শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া আঘাত! বিচারক থেকে মন্ত্রী— দায় কার?

SSC Teachers' protest: বহু আগেই উঠে গেছে পাশ-ফেল, টিমটিম করতে থাকা সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা যা এখনও এ রাজ্যের ৮৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর একমাত্র অবলম্বন তা এই রায়ে কার্যত গুঁড়িয়ে গেল।

বিকাশ ভবনের সামনে রাত জাগছেন চাকরিহারা শিক্ষক শিক্ষিকারা। তাঁদের উপর নৃশংস লাঠিচার্জ করছে পুলিশ। মানুষ গড়ার কারিগরদের শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে৷ তাঁরা রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছেন কিন্তু রাজপথ ছাড়ছেন না। এই দৃশ্য আলোড়িত করেছে গোটা রাজ্যকে৷ তৃণমূল সরকারের পুলিশের নৃশংসতা অনেককেই মনে পড়িয়ে দিচ্ছে উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের বিজেপি সরকার আন্দোলনরত শিক্ষক শিক্ষিকাদের উপর যে নির্মম নিপীড়ন নামিয়ে এনেছিল, তার কথা। দৃশ্যতই স্পষ্ট যে, শিক্ষক পেটানোয় বিজেপির পথেই হাঁটছে তৃণমূল।

দলমত নির্বিশেষে রাজ্য সরকারের পুলিশের এই বীভৎস আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন গোটা রাজ্যের মানুষ। মধ্যরাত্রে সল্টলেকে বিকাশ ভবনের সামনে পৌঁছে গিয়েছেন একঝাঁক চিকিৎসক। তাঁদের মধ্যে ছিলেন অভয়ার বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তাররাও। আশার কথা এই যে, এখনও পর্যন্ত আন্দোলনরত শিক্ষক শিক্ষিকাদের একটি বড় অংশ সাম্প্রদায়িক শক্তির অনুপ্রবেশ রুখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।

কিন্তু কেন এই জটিলতা? কেন মধ্যরাত্রে সল্টলেকের মাটি ভিজল শিক্ষকদের রক্তে? যে নির্মম বাস্তবতা তাঁদের পথে নামতে বাধ্য করল, তার পিছনের গল্পটা কী? কারা দায়ী সবটুকুর জন্য?

আরও পড়ুন- ২৬ হাজার চাকরি বাতিলই! বিধানসভা নির্বাচনে অশনি সংকেত হবে শিক্ষকদের কান্না?

গত ৩ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরি হারিয়েছেন এই রাজ্যের প্রায় ২৬,০০০ শিক্ষক, শিক্ষিকা এবং শিক্ষাকর্মী। এই রায় কার্যত ২০২৪ সালের ২২ এপ্রিলের হাইকোর্টের দেবাংশু বসাক ও মহম্মদ শব্বর রশিদির বেঞ্চ কর্তৃক গৃহীত রায়ের বর্ধিত রূপ। হাইকোর্টের রায়ের পর প্রথমবার রাজ্যের প্রায় ২৬,০০০ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী জানতে পেরেছিলেন, তাঁরা প্রশাসন এবং নিয়োগকারী সংস্থার সামগ্রিক দুর্নীতির শিকার হয়ে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। সেই প্রাতিষ্ঠানিক ১৭ দফা দুর্নীতির উপর থেকে যখন পরত সরতে থাকল, তখন তার বীভৎসতা বিস্মিত করেছে সকলকে। প্রশাসনের ক্ষমতার ঔদ্ধত্য কোথায় গিয়ে পৌঁছলে সর্বদিকব্যাপী এই ভয়াবহ দুর্নীতি সম্ভব তা নিঃসন্দেহে অনুমেয়।

ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে দেখা যাবে ঘটনার সূত্রপাত ২০১৪ সালে। প্রথমবার রাজ্যসরকার জোন ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া তুলে দিয়ে স্টেট লেভেল সিলেকশন টেস্ট (এসএলএসটি) সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি বের করে। ফর্মপূরণও হয়। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে তা বাতিল হয়ে পুনরায় সেই একই শূন্যপদগুলির সাপেক্ষে ২০১৫ সালে রিনোটিফিকেশন এবং ২০১৬ সালের কুখ্যাত এসএলএসটির সামগ্রিক লিখিত পরীক্ষা দু'টি ধাপে (নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ) সম্পূর্ণ হয়। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে লিখিত পরীক্ষাপর্বের পর দীর্ঘ চাপানউতোর, বারংবার নথিপত্র যাচাই, কাউন্সেলিং ইত্যাদি অতিক্রম করে নিয়োগ সম্পন্ন হতে আরও দু'বছর গড়ায়। ২০১৮-১৯ সালে শিক্ষক শিক্ষিকারা যখন স্কুল বাছাই করছেন, ঘটনার মোড় ঘুরতে থাকে তখন থেকেই। একের পর এক স্কুলে শূন্যপদ সমস্যা দেখা যায়। কাউন্সেলিং পর্ব যত গড়ায় নজরে আসে প্যানেল থেকে উড়ে যাচ্ছে বেশ কিছু নাম। আবার প্যানেলের একেবারে গোড়ার দিকে ম্যাজিক্যাল ফিগার '৫৩' (লিখিত পরীক্ষার পূর্ণ মান ৫৫) নিয়ে অধিষ্ঠান করছেন এমন অনেকেই, যাঁদের আকাডেমিক বা ইন্টারভিউয়ে প্রাপ্ত নম্বর চোখে পড়ার মতো কম। দুর্নীতির কানাঘুঁষো তখন থেকেই শোনা যেতে থাকে। বারেবারে আটকে যায় নিয়োগ প্রক্রিয়া। ফলস্বরূপ কোর্টের অনুমতি নিয়ে কাউন্সেলিং পর্ব সম্পূর্ণ করার আগেই মেয়াদ ফুরোয় প্যানেলের। যে ১৭ দফা দুর্নীতির জন্য আজ ২৬,০০০ শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মী রাস্তায় বসেছেন, তার অন্যতম একটি বিষয় হলো মেয়াদোত্তীর্ণ প্যানেল থেকে নিয়োগ (যদিও তা তখন ছিল কোর্ট অনুমোদিত)।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শিক্ষাকর্মীদের নিয়োগ এসএলএসটির অন্তর্ভুক্ত নয়, যদিও পরীক্ষা ২০১৬ সালেরই। করোনা পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ হিসেব মতো যোগদানের প্রায় দু'বছর পর কিছু পরীক্ষার্থী দাবি করতে থাকেন, তাঁদের থেকে কম নম্বর পেয়ে অর্থাৎ প্যানেলের পিছনদিকের ব্যক্তিরা চাকরি পেয়েছেন এবং তার ফলে যোগ্যতার নিরিখে তাঁরা বঞ্চিত হয়েছেন। বঞ্চনাকারীদের মধ্যে প্রথম উঠে আসে তৃণমূলের নেতা পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর নাম। যোগ্য বঞ্চিতরা এরপর এই ধরনের একাধিক ঘটনাসহ প্যানেলবহির্ভূত ব্যক্তিদের নিয়োগের অভিযোগ নিয়ে কোর্টের শরণাপন্ন হন। দু'বছর অতিক্রম করায় অর্থাৎ প্যানেল মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় বহু বিচারক এই মামলা নিতে অস্বীকার করলেও বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলির এজলাসে মামলাগুলি গৃহীত হয়। কেন এতদিন পর বঞ্চিত প্রার্থীরা মামলা করলেন বা নিয়ম বিরুদ্ধভাবে বিশেষ একটি এজলাসে করতে পারলেন তা এখনও রহস্যাবৃত।

মামলাটি সিবিআইয়ের হাতে যায়। দীর্ঘদিন এসএসসি দপ্তর সিজ করে রাখা হয়। উর্ধ্বতন আধিকারিকদের জেরা করে জানা যায়, ওএমআর শিট ইভ্যালুয়েশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় নাইসা নামক একটি সংস্থাকে, যারা তা হাতবদল করে স্ক্যানটেক নামক আরেকটি সংস্থাকে। পরবর্তীকালে গাজিয়াবাদে নাইসার কর্ণধারের বাড়ি থেকে ওএমআর সহ হার্ডডিস্কগুলি বাজেয়াপ্ত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এসএসসির কাছে বিপুল ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার (যা এই ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মূল্যায়নের জন্য কেনা হয়েছিল) থাকা সত্ত্বেও কেন প্রকাশ্যে টেন্ডার ডেকে ওএমআর মূল্যায়নের দায়িত্ব অন্যত্র স্থানান্তরিত করতে হলো তা জানতে চোখ রাখতে হবে এসএসসির গেজেটে, যেখানে আগেকার নিয়ম বদলে ওএমআর সংরক্ষণের সময়সীমা একবছর বেঁধে দেওয়া হলো। এবং দুর্নীতিকে আড়াল করতেই নিজের সার্ভারে মিরর ইমেজটুকুকেও নষ্ট করে দেওয়া হলো। স্ক্যানটেকের সার্ভারের উপর ভরসা করে পরবর্তীতে এগিয়েছে সামগ্রিক তদন্ত প্রক্রিয়া। যেখানে ঘটে গিয়েছে অজস্র বিধিভঙ্গ। বিচারালয় তার নিজস্ব পর্যবেক্ষণে এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে আংশিকভাবে 'টেন্টেড' চিহ্নিত করলেও 'আনটেন্টেড'-দের ক্ষেত্রে এই তথ্যের গ্রহণযোগ্যতাক অগ্রাহ্য করেছেন।

দেখা গেল, কোটি কোটি টাকা লেনদেনের পরিণতিতে ঘটেছে পিছনের নামকে আগে বসিয়ে দেওয়া, ওএমআর শিটে অদলবদল, বিনা সুপারিশ পত্রেই নিয়োগপত্র-সহ ১৭ দফার প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি। ঘটনার ধারাবাহিকতায় পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুবীরেশ ভট্টাচার্য, কল্যাণময় বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা, মন্ত্রীরা জেল বন্দি হয়েছেন, কেউ কেউ জামিনে মুক্ত, কিন্তু সামগ্রিক তদন্তপ্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই অত্যন্ত তড়িঘড়ি হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ (অভিজিৎ গাঙ্গুলির বেঞ্চ) থেকে কিছুসংখ্যক দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষক শিক্ষাকর্মীর সুপারিশ বাতিল হয়। তাঁরা শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হলে সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ মামলাটিকে পুনরায় হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে পাঠালে সেখানে মেধার ভিত্তিতে নিযুক্ত প্রায় ১৯,০০০ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে অত্যন্ত অমানবিক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার লক্ষ্যে বিধানসভা ভোটের প্রাক্কালে পুরো প্যানেল বাতিলের রায় ঘোষিত হয়েছিল। ঠিক এর পরেই আমরা অভিজিৎ গাঙ্গুলির রাজনৈতিক অবস্থান এবং পরিণতি লক্ষ্য করা দরকার। কোনও এক অজানা জাদুবলে রায় ঘোষণার আগের দিন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর 'বোমা ফাটানোর' বক্তব্যও স্মরণে থাকবে সকলেরই। দিশেহারা ১৯,০০০ শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মী (যাঁদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ প্রমাণিত নয়) প্রথমবার জানতে পারলেন তাঁরা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বলি হয়েছেন। এতদিনের কষ্টার্জিত চাকরি-সহ জীবন জীবিকার অনিশ্চয়তায় তাঁরা মনে করলেন সুপ্রিম কোর্ট সুবিচার দেবে, 'ন্যাচারাল জাস্টিস'-এর একেবারে প্রারম্ভিক শর্তগুলিকে মান্যতা দিলে বিনা দোষে মৃত্যুসম এই সাজা হতে পারে না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চের অবজারভেশনকে মিথ্যা প্রমাণ করে জাস্টিস সঞ্জীব খান্নার বেঞ্চ হাইকোর্টের রায়কেই বহাল রাখল। কিন্তু ক্যাবিনেট সহ মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত রদ করা হলো। এই একবছর ধরে চলা শুনানিতে বিরোধী পক্ষের আইনজীবী (বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য -ফিরদৌস শামীম) বলেছেন 'অল আর ফ্রড' অর্থাৎ গোটা প্যানেলজুড়ে এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে দুর্নীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লিপ্ত নয়। যদিও তাঁরা সেই সব চাকরিপ্রার্থীরই আইনজীবী ছিলেন যাঁরা প্রথম 'র‍্যাঙ্ক জাম্প' ইস্যুকে গোচরে আনে এবং 'রিপ্যানেলিং'-এর দাবি তোলে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তাঁদের হয়ে লড়তে গিয়ে তিনি প্যানেল বাতিলের পক্ষেই কেবল সওয়াল করে গেলেন।

এই একবছরে আমরা আরও দেখব, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি মামলা শোনার ধৈর্য্য ধরতেই অপারগ। কখনও তিনি অধিবেশন বিলম্বিত করেছেন, কখনও নির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া অন্য তথ্যপ্রমাণ সম্বন্ধে শুনবেন না বলেছেন। আবার কখনও অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেছেন। সিবিআই যখন তথ্য প্রমাণসহ তুলে ধরে যে তাদের উদ্ধারকৃত ওএমআরগুলির হ্যাশ ভ্যালু ও মেটা ডেটা অবিকৃত, তখন তিনি ৬৫বি অর্থাৎ হার্ড ডিস্ক সংক্রান্ত সওয়াল জবাবে রুচি হারান এবং শ্রমিকের (চাকুরিজীবী শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের) সমস্ত সাংবিধানিক অধিকারকে নস্যাৎ করে সাত বছরের কর্মজীবনে ইতি টানেন, যেখানে হিসেবমতো দু'বছরের প্রবেশনারি পর্বের পর একজন সরকার বা সরকার পোষিত সংস্থার কর্মীর 'অটোকনফার্মেশন' হয়।

আরও পড়ুন- চাকরি গেছে লাখ লাখ শিক্ষকের! কেন এমন বেহাল দশা ভারতের শিক্ষাব‍্যবস্থার

অত্যন্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই রায় যে কেবল ১৯,০০০ যোগ্য চাকরিহারা এবং তাদের পরিবারের কাছে মর্মন্তুদ তাই-ই নয়, এর শিকড় আরও গভীরে, যেখানে টান মারলে সরকারি শিক্ষার মৃতপ্রায় রোগজর্জর ছবি চোখে পড়ে। এমনিতেই দীর্ঘ সাত বছরে নতুন নিয়োগ না হওয়ায় শিক্ষকের অভাবে ধুঁকতে থাকা সরকারি স্কুলগুলিতে এই রায়ের প্রভাব পড়েছে। শিশুর শিক্ষার মৌলিক অধিকারের নিয়মে ৩০ জন শিক্ষার্থীপিছু একজন শিক্ষক থাকার কথা। বর্তমানে তা ছিল ৫২ জন পিছু একজন। এই ঘটনা তা নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছে ৫৮ জন পিছু একজন। বহু স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ বন্ধ, একজন শিক্ষক বহু বিষয়ের ক্লাস নিতে বাধ্য হন। কোথাও প্রধান শিক্ষককে সামলাতে হয় করণিক বা গ্রুপ ডি-র কার্যভার। অজস্র স্কলারশিপ এবং সরকারি আনুকূল্যকে বাস্তবায়িত করতে হিমশিম খাওয়া মাস্টারমশাইরা এমনিতেই পড়ানোর প্রতি কতটুকু মনোযোগী হতে পারেন তা প্রশ্নবহুল। বহু আগেই উঠে গেছে পাশ-ফেল, টিমটিম করতে থাকা সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা যা এখনও এ রাজ্যের ৮৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর একমাত্র অবলম্বন তা এই রায়ে কার্যত গুঁড়িয়ে গেল।

সম্প্রতি মধ্যশিক্ষা পর্ষদকে আবার ছুটতে হয়েছিলো সুপ্রিম কোর্টে, যাতে অন্তত এই শিক্ষাবর্ষটুকু 'স্পেসিফিক্যালি নট ফাউন্ড টু বি টেন্টেড'-দের পড়ানোর জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হয়। নয়তো স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার খোলসটুকুকেও আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না বলে তাদের অভিমত। করণিক এবং গ্রুপ ডি কর্মীর অভাবও বস্তুত এই শিক্ষকরাই পূরণ করেন। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের আড়ালে স্কুল ক্লাস্টার এবং স্কুল মার্জারের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে সরকার ইতিমধ্যেই বন্ধ করে দিয়েছে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই ক্লাস্টার এবং মার্জার সম্পন্ন হলে পরবর্তীতে শিক্ষক নির্ভরতা অনেক কমবে। অনলাইন ক্লাস ক্রমশ গ্রাস করবে চক ডাস্টারের আন্তরিকতা। পরবর্তী নিয়োগ চলে যাবে বিশ বাঁও জলে এবং ক্রমশ এই ঘুণ ধরা, ভেঙে পড়া, খুঁড়িয়ে চলা ব্যবস্থার মৃত্যুযন্ত্রণার উপশম করে সম্পূর্ণ বেসরকারি পরিকাঠামোয় ঝাঁ চকচকে বেনিয়ারা খুলবে তাদের রংবেরঙের পসরা। যেখানে শিক্ষার মর্মবস্তু থাক না থাক মোড়কখানি হবে আকর্ষণীয়। কাঞ্চনমূল্যে কিনে নিতে হবে সেই শিক্ষা যা জল হাওয়া আলোর মতো অনিবার্য হওয়ার কথা ছিল। এই ভয়ংকর 'কালো রায়' যদি ফলপ্রসূ হয়, তাহলে দেশের যেকোনও প্রান্তে এইভাবেই যেকোনও সরকারি রক্ষাকবচ এবং সাংবিধানিক অধিকারকে তছনছ করে দেওয়া এখন সময়ের অপেক্ষামাত্র। শিক্ষার মতো লাভজনক ব্যবসায়িক উপকরণকে তাই বেসরকারিকরণের আওতায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়ায় এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়ংকর পদক্ষেপ ২৬,০০০ ছাঁটাই। একে প্রতিহত করতে গড়ে ওঠা শিক্ষক আন্দোলনের ওপর সরকার তার সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিকাশ ভবনের সামনে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম তার জঘন্যতম রূপ। বঞ্চিত চাকরিহারা মঞ্চের ডাকে আচার্য সদন ঘেরাওয়ের পর ডাক দেওয়া হয়েছিল বিকাশ ভবন অভিযানের। তাতে প্রশাসন নামিয়ে আনে হিংস্র পুলিশি নির্যাতন। শিক্ষক বিদ্রোহের তাপে বিকাশ ভবন অভিযান বিকাশ ভবন দখলে পর্যবসিত হলে পুলিশি লাঠিচার্জ শুরু হয় সন্ধে গড়াতেই। আহত হন প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষক শিক্ষিকা। রাতের অন্ধকারে গুন্ডাবাহিনী নামিয়ে ছত্রভঙ্গ করা হয় আন্দোলনকারীদের। হাসপাতালে আশংকাজনক অবস্থায় অনেকেই।

শিক্ষার ওপর এর থেকে বড় আঘাত ইতিপূর্বে এ রাজ্য প্রত্যক্ষ করেনি। মুখ্যমন্ত্রীর যোগ্য চাকরি হারা শিক্ষকদের পাশে থাকার আশ্বাস যে নিছক আশ্বাসই তা বারেবারে প্রমাণিত। সমস্যা অনেক গভীরে৷ জনমুখী, পড়ুয়াবান্ধব শিক্ষার আশা বিশ বাঁও জলে।

More Articles