ছোটো ব্যবসা শক্তিশালী অর্থনীতির মেরুদন্ড

প্রতিটি উন্নত না উন্নয়নমুখী দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে খতিয়ে দেখতে গেলে সবার আগে চোখে পড়বে সেই দেশের নিজস্ব ব্যবসায়িক পট, সেই দেশের কৃষি ও অন্যান্য শিল্পের ভূমিকা এবং সেই অর্থনীতিতে সেই দেশের যুব সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ন দিক রয়েছে যার ভূমিকা অনস্বীকার্য, তা হল সেই দেশের রুরাল অর্থাৎ গ্রামীণ, সেমি আরবান অর্থাৎ মফস্বলের ভূমিকা। একটি দেশ কখনও একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাত ধরে সাফল্যের সিড়ি বেয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে না, এই বিষয়ে প্রায় সকলেই ওয়াকিবহাল হলেও একটা বিষয় সম্পর্কে হয়তো সবার ধারণা অস্বচ্ছ তা হল একটি দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদে ৯৫ শতাংশের ভাগীদার হয় ছোটো উদ্যোগ বা ছোট ব্যবসা। বাদবাকি পাঁচ শতাংশের ভাগীদার হন বড় উদ্যোগপতিরা। কিন্তু কীভাবে ছোটো ব্যবসা দেশের এতো বড় একটা অংশে নিজেদের দাবী রাখে তার কাহিনী কিন্তু আমাদের চোখের সামনেই বিদ্যমান।

ছোটো  ব্যবসা শক্তিশালী অর্থনীতির মেরুদন্ড

চিত্রঋণ : Google

ছোটো ব্যবসা সাধারণত একটি স্থানীয় অঞ্চলের বেড়ে ওঠে, এক্ষেত্রে এই ধরনের ব্যবসার গুরুত্ব আবেগগতভাবে বন্ধু এবং প্রতিবেশীদের সাথে গভীর। একটি গ্রামে বেড়ে ওঠা একটি শপিং মল ততটা সহজে একজন মানুষের স্বাদ, পছন্দ বুঝে নিতে পারে না, যতটা তার প্রতিবেশী স্থানীয় ব্যবসায়ী বোঝেন। শুধু গ্রামীণ এলাকা নয়, শহরগুলিতেও এখনও বেশ কিছু ক্ষেত্রে ছোট সংস্থাগুলির গুরুত্ব স্থানীয়ভাবে কেনাকাটার জন্য বেশি। একজন ক্রেতা একটি দোকানে বা একটি ছোটো স্টলে যেভাবে নিজের চাহিদা জাহির করতে পারেন, তা শপিং মলের চাকচিক্যের মধ্যে সম্ভব হয়ে ওঠে না। আগেই বলা হল, একটি দেশের অর্থনীতিতে সাধারণত বড় ব্যবসার ভূমিকা ৫ শতাংশ, আর সেখানে ছোটো ব্যবসা ৯৫ শতাংশ, ধরে নেওয়া যাক একজন কৃষক যদি তার জমিতে উদপাদিত ফসল স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে পারেন, এক্ষেত্রে কৃষককে নিজের ফসল বিক্রি করার জন্য দূরে কোথাও যেতে হয় না, তাতে কৃষককে পণ্য বহনের খরচ বইতে হয় না এবং তিনি সেই ফসল অপেক্ষাকৃত কম দামে বিক্রি করতে পারেন। অবশ্যই এই শর্ত সকল কিছুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে চা মূলত পাহাড়ি ঢালু জমিতে ফলে, তাই দার্জিলিং এ উৎপাদিত চা শুধু দার্জিলিং, বা শিলিগুড়িতে বিক্রি সম্ভব নয়। দার্জিলিং চা শুধু বাংলা বা ভারত নয়, সারা পৃথিবীতে রপ্তানি করা হয়। দেশের ৯৫ শতাংশ জায়গা নিয়ে থাকা ক্ষুদ্র উদ্যোগে স্বাভাবিক ভাবেই কর্মসংস্থান বেশি। একটি দেশের অর্থনীতি তখনই মজবুত হয় যখন সেই দেশের পার ক্যাপিটা ইনকাম অর্থাৎ মাথাপিছু আয় বাড়ে। আঞ্চলিক উদ্যোক্তা বা নিজের উদ্যোগে তৈরি একটি ব্যাবসা সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে। ভারতের ২০১৯ সালে করা শেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, বর্তমান জনসংখ্যা ১৩৬ কোটি। এই বিপুল জনসমুদ্রে স্বাভাবিক ভাবেই কর্মসংস্থানও বেশি প্রয়োজন, এই খিদে শুধু বড় উদ্যোক্তা দের হাত ধরে সম্পূর্ন হওয়ার কোনও সম্ভাবনা সুদূর ভবিষ্যতেও নেই। আরও একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় লক্ষ্য করার প্রয়োজনীয়, তা হল ভারতের গর শিক্ষিতের হার ৬৯.৩ শতাংশ। ফলে ছোট ব্যবসাগুলি এমন মানুষদের কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রদান করতে সাহায্য করে যারা বৃহত্তর কর্পোরেশন দ্বারা নিয়োগযোগ্য নন। ছোট ব্যবসাগুলি আঞ্চলিক চাহিদা

ছোটো  ব্যবসা শক্তিশালী অর্থনীতির মেরুদন্ড

চিত্রঋণ : Google

র ভিত্তিতে নিজেদের পণ্যের মডিফিকেশন বা পরিবর্তন করতে পারে, বড় ব্যবসার ক্ষেত্রে এই কাজ সাধারণত ব্যয়বহুল এবং কিছু ক্ষেত্রে সফল নাও হতে পারে। উদাহরণ টেনে বলা যেতে পারে, একটি শপিং মলে আপনার প্রয়োজনীয় একটি পণ্য না পাওয়া গেলে, আপনি বড়জোর একটা দরখাস্ত করতে পারেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই দরখাস্ত গুরুত্ব পাবে না কারণ আপনার একার জন্য একটি পণ্য সরবরাহ করা তাদের ব্যবসার পক্ষে লাভজনক হবে না। অপরদিকে , আপনার স্থানীয় বাজারে পরিচিত দোকানদার আপনার এক কথায় হপ্তা খানেকের মধ্যেই সেই পণ্য আপনার জন্য হাজির করে দিতে পারে আপনার সাথে পরিচয়ের সূত্রে। McDonald শুধু মাত্র ভারতের নিরামিষ প্রিয় মানুষের কথা মাথায় রেখে ম্যাক আলু টিক্কি নিয়ে ভারতের বাজারে নেমেছিল, যার জন্য বিজ্ঞাপনের খরচ হয়েছিল বিপুল। কিন্তু সাধারণ নিরামিষাশী মানুষ এই খাবারটি নিয়ে প্রথম দিকে খানিকটা আগ্রহী হলেও, পরবর্তীকালে এর চাহিদা তুলনামূলক ভাবে কমে যায়। একটি সমৃদ্ধ স্থানীয় ব্যবসা উচ্চ মাত্রার রাজস্ব উৎপন্ন করে, যার অর্থ ব্যবসাটি স্থানীয় সম্পত্তি কর সহ উচ্চতর কর প্রদান করবে।  এই টাকা তখন স্থানীয় পুলিশ এবং দমকল বিভাগের পাশাপাশি স্কুলের জন্য ব্যবহার করা হয়। একটি স্থানীয় উদ্যোগ তুলনামূলক ভাবে কম প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজের কাজ করে থাকে। এতে সুবিধে এই যে প্রযুক্তি কম ব্যবহারের অর্থ বেশি কারিগর নিয়োগ। সাথে সাথেই ছোটো ব্যবসায় মূলধনের পরিমাণ কম থাকে, এরা বিদেশি বা বহুদূর থেকে উপকরণ বয়ে নিয়ে আসতে পারে না, এতে স্থানীয় সরঞ্জামের ব্যবহার সেই দেশের নিজস্ব শিল্পী, মিস্ত্রি, কারিগরদের রোজগারের পথ খুলে দেয়। এটিও সরাসরি সেই দেশের আর্থিক উন্নয়নের সাথে যুক্ত। তবে একটি ছোট ব্যবসা সবসময় ছোট থাকে না। Nike, KFC জোম্যাটোর মতো বড় কোম্পানিগুলিও একসময় ছোট ব্যবসা হিসাবে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে শুধু জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও নিজেদের ডানা মেলে ধরে। একজন খ্যাতনামা বিজনেস টাইকুন একসময় তাদের গ্যারেজের বাইরে কম্পিউটার নিয়ে কাজ করতে আরম্ভ করেন এবং এবং পরবর্তী কালে সেই কোম্পানিটিকে আমরা অ্যাপেল নামে চিনেছি, মাইক্রোসফট এবং অ্যামাজনের মতো কোম্পানিগুলি প্রাথমিক ভাবে ছোট ব্যবসা হিসেবে শুরু করে এবং পরে তারা সমগ্র বিশ্বের ব্যবসায়িক ধ্যান ধারণা পাল্টে দিয়েছে।

পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক টেকনোলজির ব্যবহার এখন তুলনামূলক ভাবে সহজ, সময়ের সাথে সাথে ইন্টারনেট, ডিজিটাল মিডিয়ার ব্যবহার এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন জাতীয় প্রযুক্তির সাহায্যে বহু ছোট উদ্যোগ প্রতিদিন বড় আকৃতি ধারণ করছে। সাথে সাথেই মানুষ ছোটো ছোটো ব্যবসায় বিনিয়োগ করার সাহস দেখাতে পারছেন, নিজস্ব স্বাধীনতায়, অল্প বিনিয়োগে, ইন্টারনেটের সাহায্যে স্থানীয় অঞ্চলের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছেন। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ (আইজেএসইআর) অনুসারে, ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত, ক্ষুদ্র শিল্প থেকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ৮১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।  ২০২০ সালে, ১১ কোটিরও বেশি মানুষ ক্ষুদ্র, মাঝারি উদ্যোগের সাথে কাজ করছেন, যা ভারতের রোজগার করে খাওয়া মানুষের নিরিখের দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। প্রথম স্থানে অবশ্যই কৃষির সাথে সরাসরি যুক্ত মানুষেরা রয়েছেন।

সুতরাং, যে কোনও দেশের নামিদামি ব্যবসায়ীদের জন্য সেই দেশের টেকনোলজিক্যাল ও দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো উন্নীকরণ হলেও, দেশের মেরুদন্ড কিন্তু এখনও সেই দেশের ছোটো ছোটো উদ্যোক্তাদের হাতেই।

 

তথ্য সূত্র :

  • https://smallbusiness.chron.com/important-small-businesses-local-economies-5251.html
  • https://www.google.com/amp/okcredit.in/blog/growth-of-small-business-in-india/amp/
  • https://youtu.be/w4cl1esc9uw

More Articles