বিষ খাইয়ে খুন, শূলে ছিন্নভিন্ন শরীর-পৃথিবীর পাঁচটি ভৌতিক দুর্গের রক্তাক্ত ইতিহাস

ব্যোমকেশের দুর্গরহস্য পড়েছেন অনেকেই। শরদিন্দুর এই উপন্যাসটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। তবে সাপ নয়, দুর্গে যদি থাকে সত্যি ভূতের উপদ্রব? রহস্য জড়ানো অন্ধকারে তাদের পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকে আপনার দিকে? পাহাড়ের গুহার পাথুরে দেয়ালঘেরা সেই সব দুর্গে বেরনোর একমাত্র পথটি ঘিরে যদি চলে হাজার হাজার শেয়ালের মিছিল? আর হঠাৎ কাউকে দেখে তারা সব দাঁড়িয়ে পড়ে মন্ত্র মুগ্ধের মতো? হাজার হাজার বছরের কঙ্কাল যেখানে পাতাল থেকে উঠে আসে প্রতি রাতে সেখানে ভয় পাওয়ার জন্যই মানুষ ঘুরতে যান, সে ব্যবস্থাও রয়েছে—মানুষ এমনই বিচিত্র! গল্প উপন্যাসের দুর্গকে হার মানিয়ে দিতে পারে এমন কিছু ভৌতিক দুর্গ রয়েছে পৃথিবীতে। একদিকে তাদের অপরূপ সৌন্দর্য, অন্যদিকে অন্ধকারের আড়ালে আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে বীভৎস সব অতীত। ভূত কথাটির দু'রকম মানে হয় বাংলাতে! তৎসম ‘ভূত’ অর্থে যা উৎপন্ন হয়েছে ও বর্তমান আছে। আবার তদ্ভব ‘ভূত’ অর্থে যা ফুরিয়ে গেছে কিন্তু যার আদল লুপ্ত হয়নি।হ

আয়ারল্যাণ্ডের লিপ ক্যাসল

তেরো থেকে পনেরো শতকের মধ্যে কোনও এক সময় এই দুর্গটি নির্মিত হয়। তারপর কেটে গিয়ে অনেক কটি শতক। আইরিশ এই দুর্গের ইতিহাস হার মানাবে অধুনা জগত বিখ্যাত ‘গেম অব থ্রোন্‌সের’ রেড ওয়েডিং-কেও! এই দুর্গে যে ও’ক্যারোল পরিবার থাকত, তারা নাকি অতিথিদের খাবারে প্রায়শই বিষ মিশিয়ে খুন করত! এই বংশের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে তখন বেজায় টালমাটাল অবস্থা চলছে। শোনা যায়, দুর্গের গির্জায় মাস প্রেয়ার চলাকালীন বহু লোকের সামনেই পাদ্রীরই এক ভাই তাকে তলোয়ারে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। এই ঘরটি ‘দ্য ব্লাডি চ্যাপেল’ বলে পরিচিত আজও! খুন হয়ে যাওয়া সেই পাদ্রী এখনও প্রতি রাতে সেখানে আসেন–তেমনটাই বলা হয়ে থাকে! এখানেই শেষ নয়! এ তো গেল সর্বসমক্ষে হওয়া এক খুনের গল্প! এই দুর্গের বদ্ধ কানাচে রক্তের ইতিহাস ছড়িয়ে রয়েছে আরো। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে দুর্গের সংস্কার শুরু হয়। এই সময় ‘ব্লাডি চ্যাপেলের’ নিচে এক গোপন অন্ধকূপ আবিষ্কার করে মজুরেরা। এই অন্ধকূপের ভিতর যা নরকঙ্কাল পাওয়া যায়, তা তিনটি গাড়িতে বোঝাই করে বয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল। অন্ধকূপটি এমন ভাবে তৈরি যাতে দিশেহারা বন্দীরা অতর্কিতে একটা গুপ্ত দরজা গলে নীচে গিয়ে পড়ত। এবং নীচে কাঠের শূলগুলি তাদের ফুসফুস ফুটো করে শরীর গেঁথে রাখত। খুব ধীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ভুগে মারা যেত তারা। ও’ক্যারোল বংশের পায়ের অনেকখানি নিচে, একা, অন্ধকারে!

 

ইংল্যাণ্ডের চিলিংগাম ক্যাসেল

এই দুর্গে এক সময়ে মনেস্ট্রি ছিল, রাজা রাজড়ার বাসস্থান ছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এতে সেনাব্যারাকও ছিল। অথচ ইংল্যাণ্ডের সবথেকে ভৌতিক উৎপাত হয়ে থাকে এখানেই! চিলিংগাম ক্যাসেল! এর অন্ধকূপ গুলি অত্যাচারের ইতিহাসে ভরপুর এখনও! সবথেকে বিখ্যাত যে ভৌতিক বাসিন্দা, তার নাম ‘ব্লু বয়’। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এর উৎপাত মূলত দুর্গের পিঙ্ক রুম ঘিরে। এক প্রচণ্ড আর্তনাদ শুনে চমকে উঠে অনেকেই তাদের বিছানার ঠিক ওপরে একটা নিল আলোর ঝলক এবং একটা নীল বলয় দেখেছেন। এছাড়া রয়েছে ‘হোয়াইট লেডি’ ও একাকিত্বে ভোগা ‘লেডি মেরি বার্কলি’। ভূতুড়ে অভিজ্ঞতার জন্য এই দুর্গে ঘর ভাড়াও দেওয়া হয়, যদি পারেন কখনও রাত কাটিয়ে আসুন!

জার্মানির বার্গ এলৎজ্‌

এই দুর্গ তৈরি হয়েছিল ১১৫৭ সালে জার্মানির কোব্লেঞ্জ ও ট্রায়ার শহরের মাঝামাঝি। একে জড়িয়ে থাকা নানা কিংবদন্তীরাও প্রায় ততধিক পুরনো। এই দুর্গের যে সমস্ত কক্ষে পর্যটকদের ভ্রমণের অধিকার আছে, তার মধ্যে সব থেকে ভয়ঙ্কর হল কাউণ্টেস অ্যাগনেসের ঘরটি! তাঁর বিছানা, বর্ম মায় লড়াই করতে যাবার কুঠারটি পর্যন্ত এই ঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। শোনা যায়, এক অনাধিকার অনুপ্রবেশকারীর হাত থেকে দুর্গটি বাঁচাতে প্রাণ দিয়েছিলেন অ্যাগনেস। সেই থেকে তাঁর আত্মা দুর্গেই রয়ে গিয়েছে।

 

চেক রিপাবলিকের হাউস্কা ক্যাসল

প্রাগ থেকে ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। এই অদ্ভুত দুর্গের কোনও প্রাচীর নেই, নেই রান্নাঘর বা বাসিন্দাও; কোনো দিনই ছিল না! এ তবে কেমন দুর্গ? আসলে যে জায়গায় বর্তমানে দুর্গটি রয়েছে সেখানে মাটিতে ছিল এক বিশাল গর্ত, যার তল দেখা যেত না। বিশ্বাস ছিল, এর কোনও তল নেই। নরক থেকে এই পথ সোজা পৃথিবীতে উঠে এসেছে। তাই নরকের যাবতীয় শয়তানকে আটকে রাখতে খুব কৌশলে এই দুর্গ গড়া হয়। দুর্গের নিচের তলায় তাতে করে এই সব দানবেরা আটকা পড়ে। 

এই গর্ত যদিও বর্তমানে ভরাট করা হয়েছে। কিন্তু তার আগে কয়েকজন কয়েদিকে প্রাপ্য শাস্তি ক্ষমা করার লোভ দেখিয়ে গর্তের নীচে কী আছে তা জানার জন্য দড়িতে বেঁধে এই গর্তে নামানো হয়। প্রথমজন নামার কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে চিৎকার করতে শুরু করলে বাকিরা তাকে টেনে তোলে। শোনা যায়, তোলার পর দেখা গিয়েছিল লোকটির বয়েস বছর তিরিশেক বেড়ে গিয়েছে।

রোমানিয়ার ব্রান ক্যাসেল

এই দুর্গ আদতেই ড্রাকুলার দুর্গ। ভ্লাদ দ্য থার্ড ড্রাকুলা ছিল সেই কাউণ্টের নাম। এঁকে লোকে ভ্লাদ দ্য ইমপেলার বলেও জানত। হ্যাঁ, রক্তচোষার বদলে আদতে ইনি শূলে চড়াতেন যুদ্ধবন্দীদের। ট্রান্সিল্ভ্যানিয়ার স্যাক্সনরা ভ্লাদের বিপক্ষকে সমর্থন করেছিল বলে স্যাক্সনদের গ্রাম কে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে বন্দীদের ওয়াল্লাচিয়ায় নিয়ে এসে শূলে চড়ান তিনি। অনেকে মনে করেন ব্রান ক্যাসেল হল সেই দুর্গ যাকে কেন্দ্র করে ট্রান্সিলভেনিয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে ছিলেন ভ্লাদ। এছাড়া ট্রানসিলভেনিয়ার এই দুর্গে মড়াখেকোদের উৎপাত রয়েছে বলে জানা যায়। ১৩৮৮ সালের এই দুর্গকে ব্রাম স্টোকারের লেখা ‘ড্রাকুলা’ উপন্যাসের সেই দুর্গটি বলেই চিহ্নিত করা হয়ে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে। যদিও লেখক নিজে কখনও রোমানিয়ায় যাননি। আশেপাশের গ্রামাঞ্চলের উপকথায় বলে, দুর্গের মরেও না মরা আত্মারা গ্রামের মানুষদের ওপর উৎপাত চালায়। মধ্যযুগের রক্তাক্ত ইতিহাস এই দুর্গকে আরও ভুতূড়ে করে তুলেছে। দুর্গের মিউজিয়ামে, অন্যান্য ভয়াবহ জিনিসের মধ্যে রয়েছে একটি সোনার বাক্সে রোমানিয়ার রানি মেরির হৃৎপিণ্ড।

 

 

 

তথ্যঋণ—

“8 Haunted Castles That Will Leave You Spooked.” Nast, Condé. 2016. 

“15 Real Haunted Castles That Put Bly Manor to Shame.” Condé Nast Traveler. October 6, 2016. 

The Times of India. n.d. “Inside the Most Haunted Castles in the World!” 

“Vlad the Impaler.” 2021. In Wikipedia. 

সুকুমার সেন, গল্পের ভূত, প্রবন্ধ

More Articles