কৃত্রিম উপায়ে বানানো হচ্ছে 'হিজড়ে'! খোদ রাজধানীতে যে অন্ধকারে বাঁচছেন রূপান্তরকামীরা
Transgenders of India: তৃতীয় লিঙ্গর মানুষজনের প্রাপ্য অধিকারগুলি থেকে গিয়েছে শুধুমাত্র খাতাকলমেই।
ব্যতিক্রমী একটি ঘটনা দিয়েই শুরু করা যাক। অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে স্বামী কিংবা প্রেমিকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হলে সাধারণত মেয়েরা প্রতিবাদ করেন। কিন্তু উড়িষ্যার এই ঘটনাটি একেবারেই অন্য ধরনের। বিয়ের তিন বছর পেরিয়ে তৃতীয় লিঙ্গর একজন মানুষের প্রেমে পড়েন স্বামী। জানাজানি হয় সেই ঘটনা। এরপর অবাক করার মতো বিষয় এই যে, স্বামীর নতুন প্রেমকে স্বীকৃতি দিয়েছেন খোদ স্ত্রী-ই। শুধু তাই নয়, বিবাহবাসরে নিজে উপস্থিত থেকে স্বামীর বিয়েও দিয়েছেন।
ঘটনাটি ঘটেছে গত মাসে। এই কাণ্ড সংবাদমাধ্যমের নজর কাড়ার মতো। জানা গিয়েছে, তৃতীয় লিঙ্গের একজন সদস্যর সঙ্গে স্বামীর বিয়ে সম্পন্ন করিয়েই ক্ষান্ত হননি ওই মহিলা। স্বামীর বিয়ে দেওয়ার পর স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে একই ছাদের নিচে এখন বসবাস করছেন। পারিবারিক শান্তিও পুরোপুরি অক্ষুণ্ণ রয়েছে। ঝগড়াঝাঁটির কোনও পাট নেই।
যে মানুষটি প্রেমে পড়ে তৃতীয় লিঙ্গর প্রেমিকাকে বিয়ে করলেন, তিনি এক সন্তানের জনক। ওঁর ছেলের বয়স এখন দু'বছর। তৃতীয় লিঙ্গর মানুষটির সঙ্গে এক বছর ধরে প্রেম করার পরে তাঁকে বিয়ে করেছেন ওই যুবক। উড়িষ্যার সংবাদমাধ্যম বিষয়টি নিয়ে খবরাখবর প্রকাশ করলেও পাত্রপাত্রীর নাম-ঠিকানা উহ্য রাখা হয়েছে।
আরও পড়ুন: আইনি স্বীকৃতি মিলেছে, ‘ছক্কা’ ডাকা বন্ধ হবে কবে?
এই বিয়েকে বেআইনি বলে মনে করেন আইনজীবীরা। দেশের আইনানুসারে কোনও পুরুষ দ্বিতীয়বার বিয়ে করতেই পারেন। সেক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রী-কে বিবাহবিচ্ছেদ দিতে হবে। এক্ষেত্রে সেই আইন মানা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে স্থানীয় থানা। পুলিশ জানিয়েছে, কোনও অভিযোগও দায়ের হয়নি। অভিযোগ দায়ের হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। না হলে পুলিশের কিছু করার নেই। ওই যুবকের প্রথম স্ত্রী এও জানিয়েছেন, স্বামী দ্বিতীয়বার বিয়ে করার পরে ওঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে একই ছাদের নিচে থাকতে কোনও অসুবিধেই হচ্ছে না। নতুন বউয়ের সঙ্গে কয়েকদিনের মধ্যে মানিয়ে নিয়েছেন তিনি।
এই ঘটনার উল্টো ঘটনা ঘটেছে উত্তরপ্রদেশের হরদোই জেলায়। এখানে ২০ বছরের হরেন্দ্র জাটাভ ১৯ বছরের সুলোচনাকে বিয়ের পর জানতে পারেন সুলোচনা বৃহন্নলা। আর একথা জানার পর মানসিকভাবে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন হরেন্দ্র। বিষয়টি গ্রামের পঞ্চায়েত পর্যন্ত গড়ায়। পঞ্চায়েত সম্প্রতি সুলোচনার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে। সুলোচনাকে তাঁর বাপের বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
উত্তরপ্রদেশের সুলোচনা নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য। বাপের বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে কতদিন জীবনযাপন করতে পারবেন তিনি, সেও এক প্রশ্ন। কারণ বৃহন্নলাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার নেই স্বাধীন দেশেও।
দু'টি ঘটনা সম্পূর্ণ পৃথক। সংবাদমাধ্যমে সম্প্রতি এই দু'টি ঘটনাই সম্প্রচারিত হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে এ-পর্যন্ত বৃহন্নলা সম্প্রদায়ের মানুষ সমাজে অবহেলিত। বৃহন্নলা সম্প্রদায় আজও এক প্রান্তিক সম্প্রদায়। সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলো থেকেও বঞ্চিত। এই সমাজব্যবস্থা ওঁদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য মোটেও অনুকূল নয়। দারিদ্র্য ওঁদের নিত্যসঙ্গী। স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন, ভারতের সব রাজ্য মিলিয়ে এই মুহূর্তে বসবাস করছেন ২০ লক্ষ বৃহন্নলা। চলতি কথায় যাঁদের 'হিজড়ে' বলা হয়।
ওঁদের প্রতিদিনের জীবন কঠোর বাস্তবের। সেই বাস্তব ভাতকাপড়ের। এদিকে প্রহসনের মতো ব্যাপার এই যে, সন্তানের জন্মের পর নবজাতকের কল্যাণ-কামনায় হিন্দুমতে আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে হিজড়ে অপরিহার্য। হিন্দুদের বিয়েতেও ধর্মীয় আচার পালন করতে হিজড়েদের দরকার পড়ে। কথায় বলে, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। হিজড়েদের জীবনকাহিনির সারমর্মও এরকমই। সমাজ তার মর্মে জানে, তৃতীয় লিঙ্গর মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করাটা কখনও অপরাধ হতে পারে না।
হিজড়ে থেকে রূপান্তরিত হয়ে নারী হয়েছে শাম্মী। শাম্মীর কথায়, বয়ঃসন্ধিকালে যখন কেউ বুঝতে পারে, সে লিঙ্গ-পরিচয়ে পুরুষ হলেও আসলে মেয়েলি জীবনই পছন্দ করছে এবং হাবেভাবে নানান মেয়েলি স্বভাব ফুটে উঠছে, তখন হয় বেজায় মুশকিল। সিংহভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের অন্দরে তাকে হেনস্থারই শিকার হতে হয়।
শাম্মীর নিজের জীবনও এরকমই ছিল। এজন্য তাকে পরিবারে ব্যাপক হেনস্থা শিকার হতে হয়েছে। এমনকী, সে যেন কারও সঙ্গে মিশতে না পারে এজন্য বাডির বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর সবসময় খুঁটিনাটি ভুলচুক করলে পরিবারের সকলে ওকে দোষারোপ করত।
এরপর একদিন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে শাম্মী। তৃতীয় লিঙ্গের একজন মানুষের সঙ্গে আকস্মিক পরিচয়ের সুবাদে ঘর ছেড়ে হিজড়েদের ডেরায় আসে শাম্মী। এরপর জীবন বয়ে চলেছে। রূপান্তরিত হয়েছে শাম্মী।
ভারতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজনের প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট ওঁদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সংবিধান-স্বীকৃত সব ধরনের মৌলিক অধিকারই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজনের প্রাপ্য। তবে সেই অধিকার থেকে ওঁরা বছরের পর বছর ধরে বঞ্চিত হওয়ায় বঞ্চনাটা এখন যেন গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে!
ভারতীয় সংবিধানের কয়েকটি ধারায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকার সংবিধান-স্বীকৃত। সংবিধানের আর্টিকল ১৪, আর্টিকল ১৫ ছাড়াও আর্টিকল ১৬, ১৯ এবং ২১-এ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের যে অধিকারগুলি স্বীকৃত, তা যে কোনও ভারতীয় নাগরিকেরই মৌলিক অধিকার।
সুপ্রিম কোর্ট হিজড়েদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পাঁচ বছরের মাথায় কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস প্রোটেকশন অ্যাক্ট প্রণয়ন করেছে। এতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সব ধরনের সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষত, সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়-আশয়গুলিতে।
স্বেচ্ছাসেবীদের মতে, ভারতে যে ২০ লক্ষ হিজড়ে রয়েছেন, এঁদের মধ্যে মোটে এক শতাংশ হিজড়ে হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছেন। অধিকাংশকেই অপহরণ করে খোজা বানানো হয়েছে। 'অল ইন্ডিয়া হিজড়ে কল্যাণ সমিতি' হিজড়েদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। এই সংস্থার দেওয়া তথ্যানুসারে, কেবলমাত্র রাজধানী দিল্লিতেই অন্তত ৩০ হাজার হিজড়ের বসবাস। দিল্লিতে প্রতি বছর অন্তত এক হাজার যুবককে হিজড়ে বানানো হয় কৃত্রিম উপায় অবলম্বন করে। একই অভিযোগ ১৯৮৪ সাল থেকে হিজড়ে সম্প্রদায় নিয়ে কাজ করে আসা আরেকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা 'অল ইন্ডিয়া হিজড়ে কল্যাণ সভা'-রও।
এই দুর্ভাগা দেশের নাগরিকরা সাংবিধানিক অধিকারগুলি থেকে বছরের পর বছর ধরে বঞ্চিত। সেইমতো তৃতীয় লিঙ্গর মানুষজনের প্রাপ্য অধিকারগুলিও থেকে গিয়েছে শুধুমাত্র খাতাকলমেই। এই দুর্দিন কবে অস্তমিত হবে সেকথা বলা কঠিন।