লক্ষ কোটি টাকা ফিরল না আজও! নোটবন্দির ছ'বছর পর কী অবস্থা ঋণখেলাপিদের
Demonetisation: বর্তমানে ঋণখেলাপিদের অবস্থা কীরকম? কেউ কি আদৌ কিছু ফেরত দিয়েছেন না কি এখনও অধরাই রয়েছেন?
নোটবন্দি বা ডিমনিটাইজেশনের ছয় বছর পূর্ণ হলো। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেছিলেন, ডিমনিটাইজেশনের ফলে যেসব ব্যবসায়ী নিজেদের কাছে কালো টাকা জমিয়েছেন, তাঁরা বিপাকে পড়বেন। সেই সমস্যা থেকে বাঁচতে তারা নিশ্চয়ই গৃহীত ঋণ সেই কালো টাকা দিয়ে শোধ করার চেষ্টা করবেন। এতে কালো টাকাও সাদা হবে এবং দেশে এনপিএ-র পরিমাণ কমবে। কিন্তু এ-বছর মে মাস পর্যন্ত পাওয়া হিসেব অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ভারতে এমন প্রায় ১২,০০০ ডিফল্টার বা ঋণখেলাপি অ্যাকাউন্ট রয়েছে (প্রত্যেকটিতেই ঋণের পরিমাণ ৫০ লক্ষ টাকা বা তার বেশি)। ৭,১৯৮টি ঋণের কোনও অর্থই পরিশোধ করেনি। বাকিরা মোট ঋণের মাত্র ৩০ শতাংশ ফেরত দিয়েছে। জানা যাচ্ছে, ওই সমস্ত কোম্পানি এবং ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে মামলা করেই নিজের দায় সেরেছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি। অর্থ মন্ত্রকের রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, ২০২১-'২২ অর্থবর্ষে ১.৫৭ লক্ষ কোটি টাকার ঋণখেলাপি হয়েছে দেশে। ২০২০-'২১ অর্থবর্ষে ঋণখেলাপির পরিমাণ ছিল ২.০২ লক্ষ কোটি টাকা। ২০১৯-'২০ অর্থবর্ষে টাকার পরিমাণ ছিল ২.৩৪ লক্ষ কোটি টাকা। ২০১৮-'১৯ অর্থবর্ষে ঋণখেলাপির পরিমাণ ২.৩৬ লক্ষ কোটি এবং ২০১৭-'১৮ অর্থবর্ষে দেশে ঋণখেলাপি হয়েছে ১.৬১ লক্ষ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে টাকার মোট অঙ্ক হলো ৯.৯১ লক্ষ কোটি টাকা। হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বিজয় মালিয়া, নীরব মোদির মতো ব্যবসায়ীরা। তাঁদের নামে মামলা চলছে দেশের বিভিন্ন আদালতে। তবে বর্তমানে দেশ থেকে পালানো বিজয় মালিয়া, নীরব মোদি-সহ হাজার হাজার ঋণখেলাপিকে দেশে ফেরানোর নানা চেষ্টা করেছে ভারত সরকার। পলাতক ব্যবসায়ী মেহুল চোক্সিকে পাকড়াও করতে ডমিনিকা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন ভারতের গোয়েন্দা আধিকারিকরা। তবে কাউকেই এখনও পর্যন্ত দেশে ফেরানো সম্ভব হয়নি। বর্তমানে এই সমস্ত ঋণখেলাপিদের অবস্থা কীরকম? কেউ কি আদৌ কিছু ফেরত দিয়েছেন না কি এখনও অধরাই রয়েছেন?
মেহুল চোক্সি
সম্প্রতি দেশের শীর্ষ ৫ ঋণখেলাপির তালিকা বের করেছিল অর্থ মন্ত্রক। এই তালিকায় প্রথম স্থানে নাম রয়েছে গীতাঞ্জলী জেমসের প্রধান মেহুল চোক্সি। তার খেলাপির অঙ্ক ৭১১০ কোটি টাকা। চোক্সি এবং তাঁর ভাগ্নে নীরব মোদি পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক (পিএনবি) থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন। একদিকে মেহুল চোক্সির ভাগ্নে নীরব মোদি লন্ডনে পালিয়ে বসে আছেন, এদিকে মামা-ভাগ্নে জুটির ওপর প্রায় তিন হাজারের বেশি কেস দায়ের করা হয়েছে। দু'জনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, জালিয়াতি, প্রতারণা, দুর্নীতি এবং অর্থ পাচার অর্থাৎ হাওয়ালার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা থাকলেও দেশে না ফিরতে কোনও রকম আইনির পদক্ষেপ করা যাবে না মেহুল চোক্সি বা নীরব মোদির ওপর। এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখা যেতে পারে, গত বছর মে-জুন মাসে ডমিনিকা থেকে গ্রেফতার করে ভারতে নিয়ে আসার চেষ্টা করে গোয়েন্দারা। কিন্তু তারা বিফল হন। অপর পক্ষে মেহুল চোক্সির বিরুদ্ধে দায়ের হয় বেআইনিভাবে অনুপ্রবেশের মামলা। সেই মামলা থেকেও এ-বছর মে মাসে রেহাই পেয়ে গিয়েছেন তিনি। বর্তমানে তিনি ডমিনিকার জেলে রয়েছেন এবং ভারতীয় সরকারের তরফে চেষ্টা করা হচ্ছে তাকে ফিরিয়ে আনার।
আরও পড়ুন: হাহাকার, মৃত্যু, কান্না! ফিরে দেখা নোটবন্দির বিভীষিকাময় দিনগুলো
নীরব মোদি
হিরে ব্যবসায়ী নীরব মোদির বিপুল পরিমাণ টাকার ব্যাঙ্ক জালিয়াতি প্রকাশ্যে আসার পরই ২০১৮-য় স্ত্রী অ্যামির সঙ্গে ভারত ছাড়েন। ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ হলবোর্ন থেকে নীরব মোদিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর পরে একাধিকবার জামিনের আর্জি করলেও বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারেননি। অন্তত পাঁচবার তাঁর জামিনের আর্জি খারিজ করে দিয়েছে ব্রিটিশ আদালত। বর্তমানে তিনি লন্ডনের ওয়ান্ডসওয়ার্থ কারাগারে রয়েছেন। সেখান থেকেই ভারতের প্রত্যর্পণ ঠেকানোর আইনি লড়াই চালাচ্ছেন। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের থেকে তিনি এবং তাঁর মামা, দু'জনে মিলে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। সেই টাকা ফেরত না দিয়ে ঋণখেলাপি করে দু'জনেই পালিয়েছেন বিদেশ। নীরবের বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে ঋণের চুক্তিপত্র হাতিয়ে বিপুল অঙ্কের প্রতারণার অভিযোগ ছিল। এরকম তদন্ত করছে সিবিআই। অন্যদিকে, প্রতারণার মাধ্যমে আয় করা সম্পত্তির তদন্ত করছে ইডি। এছাড়া প্রমাণ লোপাট এবং সাক্ষীদের ভয় দেখানোর অভিযোগও আনা হয়েছে নীরব মোদির বিরুদ্ধে।
বিজয় মালিয়া
কিংফিশার এয়ারলাইন্সের সঙ্গে জড়িত থাকাকালীন প্রায় ৯,০০০ কোটিরও বেশি টাকার ব্যাঙ্ক ঋণখেলাপির মামলায় জড়িয়েছিলেন বিজয় মালিয়া। সেই ঋণখেলাপি মামলায় মালিয়াকে ৬,২০০ কোটির টাকারও বেশি ব্যাঙ্ক ঋণ শোধ করার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু সেই টাকা এখনও ফেরত দেননি মালিয়া। তবে তিনি তাঁর সন্তানদের ৩১৭ কোটি ৬৩ লক্ষ টাকা পাঠিয়েছিলেন। এছাড়াও বিজয় মালিয়ার বিরুদ্ধে আদালতে ভুল তথ্য পেশেরও অভিযোগ ছিল। সুপ্রিম কোর্টের তরফে বহুবার নির্দেশ আসা সত্ত্বেও বিজয় মালিয়ার তরফে কোনওরকম প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। এমনকী, আদালতের নির্দেশ অমান্য করার পরেও বিজয় মালিয়ার মধ্যে কোনও অনুশোচনা দেখা যায়নি। যদিও কয়েক বছর আগে বিজয় মালিয়া দাবি করেছিলেন তাকে সুযোগ দিলে তিনি সব ঋণ মিটিয়ে দেবেন। যদিও সেই লক্ষণ বর্তমানেও দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে আপনাদের জানিয়ে রাখি, এ-বছর ১০ জুলাই, ২০১৭ সালের একটি মামলার রায় ঘোষণা করে বিজয় মালিয়াকে চার মাসের কারাদণ্ড এবং ২০০০ টাকার শাস্তি শুনিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই তিন ঋণখেলাপি শিল্পপতির জেরে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির মোট ক্ষতি হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। গত বছর ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, ওই তিন ঋণখেলাপির যাবতীয় সম্পত্তি হস্তগত করে ইতিমধ্যেই ১৩ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। তবে সাম্প্রতিকতম রিপোর্টে জানা গিয়েছে, এখনও পর্যন্ত ইডি এই তিন ব্যবসায়ীর ১৮ হাজার ১৭০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে। যা মূল তছরুপের প্রায় ৮০ শতাংশ। বর্তমানে ব্রিটেনে রয়েছেন মালিয়া এবং নীরব। তাদের দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া কিছুটা এগিয়েছে বলে সরকারি সূত্রের দাবি। অন্যদিকে ডমিনিকার জেলে বন্দি রয়েছেন চোক্সি। তাকেও ভারতে ফেরানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন দেশের গোয়েন্দারা। তবে বিজয় মালিয়া, মেহুল চোক্সিদের শুধুমাত্র 'টিপ অফ দ্য আইসবার্গ' বলা চলে। এবিজি শিপইয়ার্ড, এরা ইনফ্রা ইঞ্জিনিয়ারিং, কনকাস্ট স্টিল অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেড প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলির খেলাপি ঋণের কতটা রিকভার করতে পারে ইডি, সেটাই এখন দেখার।