দুর্নীতির আখ্যানে নয়া চরিত্র! যেভাবে সিবিআইয়ের জালে এলেন 'কালো মানিক'!
Manik Bhattacharya Arrested: একাধিকবার টেট পরীক্ষার আয়োজনে অব্যবস্থা, পর্যাপ্ত পরিবহনের অভাব, পর্ষদের কাজে নানা অভিযোগ উঠলেও মানিক ছিলেন নিজের মতোই। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বা ব্রাত্য বসু, কারওর আমলেই নড়চড় ঘটেনি মানিকের।
‘হিরে মানিক তো নয়, আমি যে শুধু তোমায় ভালোবাসি..!’
বিশের দশকে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল এই গান। এবার বঙ্গের উত্তপ্ত রাজনীতি, মোমিনপুর-একবালপুর বিতর্কের আবহে কেউ কেউ আবার গাইছেন এই ভালোবাসার গান! নাহ্, আমার-আপনার জন্য নয়, এই ভালোবাসার কথা বলা হচ্ছে, মানিকের প্রতি সিবিআই, সিবিআইয়ের প্রতি মানিক আবার মানিকের প্রতি ইডির ‘টান’ নিয়ে! আর সেই অমোঘ আকর্ষণের সমাপতন যেন ঘটল মঙ্গলবার। রাতভর জেরার পর, অবশেষে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে ইডির জালে রাজ্যের তৃণমূল বিধায়ক, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রাথমিকে নিয়োগ, টেট পরীক্ষা এবং ঘুষ নিয়ে চাকরি দেওয়ার সঙ্গেই সমগ্র নিয়োগ দুর্নীতিতে অন্যতম চক্রান্তকারী ছিলেন তিনি। অর্থাৎ হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থীর মেধাকে তুচ্ছ করে টাকার কাছে চাকরি বেচতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল তাঁর! যা সামগ্রিকভাবে প্রকাশ্যে আসে কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে এই তদন্তও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে যাওয়ার পরে।
প্রসঙ্গত, প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্তে নেমেছে ইডি, সিবিআই। এর আগেই বিপুল পরিমাণে টাকা উদ্ধারের ঘটনায় এবং এই দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গে গ্রেফতার হন তাঁর ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ও। এরপরেই জালে আরও জড়ান মানিক ভট্টাচার্য। পার্থ-অর্পিতা এবং একাধিক অভিযুক্তকে জেরার ফলে উঠে আসে মানিকের নাম। চাকরিপ্রার্থীরাও সরাসরি অভিযোগ করেন মানিকের বিরুদ্ধে।
১০ অক্টোবর, ২০২২। মানিক ভট্টাচার্যকে ফের ডেকে পাঠায় ইডি। সিজিও কমপ্লেক্সে উপস্থিত হন পলাশীপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক। শুরু হয় ম্যারাথন জেরা। একের পর প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হন তৃণমূল নেতা।
১১ অক্টোবর, ২০২২। মঙ্গলবার গভীররাত। সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে তখনও জ্বলছে আলো। মধ্যরাতে গ্রেফতার হন বহুচর্চিত মানিক। উচ্চ আদালত, শীর্ষ আদালতে ছুটোছুটির পরেও ইডির হাতে বাঁধা পড়েন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি। গ্রেফতারির পর প্রথম ফোন যায় তাঁর ছেলের কাছে।
মানিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, টেট এবং প্রাথমিকে নিয়োগের ক্ষেত্রে যে দুর্নীতি এবং বিপুল অঙ্কের টাকার বেআইনি লেনদেন হয়েছে, তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে তাঁর। এমনকী প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং অন্যান্য অভিযুক্তদের সঙ্গে সরাসরি যোগ ছিল তাঁর। চাকরি লোপাট থেকে শুরু করে যাবতীয় দুর্নীতি, সব ক্ষেত্রেই অভিযোগ উঠেছে মানিকের বিরূদ্ধে। যে অভিযোগই এতদিন করে আসছিলেন বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীরা। এর আগেও মানিককে একাধিক বার ডেকে পাঠায় ইডি, সিবিআই। কখনও তিনি হাজিরা দিয়েছেন, কখনও আবার এড়িয়ে গিয়েছেন। এবার আর সেই কাজ করতে পারলেন না তিনি। যদিও এই গ্রেফতারির বিরোধিতা করে দেশের শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন তাঁর আইনজীবী। তাঁদের দাবি, আদালতের দেওয়া রক্ষাকবচ থাকলেও কেন গ্রেফতার! যদিও ইডি সূত্রে দাবি, রক্ষাকবচ সিবিআইয়ের ক্ষেত্রে, তাদের নয়, সেটাও প্রায় শেষ। তাই গ্রেফতারির জন্য তাদের আর কোনও বাধা নেই।
আরও পড়ুন- শুভেন্দু না কানন, পুরনো মমতাকে কে বেশি চেনেন?
কীভাবে মানিক জড়িয়ে গেলেন সিবিআই-জালে?
১৩ জুন। ২০২২। ২০১৪ সালের প্রাথমিক টেট নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ওই নির্দেশে জানান, প্রাথমিকে ২০১৭ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় নিয়োগ তালিকা সম্পূর্ণ বেআইনি। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যান মানিক ভট্টাচার্য এবং সচিব রত্না চক্রবর্তী বাগচীকে ওই দিনই বিকেল ৫ টার মধ্যে সিবিআই দফতরে হাজির হতে হবে বলে নির্দেশ দেন বিচারপতি। হাজিরা না দিলে সিবিআইকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলে আদালত। ওই দু’জনের বিরুদ্ধে এফআইআর করেও তদন্ত শুরুর নির্দেশ দেন বিচারপতি। ৪ জুলাইয়ের প্রকাশিত দ্বিতীয় নিয়োগ তালিকা থেকে যে ২৬৯ জনকে নিয়োগ করা হয়, তাঁদের সকলকেই চাকরি থেকে বরখাস্তের নির্দেশও দেয় আদালত।
যদিও এর আগেই স্কুল সার্ভিস কমিশনের গ্রুপ সি, গ্রুপ-ডি, নবম-দশমের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। কলকাতা হাইকোর্টে গড়ায় একাধিক মামলা। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এই রকম ৭টি মামলার ক্ষেত্রে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন। স্কুল সার্ভিস কমিশন বা রাজ্য সরকার তার বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে যায়। মামলার জল অনেকদূর গড়ালেও শেষমেশ তদন্ত শুরু করে সিবিআই। সঙ্গে যোগ দেয় ইডিও। যদিও এই নির্দেশের পরেই নিজাম প্যালেসে সিবিআইয়ের মুখোমুখি হন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি।
১৯ জুলাই, ২০২২। প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় ডিভিশন বেঞ্চে শুনানি শেষে রায়দান স্থগিত রাখে আদালত। বিচারপতি সুব্রত তালুকদার, বিচারপতি লাপিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ ওই মামলার রায়দান স্থগিত রাখে।
২০ জুন, ২০২২। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতির পদ থেকেও মানিককে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দেন অপসারণের। যদিও এই নির্দেশের বিপক্ষে গিয়ে ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হন তিনি।
২১ জুন, ২০২২। আদালতের নির্দেশেই সিবিআই তদন্ত শুরু করে মানিকের বিরুদ্ধে। আদালত তাঁকে ডেকে সম্পত্তির হিসেব চেয়েছিল আগেই। ৫ জুলাইয়ের মধ্যে মানিকের নিজের, স্ত্রী এবং ছেলের সম্পত্তির পরিমাণ হলফনামা দিয়ে জানাতে বলা হয়।
২৩ জুলাই, ২০২২। শিক্ষক নিয়োগ-দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এর ঠিক দু’দিন পরেই মানিক ভট্টাচার্যকে ডেকে পাঠায় ইডি। অর্থাৎ সিবিআই তলবের সঙ্গেই ইডিও ডাক দেয় মানিককে।
২৭ জুলাই, ২০২২। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অপসারিত সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যকে তলব করে ইডি। ২৮ জুলাই, সিজিও কমপ্লেক্সে হাজিরার নির্দেশ দেয় ইডি। এসএসসি দুর্নীতি মামলায় এই প্রথম প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মানিক ভট্টাচার্যকে তলব করা হয়। এর কয়েকদিন আগেই শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়সহ শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর বাড়িতেও হানা দেয় ইডি।
১০ অগাস্ট, ২০২২। ফের ইডির ডাক পড়ে মানিকের জন্য। অপসারিত প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যকে তলব করে ইডি। সব তথ্য নিয়ে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
২৭ জুলাই, ২০২২। প্রায় ১৪ ঘণ্টা ধরে আইডির তরফে জেরা করা হয় মানিক ভট্টাচার্যকে।
২৯ জুলাই, ২০২২। ফের সিজিও কমপ্লেক্সে হাজিরার নির্দেশ মানিক পান ইডির তরফে। এর আগেই ইডির আধিকারিকরা বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি করেন মানিকের।
২৩ অগাস্ট, ২০২২। কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে আগেই পর্ষদের সভাপতির পদ থেকে সরানোর কথা ছিল মানিককে। কিন্তু এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে যান তিনি। যদিও এত কিছুর পরেও সরতে হয় তাঁকে অপসারিত হন মানিক। এই দিন সেই অপসারণ পাকাপাকি করে রাজ্য। নতুন সভাপতি যোগ দেন কাজে।
২৫ অগাস্ট, ২০২২। প্রকাশ্যে আসে একটি খবর। জানা যায়, মানিক ভট্টাচার্যের নামে লুক আউট নোটিশ জারি করেছে সিবিআই। তাঁর সঙ্গে নাকি যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। যদিও এর পরেই কলকাতায় নিজের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে মানিক দাবি করেন, তিনি বাড়িতেই ছিলেন।
২৭ সেপ্টেম্বর। ২০২২। ২০১৪ সালের টেট পরীক্ষায় ১২ লক্ষেরও বেশি ওএমআর শিট নষ্ট করার অভিযোগের প্রেক্ষিতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। এই নির্দেশের সঙ্গেই রাত আটটার মধ্যে সিবিআই দফতরে মানিককে হাজিরার কথা বলা হয়। কিন্তু ওইদিন নিজাম প্যালেসে হাজিরা দেননি মানিক। শুরু হয় টানাপোড়েন।
৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২। পুজোর মুখে স্বস্তি পান মানিক ভট্টাচার্য। সুপ্রিম কোর্টের তরফে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত রক্ষাকবচ দেওয়া হয় তাঁকে। সিবিআই গ্রেফতারে এই স্বস্তি পান তিনি।
১১ অক্টোবর, ২০২২। আর বাঁচতে পারেননি মানিক। দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গেই ইডির হাতে গ্রেফতার হতে হয় তাঁকে।
আরও পড়ুন- বিজেপি-কে ‘সবক’ শিখিয়েছিলেন, মৃত মুলায়মের ভার যে কারণে জীবিত-র থেকেও বেশি
কিন্তু কে এই মানিক?
৬৭ বছর বয়স। বাবা সুনীল ভট্টাচার্য। নদিয়ার ভূমিপুত্র মানিক ভট্টাচার্য। বর্তমানে বাস যাদবপুর বিধানসভা এলাকায়। স্ত্রী একটি কোম্পানির পরিচালক। রয়েছেন এক পুত্রও। মানিক ভট্টাচার্য কলকাতার যোগেশ চন্দ্র আইন কলেজে আইন নিয়ে পড়েন। ১৯৭৭ সাল নাগাদ স্নাতকোত্তর হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৯৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। শিক্ষক মানিকের দ্রুতগতিতে উত্থান ঘটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে। তৃণমূল ঘনিষ্ঠ মানিক, ২০১২ সাল থেকে টানা ১১ বছর রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি হিসেবে বহাল থাকেন। টেট দুর্নীতির অভিযোগ, আদালতের রায়ের আগে পর্যন্ত তিনিই ছিলেন প্রাথমিকের সর্বেসর্বা।
একাধিকবার টেট পরীক্ষার আয়োজনে অব্যবস্থা, পর্যাপ্ত পরিবহনের অভাব, পর্ষদের কাজে নানা অভিযোগ উঠলেও মানিক ছিলেন নিজের মতোই। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বা ব্রাত্য বসু, কারওর আমলেই নড়চড় ঘটেনি মানিকের। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে নদিয়ার পলাশী পাড়া আসনে তৃণমূলের টিকিটে নির্বাচনে লড়েন। জেতেন। অবশেষে পাকাপাকিভাবে তৃণমূল বিধায়ক হন তিনি। শুধু পার্থ চট্টোপাধ্যায় নন, মানিকের সঙ্গে মমতার সম্পর্কও বেশ ভাল বলেই জানা যায়।
প্রসঙ্গত, উত্তরবঙ্গের মানিক মহম্মদের জীবন বাঁচানোর মতো মহান কাজ আবার ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিকের আবহে এই মানিক একেবারেই ভিন্ন। অনেকেই কটাক্ষ করে তাঁকে কালো মানিক বলে ডাকছেন। অর্থাৎ, কিছু প্রমাণিত না হলেও মারাত্মক দুর্নীতি আর যোগ্যদের ভবিষ্যত শেষ করার অপরাধের যে অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে, তা যে এই মানিকের ভাবমূর্তিতে কালো ছাড়া আর কিছুই নয়, এমনও বলেছেন কেউ কেউ।