পদ্মা সেতুতে শ্যামলীর জয়যাত্রা, যেভাবে জুড়ছে কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা

সৌজন্যে সেই পদ্মা সেতু, আরও কমছে বাংলাদেশ এবং কলকাতার দূরত্ব। শনিবার পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেছেন ওপার বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এই সেতুর সুবাদে মাত্র চার ঘণ্টাতেই ঢাকা থেকে পৌঁছনো যাবে কলকাতায়।

'পদ্মার ঢেউ রে/ মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা, যা রে...।'

পদ্মাকে ঘিরে বাংলা ও বাঙালির আবেগ চিরন্তন। আর নজরুলের কলম থেকে উৎসারিত এই আবেগও অনন্ত। আর এই ঐতিহাসিক পদ্মার বুক চিরে কংক্রিটের স্বপ্ন সাধন। ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে সোমবার সকালে এই পদ্মা সেতুর বুকের ওপর দিয়ে কলকাতা থেকে ঢাকা ছুটে যাবে বাস। শ্যামলীতে ভর করে এদিন এই বাস পরিবহণ পদ্মার বুকে লিখে দেবে এক আবেগের ইতিহাস। আবারও ভরসার নাম সেই শ্যামলীই।

‘সাবাশ বাংলাদেশ, এই পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়। জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ পদ্মা ব্রিজের উদ্বোধনে শেখ হাসিনার মুখে শোনা যায় কবি সুকান্তর কবিতা। বঙ্গবন্ধুর কথা উদ্ধৃত করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেউ আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। কণ্ঠে বিপ্লবী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা। মুখে যুদ্ধজয়ের তৃপ্তি! শনিবার ‘পদ্মা মাল্টিপারপাস ব্রিজ’-এর উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। আর সোমবার সকালে এই ব্রিজের বুকের ওপর দিয়ে কলকাতার সল্টলেকের করুণাময়ী থেকে রওনা দিয়ে ঢাকা যাবে বাস। আবেগের এই সফরের নামের পাশে লেখা থাকবে, শ্যামলী পরিবহণ।

আরও পড়ুন: স্কুটার বিক্রির টাকায় প্রথম বাস, স্বপ্ন দেখতে জানলে কতদূর যাওয়া যায়, দেখিয়েছে শ্যামলী পরিবহণ

গড়াবে বাসের চাকা
দু’বছর ধরে কলকাতা-ঢাকা বাস সার্ভিস বন্ধ ছিল। করোনা সংক্রমণের কারণে ২০২০ সালের ১২ মার্চ থেকে দু’দেশের মধ্যে বাস পরিষেবা বন্ধ হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটার কারণে আবার দু’দেশের মধ্যে চালু হয়েছে যাত্রীবাহী বাস। সোমবার সকালেও করুণাময়ী থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে এই বাস।

জানা যাচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে বাস পরিষেবা চালু করার বিষয়ে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। শ্যামলী যাত্রী পরিবহণ সংস্থার পক্ষ থেকে আগেই জানানো হয়, তাদের হাতে রয়েছে কলকাতা-ঢাকা-কলকাতার মধ্যে যাত্রীবাহী বাস চালু করার অনুমতি।

জানা যাচ্ছে, প্রতিদিন সকাল সাতটায় করুণাময়ী থেকে ঢাকাগামী বাস ছাড়ে। আবার এই সময়েই ঢাকা থেকে ছাড়ে কলকাতাগামী বাস। শ্যামলী পরিবহণের বাস কলকাতা থেকে সোমবার, বুধবার, শুক্রবার ছাড়ে। আর ঢাকা থেকে ছাড়ে মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনিবার। আবার, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনিবার কলকাতা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ সংস্থার বাসের। রবিবার বাস পরিষেবা বন্ধ থাকে। সেইমতো পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর আজই তার বুক চিরে কলকাতা থেকে বাস ছুটে যাবে ঢাকায়। এ যেন স্বপ্নের উড়ান! দুই বাংলার মিলন এত সহজে!

অন্যদিকে, জানা যাচ্ছে, দুই বছর বাস পরিষেবা বন্ধ রাখা হলেও বাস ভাড়া আগের মতোই রয়েছে। আবার সপ্তাহে তিনদিন কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা রুটেও বাস চলছে। কলকাতা থেকে দুপুর বারোটায় ছাড়ছে আগরতলাগামী বাস। আর আগরতলা থেকে বিকেল চারটের সময় কলকাতাগামী বাস। এই সফর ঘিরে বাঙালির আবেগ পাড়ি দিতে চলেছে খরস্রোতা পদ্মার বুকে।

১৯৯৯ সালের ১৯ জুন কলকাতা-ঢাকার মধ্যে প্রথম শুরু হয়েছিল যাত্রীবাহী বাস পরিষেবা। আর আগরতলা-কলকাতা রুটে বাস চলাচল শুরু হয় ২০১৫ সালে।

বাংলাদেশের হৃদয় থেকে উৎসারিত শ্যামলী
শ্যামলী পরিবহণ এক লড়াইয়ের নাম। এই সাফল্যের আখ্যান খুললে দেখা যায় এক স্কুটার চালকের স্বপ্নের উড়ান পাড়ি দিয়েছিল প্রথমে বাংলাদেশের পথে পথে। আজ তা আন্তর্জাতিক চেহারা নিয়েছে। শ্যামলী পরিবহণ আজ শুধু বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের নানা অঞ্চলে পৌঁছে যায় শ্যামলীর বাস।

সালটা ১৯৭২। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। অবিনাশচন্দ্র ঘোষ তাঁর বিরাট পরিবার নিয়ে থাকতেন পাবনা শহরে। ১৩ জন সদস্যের পরিবার, জীবন চালানোই ছিল এক সংগ্রাম। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র গণেশচন্দ্র ঘোষ তখন এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র। পরিবারের অর্থনৈতিক দায় এসে পড়ল তাঁর কাঁধে। কিছু টাকা জমিয়ে ১৯৭২ সালে তিনি একটি স্কুটার কিনে ফেললেন। তারপর পাবনা-সুজানগরের রাস্তায় বাণিজ্যিকভাবে তিন চাকার স্কুটার চালাতে শুরু করলেন। সেই ভাড়াতেই সংসার চলত তাঁদের।

প্রতিদিনের উপার্জিত অর্থ জমাতে শুরু করলেন। নতুন ব্যবসার স্বপ্ন দেখলেন তিনি। গণেশচন্দ্র পড়া ছাড়েননি। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বেরিয়ে পড়তেন স্কুটার নিয়ে। ধীরে ধীরে পয়সা জমিয়ে কয়েকটি নতুন স্কুটার কিনলেন। এভাবেই শুরু হল শ্যামলী পরিবহণের পথচলা। স্কুটারের সংখ্যা যতই বাড়ল, ততই সেটি একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হল। ২ বছর বাদে তিন চাকার স্কুটারগুলো বিক্রি করে সেকেন্ড হ্যান্ড বাস কিনে ফেললেন গণেশচন্দ্র। সেই বাসই জন্ম দেয় সাফল্যের। শ্যামলী সফর করছে ভারতেও। সোমবার পদ্মা সেতু দিয়ে শ্যামলীর বাসের চাকা গড়াবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। এদিনও পদ্মা সেতুর উন্মাদনার সঙ্গে জড়িয়ে দুই বাংলার সাঁকোটির নাম হয়ে উঠবে শ্যামলী।

পদ্মা সেতুর আবেগ
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের সিকি-শতাব্দীরও অধিক সময় কাটিয়েছেন বাংলাদেশের শিলাইদহে; কখনও পতিসর বা শাহজাদপুরে গেছেন জমিদারির প্রয়োজনে। বাংলাদেশে থাকার সময় তিনি তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সৃজন করেছিলেন। বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য তাঁর 'গীতাঞ্জলি', যার ইংরেজি অনুবাদের জন্য পেয়েছিলেন তিনি নোবেল পুরস্কার। কবিগুরুর ‘পদ্মা বোট’ আজ ইতিহাস। বাংলাদেশে অবস্থানকালে তিনি পদ্মা বোটে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন, বোটে বসে কবিতাও লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের বোট কুষ্ঠিয়া-রাজশাহির বিভিন্ন নদীতে ঘুরেছে, কখনও পদ্মা নদীকেও ছুঁয়েছে। পদ্মা-রাজশাহি অঞ্চলে ভারত-বাংলাদেশের সীমারেখাও টেনেছে। কিন্তু পদ্মা কোনও ছোট নদী নয়। পদ্মা বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদীর একটি, আর খরস্রোতা নদী হিসেবে পৃথিবীতে আমাজন নদীর পরেই পদ্মার অবস্থান। বাংলাদেশের উত্তর জনপদ রাজশাহি থেকে কুষ্ঠিয়া, পাবনা, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, ঢাকা, শরিয়তপুর এবং মুন্সিগঞ্জ জনপদকে ছুঁয়েছে পদ্মা, ধারণ করেছে নানা জনপদের সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য। তাই পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যে বাস ছুটবে, তখন চারপাশে পদ্মার নিরন্তর বয়ে চলার সাক্ষী থাকবেন যাত্রীরা।

সৌজন্যে সেই পদ্মা সেতু, আরও কমছে বাংলাদেশ এবং কলকাতার দূরত্ব। শনিবার পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেছেন ওপার বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এই সেতুর সুবাদে মাত্র চার ঘণ্টাতেই ঢাকা থেকে পৌঁছনো যাবে কলকাতায়। চিকিৎসার জন্য বহু মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসেন। একই সঙ্গে অনেকে বেড়াতেও যান প্রতিবেশী এই দেশে। সেক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সুগম হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। যোগাযোগ এত সহজ হওয়ার পর আমদানি ও রপ্তানি দুই বাড়বে। বেনাপোল হয়ে যে সমস্ত ট্রাক যাতায়াত করে, তা আগের থেকে অনেক কম সময়ে ঢাকা ও অন্য এলাকায় যেতে পারবে। আগে ঢাকা থেকে কলকাতায় আসতে সময় লাগত দশ ঘণ্টা। সেই সময় অনেক কমে যাওয়ায় সুবিধে হবে দুই বাংলার মানুষেরই।

পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৭২ ফুট। সেখানে চার লেনের সড়ক রয়েছে। সুরক্ষার জন্য মাঝে রয়েছে ডিভাইডার। পদ্মা নদীতে যাতে বড় লঞ্চ চলাচলে যাতে কোনও সমস্যা না হয়, সেজন্য তা নদী থেকে ৬০ ফুট উঁচুতে নির্মিত হয়েছে। সেখানে পিলার রয়েছে ৪২টি এবং পাইলিং সংখ্যা ২৮৬টি। এই সেতুর পরিকল্পনা তৈরি হয় ১৯৯৮ সালে। তার অনুমোদন হয় ২০০৭ সালে। এই সেতুটি নির্মাণে খরচ করা হয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। তবে রেললাইনের কাজ শেষ হলে এই খরচ বেড়ে দাঁড়াবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এই সেতু উদ্বোধনের আগে নিজের বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এই সেতু নির্মাণের সময় কোনও আর্থিক দুর্নীতি ঘটেনি।

পদ্মা বিহার যেমন রোমাঞ্চ, তেমনই সোমবার ইতিহাস তৈরি করবে পদ্মার বুক চিরে কংক্রিটের পাঁজরের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলা এই আবেগ।

More Articles