধশ্বাস কাহিনি বুনতেন তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা চলে। তার চরিত্র হিট গল্পের মাল ম্যাটিরিয়াল- ইতিহাস, রবীন্দ্রসঙ্গীতের হদিস দেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালে দুর্ধর্ষ অ্যাকশনের সিকোয়েন্স কি কালচারাল বাঙালিকে একধরনের খোঁচা দেওয়া নয়? এই ছবির ভাষা ভাবায়।

ছবিটি হুতোমের ভাষায় ব্যঙ্গ করে সমসাময়িক সমাজকে। সিনেমার নন-লিনিয়ার ধাঁচ দর্শকের মনোযোগকে চ্যালাঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। এতদিন স্পুন ফিডিংয়ে অভ্যস্ত দর্শকের জন্য ব্যাপারটা খুব একটা স্বস্তিকর নয়। গান ও আবহসঙ্গীত ছবির ভাষাকে জীবন দিয়েছে। সুরকার অমিত চট্টোপাধ্যায়ের কাজ প্রশংসনীয়! ‘শ্রী স্বপন কুমারের বাদামি হায়নার কবলে’ ছবিটির ভাষা বেশ জটিল। পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য চেয়েছেন পাগলামি করতে এবং সেটা বেশ কৃতিত্ব সহকারেই করেছেন। শেষ কবে এখানে ছবিতে এরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখেছি মনে পড়ছে না। হিট সিনেমার সব মাল মশলা মজুত রেখেও বারবার নস্যাৎ করেছেন ফর্মুলাকে। জেলুসিল খাওয়া বাঙালির কাছে অরৈখিক, জাম্পকাট পরিপূর্ণ ন্যরেটিভ খুব একটা সহজপাচ্য হবে বলে মনে হয় না। ছবির অন্যতম সম্পদ, যথাযথ চরিত্রে অভিনেতা নির্বাচন। স্বপন কুমারের চরিত্রে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং গোয়েন্দা দীপক চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রে আবির ছাড়া কাউকে ভাবাই দুষ্কর। ‘তাশির’ চরিত্রে শ্রুতি দাস অনবদ্য। ক্লাইমেক্স দৃশ্য দর্শকদের মস্তিষ্কে ‘মাশরুম’ ফোটাবে বলেই আশ্বাস! বাংলায় দেবালয় ভট্টাচার্যের মত সাহসী পরিচালক খুব কমই আছেন। এই ছবি সেই কারণেই সিনেমা হলে গিয়ে দেখুন সবাই।

 

More Articles