রূপঙ্কর হোক বা 'আমরেলা', কোন মানসিকতা থেকে ট্রোল করি আমরা?
নদিয়ার সুদীপ্তা, তাকে কেউ চিনত না। তার একমাত্র পরিচয় হয়ে উঠেছিল, ‘amrela’। এই ভুল বানান তার শিক্ষার মাপকাঠি হয়ে দাড়ায়। ক্রমাগত টোন-টিটকিরির শিকার হন তার পরিবারের লোকেরাও। সেই মেয়েটি সুইসাইড করতে যায় বেশ কয়েকবার।
Amrela হবে, umbrella নয় কিন্তু। আছেন এমন কেউ, যে এই বিষয় নিয়ে মজা করেননি, মিম শেয়ার করেননি? বোধহয় না। ক'দিন আগে এক বিখ্যাত সংগীতশিল্পী আরেকজন সংগীতশিল্পীকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু মন্তব্য করেন। পরের দিন তিনি মারা যাওয়াতে সেই সংগীতশিল্পীকেও কুৎসিতভাবে আক্রমণ করা শুরু হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। এতটাই হেনস্থা যে, তাঁর জীবনধারণ দায় হয়ে ওঠে। তিনি বিখ্যাত মানুষ, তাই এতটা চরম পর্যায় পৌঁছে যায় ঘটনা। ব্যক্তিগতভাবে জমে থাকা খারাপ লাগা সকলেই উগরে দেন পাবলিকের সামনে। ইনিও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। বেশ কিছু নামী ব্র্যান্ড তাঁকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
কিন্তু নদিয়ার সুদীপ্তা, তাকে কেউ চিনত না। তার একমাত্র পরিচয় হয়ে উঠেছিল, ‘amrela’। এই ভুল বানান তার শিক্ষার মাপকাঠি হয়ে দাড়ায়। ক্রমাগত টোন-টিটকিরির শিকার হন তার পরিবারের লোকেরাও। সেই মেয়েটি সুইসাইড করতে যায় বেশ কয়েকবার। আপনি বলতেই পারেন, যাতে পাশ করিয়ে দেওয়া হয় সেই কারণেই এসব ছলচাতুরি। সারা বছর পড়াশোনা করবে না বা যে সামান্য এক শব্দের ইংরেজি বানান ভুল লেখে, তার এই সমাজে হয়তো, কোথাও গিয়ে আপনার মতে, বেঁচে থাকার অধিকার নেই। কাজেই এই সামান্য কারণ, যা অনেকের মতে অসামান্য, সেই কারণেই নদিয়ার সুদীপ্তা 'নেই' হয়ে যাক। অনেকের হয়তো এই ক্ষোভ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে, কিন্তু সামগ্রিক ব্যবস্থার দিকে আঙুল তোলার চেয়ে অনেক সহজ ফলাফলকে দাগিয়ে দেওয়া।
তবে সুদীপ্তা এত কিছু জানে না, বোঝেও না হয়তো। কতটুকুই বা বয়স তার, জীবনের কতটা রসদ পেয়েছে সে, বা তার নিজস্ব জীবন কতটা বেরঙিন বা ভীষণভাবে রঙিন- কিছুই জানি না কিন্তু আমরা। সে রবীন্দ্রনাথ পড়ে না শরৎচন্দ্র, না কি সারাদিন ফোনের ভেতরে ইনস্টাগ্রাম রিল বানায়, সে ভীষণ ভালো নাচ করে না কি ছবি আঁকে আমি জানি না, আমার ধারণা আপনারাও জানেন না। কিন্তু এগুলো কোনওটাই আর তার পরিচয় না। দিনকয়েক আগের ভিডিও, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মিম, যাবতীয় হেনস্থা তার সমস্ত পরিচয়কে আপাতভাবে ঢেকে দিয়েছে।
আরও পড়ুন: সুশান্ত থেকে কে কে- আমাদের মৃত্যুশোক ভুলিয়ে দেয় মুহূর্তের প্রতিশোধ
তবে আশার কথা একটাই, আগামী কয়েকদিনে এরকম আরও ভাইরাল হওয়া ঘটনা এখনকার এই তীব্রতাকে ভুলিয়ে দেবে। আমরা তখন অন্য কোনও বানান ভুল করা ছাত্রছাত্রী বা গায়ককে নিয়ে মেতে উঠব। কিন্তু এই সময় খুবই ভয়ংকর ও বিপজ্জনক, যিনি আসলে ভিকটিম হচ্ছেন ট্রোলের, তাঁর এবং তাঁর পরিবার বিপর্যস্ত হচ্ছে। এই মুহূর্তে আমার খুব প্রিয় একটি সিনেমার কথা মনে পড়ছে, 'এ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ'। দেখেছেন হয়তো অনেকে। কঙ্কনা সেনশর্মার প্রথম ছবি। একটি চরিত্র ছিল সুটু, (অভিনয়ে বিক্রান্ত মাসে) যে প্রথম থেকেই পরিবারে থেকেও ‘না থাকা‘-র ভূমিকায় অবস্থান করে। চুপচাপ গুটিয়ে থাকা ছেলেটার পুরুষসুলভ ব্যক্তিত্বের অভাব তাকে ক্রমাগত দাপুটে, বেলেল্লা বন্ধুবান্ধবের খোরাকের শিকার করে তোলে। পড়াশোনায় তুখড় হওয়া সত্ত্বেও সে মাস্টার্সে ফেল করেছে, হয়তো তার এই অবসাদের কালশিটে দীর্ঘদিনের, যার জন্য শুধু একা সুটুকে দায়ী করা যায় না। দায়ী করা যায় তার আশপাশের লোকজনের মানসিকতাকেও। যারা সুটু পারবে না জেনেও তাকে জোর করে গাড়ি চালাতে বাধ্য করে, ভাবুন একটা ভয় পেয়ে থাকা, ঘাবড়ে যাওয়া মানুষ, যে জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থ, তাকে আরও বেশি করে ব্যর্থতায় ঠেলে দেওয়া। আসলে অন্যকে খোঁচা দিয়ে ব্যর্থ প্রমাণ করলে নিজেদের কেরামতি দেখানো যায় আর সেই লোভ টপকানো বেশ মুশকিলের। সেখানে সুটু, সুদীপ্তা এবং গায়ক এক হয়ে যান। তারা ব্যক্তিবিশেষে সম্পূর্ণভাবে আলাদা।
এই যে এতগুলো মানুষ ‘সাইবার বুলিং'-এ জড়িয়ে পড়ল, সেই মানসিকতার শেকড় কোথায়? এইভাবে কি ভেবে দেখেছেন? যারা হেনস্থার শিকার হয়, তাদের প্রতি আমরা সহানুভূতিশীল। সুটুর ক্ষেত্রে ছিলাম। কিন্তু সুদীপ্তার প্রতি নই, সেই বিখ্যাত গায়ক, যাঁর অনুষ্ঠান আপনিই দেখেছেন আপনার টাকা খরচা করে, যাঁর গান আপনার প্লেলিস্টে থাকবেই, তাঁদের প্রতি এই ভয়ঙ্কর বুলিং-এর মানসিকতা কেন? এ কি শুধুই নেট অন করে রিল্যাক্সের মুডে সাময়িক খোরাক? না কি নিজের মধ্যেই পুষে রাখা দীর্ঘদিনের আগ্রাসনের বহিঃপ্রকাশ? যা শুধু একটা সলতে জ্বালানোর জন্য অপেক্ষায় থাকে? বুলি করার, অ্যাবিউজ করার একটা মনস্তাত্ত্বিক কারণ কিন্তু নিজেও অ্যাবিউজ হওয়া, বুলি হওয়া। ছোটবেলায় স্কুলে বহু বাচ্ছা কিন্তু এসবের শিকার হয়, বড় হয়ে সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে তারা এসব ঘটনা বেছে নিতেই পারে। আর অনেকেই বাইস্ট্যান্ডারের ভূমিকায় অবস্থান করতে পারে, মানে পাশ কাটিয়ে চলা। বাস্তব জীবনে পাশের মানুষটি বিপদে পড়লে আমরা যেমন নিজে বিপদে না জড়িয়ে পড়ার জন্য পাশ কাটাই, নেটদুনিয়াতেও এহেন ঘটনা ঘটিয়ে থাকি আমরা। এবং লক্ষ করে দেখবেন বেশিরভাগ মানুষই তার আওতায় পড়ছে। আর গলদ থাকে সেইখানেই, ভয়ও সেইখানেই বাসা বাঁধে। কারণ, এটা কেউই বলতে পারে না আগামীকাল আপনিও সুদীপ্তা বা বিখ্যাত গায়কের জায়গায় অবস্থান করবেন কি না।