১৫০ বছর আগে পাঁচ সঙ্গীকে খুন করে মাংস ভক্ষণ! এই ব্যক্তির কাহিনি নাড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্বকে

Colorado Cannibal: বেঁচেছিলেন তার পাঁচ সঙ্গীর মৃতদেহ খেয়ে। প্যাকার ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন কলোরাডো ক্যানিবাল।

খিদে। বাঁচার চরম জেদ আর চেষ্টা মানুষকে দিয়ে কী কী করিয়ে নেয়- কল্পনাতীত। তবে কল্পনাতে না আঁটলেও বাস্তবে এমন একাধিক ঘটনার নজির রয়েছে যেখানে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানুষ বেঁচে থেকেছে নরখাদক হয়ে। হ্যাঁ, মানুষই মানুষের মাংস খেয়েছে, হত্যা করে, জবাই করে। প্রায় দেড়শো বছর আগের একটি ঘটনা মানুষের মাংস খাওয়ার বিষয়টিকে প্রথম এমন ভয়াবহভাবে সামনে নিয়ে আসে। গল্পের মূল চরিত্র প্যাকার, নিজের সঙ্গীদের মৃতদেহ খেয়ে বেঁচেছিলেন যিনি। গল্পটির অবশ্য বেশ কয়েকটি সংস্করণ রয়েছে। তবে মূল কিছু তথ্যের বদল হয়নি কখনও। ১৮৪২ সালে পিটসবার্গের কাছে জন্ম প্যাকারের। ছোটবেলা থেকেই মৃগীরোগে ভুগতেন, আজীবন তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়েছিল ভয়ঙ্কর এই সমস্যাটি। গৃহযুদ্ধের সময় ইউনিয়ন সেনাবাহিনীতে যোগও দেন প্যাকার কিন্তু ঘন ঘন খিঁচুনি দেখা দেওয়ার কারণে তাঁকে বাহিনী থেকে বাদ দেওয়া হয়। যুদ্ধের পর প্যাকার বেরিয়ে পড়েন, ১৮৭৩ সালে আসেন উটাহে। সেই বছর শরতের শেষের দিকে তিনি দক্ষিণ-পশ্চিম কলোরাডোতে ২০ জন অভিযাত্রীর একটি দলে যোগ দেন। এই যাত্রার পরেই বদলে যায় প্যাকারের জীবন।

এই অভিযাত্রীদের দল বেরিয়েছিল সোনার খনির সন্ধানে। তবে প্রতিকূল আবহাওয়াতে ২০ জন আর এগোতে পারেননি, এগিয়েছিলেন ছয়জন— ইসরায়েল সোয়ান, জর্জ নুন, ফ্রাঙ্ক মিলার, জেমস হামফ্রে, শ্যানন উইলসন বেল এবং প্যাকার। রুক্ষ সান জুয়ান পর্বতমালায় পথ হারিয়ে বরফের মাঝেই আটকে পড়েন এই ছ'জন। শীত কেটে গেলে, এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে, ছয়জনের মধ্যে মাত্র একজন জীবিত অবস্থায় পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনিই প্যাকার। এতকাল বরফে কঠিন অবস্থাতে থেকেও দেহ তেমন ভেঙে পড়েনি, সঙ্গে ছিল বেশ পরিমাণ নগদ টাকা। মদ এবং জুয়ায় ১০০ ডলারের বেশিই উড়িয়ে ফেলেছিলেন তিনি এবং খাবারের প্রতি অদ্ভুতভাবে আগ্রহ ছিল না প্যাকারের। বাকি ভ্রমণ সঙ্গীদের সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে, প্যাকার এড়িয়ে যান প্রথমে। অবশেষে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি একাধিক পরস্পর বিরোধী স্বীকারোক্তি করেন, যা শুনে শিরশিরিয়ে ওঠে গা।

প্রায় ১৫০ বছর আগে কলোরাডোর সান জুয়ান পর্বতমালার নির্মম শীতে ঠিক কী ঘটেছিল এখনও নিশ্চিত করে বলা যায় না। শুধু জানা যায়, বেঁচেছিলেন একমাত্র আলফ্রেড প্যাকার। বেঁচেছিলেন তার পাঁচ সঙ্গীর মৃতদেহ খেয়ে। প্যাকার ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন কলোরাডো ক্যানিবাল।

আরও পড়ুন- ৫০ বছর আগে কোন ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিল আন্দিজে? আজও রহস্যময় যে ঘটনা

বাবা মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক মোটেই মধুর ছিল না আলফ্রেডের, কিশোর বয়সে মিনেসোটা এলাকায় চলে আসেন তিনি। সেখানে জুতো তৈরির কাজ করতে থাকেন। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় ইউনিয়ন সেনাবাহিনীতে যোগ দেন প্যাকার। আট মাস পরে, মৃগী রোগের কারণেই কাজ যায় তাঁর। এরপর তিনি আরও পশ্চিমে চলে যান এবং পরবর্তী নয় বছর ধরে অসংখ্য বিচিত্র চাকরি করেন। কিন্তু সমস্ত ক্ষেত্রেই মৃগীরোগটি হয়ে দাঁড়ায় বাধা। কোথাও সেভাবে তিষ্ঠোতে না পেরে উটাহ চলে যান প্যাকার।

১৮৭৩ সালের নভেম্বরে, ২০ জন ব্যক্তি কলোরাডোর সোনার খনির উদ্দেশ্যে রওনা হন। এই ২০ জন পুরুষ মূলত একে অপরের অপরিচিত ছিলেন। খনির উদ্দেশ্যে প্রায় ২৫ মাইল পাড়ি দেওয়ার পরে পথমধ্যে প্যাকারের সঙ্গে দেখা হয় তাঁদের। প্যাকার জিজ্ঞাসা করেন, তারা কোথায় যাচ্ছেন। এই পুরুষের দল সান জুয়ান পর্বতমালার সোনার দেশে যাচ্ছেন শুনেই দলের সঙ্গে যোগ দিতে চান প্যাকার। প্যাকারের কাছে কানাকড়িও নেই, সঙ্গে প্রয়োজনীয় সামগ্রীও নেই। তাই শুরুর দিকে দলে নিতে অস্বীকারই করেন ওই ব্যক্তিরা কিন্তু প্যাকার দাবি করেন যে তিনি একজন প্রসপেক্টর এবং গাইড। তিনি নাকি সান জুয়ান অঞ্চলটি হাতের তালুর মতোই চেনেন। এই মূল দলের সদস্যরা পরে বলেছিলেন, যাত্রাকালে প্যাকারকে লোভী, কিছুটা ভিক্ষুক গোছের, অলস এবং একগুঁয়ে বলেই মনে হয়েছিল তাঁদের। দলের সদস্য ফ্রাঙ্ক মিলারের সঙ্গে তার প্রতিনিয়ত ঝগড়া হতো বলেও জানা যায়। মাঝে মাঝেই খিঁচুনি দেখা দেওয়াতে দলে প্যাকারের উপস্থিতি ক্রমেই অন্যদের কাছে কঠিনতর সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছিল।

পথমধ্যে প্রবল শীত নামে, প্রচণ্ড তুষারপাতের মুখে পড়েন এই যাত্রীরা। দলটি শেষ পর্যন্ত পথ হারিয়ে ফেলে। সঙ্গের খাবার দাবার দ্রুত ফুরিয়ে যায়। ঘোড়ার খাবার খেয়ে কিছুকাল দিন কাটান সকলে। স্থানীয় উপজাতির কিছু মানুষের আশ্রয়েও কাটে কিছুদিন। উপজাতির মানুষরা তাঁদের এই অভিযান বসন্তকাল না আসা অবধি স্থগিত করার পরামর্শও দেন। তবে দলের একাংশ, এগারো জন ব্যক্তি এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেই দলের সঙ্গী হলেন প্যাকার। দেশটিকে ভালো করে চেনেন এবং শর্টকাট জানেন, এই দাবিতেই দলের সঙ্গে জুড়ে যান তিনি। তবে শেষমেশ ১১ থেকে দলে লোক কমে দাঁড়ায় মাত্র ৫। অথচ দলের সঙ্গীদের পর্যাপ্ত খাবার নেই, বরফে পরার জুতো নেই, ভারী পোশাক নেই। দু'টি রাইফেল, একটি পিস্তল, কয়েকটি ছুরি এবং ন্যূনতম গোলাবারুদ নিয়ে রওনা দেয় সেই দল। এর পর কী হলো তা খুব একটা স্পষ্ট নয়।

১৮৭৪ সালের ১৬ এপ্রিল প্যাকার একাই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসেন এবং কলোরাডোর সাগুয়াচের কাছাকাছি লস পিনোস ইন্ডিয়ান এজেন্সির কাছাকাছি এসে পড়েন। সঙ্গে তখন একটি রাইফেল, একটি ছুরি, একটি স্টিলের কফির পাত্র এবং একটি থলি। এমন অবস্থায় প্যাকারকে দেখে অন্য লোকজন তাঁকে কিছু খেতে দেয়। প্যাকার বমি করে দেন সঙ্গে সঙ্গে। প্যাকার জানিয়েছিলেন দীর্ঘকাল অনাহারের ফলে তার হজমশক্তি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। বেশ কয়েক পেগ হুইস্কি শট খাওয়ার পরে তিনি ওই লোকেদের নিজের ঘটনাটি খুলে বলেন। প্যাকার জানান, অভিযানে গিয়ে বরফের কারণে তিনি অন্ধ হয়ে যান এবং দলের বাকিদের থেকে পিছিয়ে যান। ইসরায়েল সোয়ান নামে দলেরই একজন সদস্য নাকি তাকে একটি রাইফেল দিয়েছিলেন। দলের বাকি লোকেরা যখন প্যাকারকে ছেড়ে চলে যায় তখন বেঁচে থাকতে শিকড় এবং কিছু ফুলের কুঁড়ি খেয়েছিলেন তিনি। অথচ বাকিরা দেখেন, এতদিন সামান্য এই খাবার খেয়েও প্যাকারের অবস্থা ততটা কঙ্কালসার নয়, ততটা অপুষ্টিতে ভোগা নয়।

পরে প্যাকারকে প্রশ্ন করা হতে থাকলে তিনি যা স্বীকার করেন, শুনে স্তম্ভিত হয়ে যান সকলে। প্যাকার জানান, প্রথম কিছুদিন শিকড়, পাইনের আঠা, গোলাপের কুঁড়ি এবং মাঝে মাঝে খরগোশের মাংস খেয়ে দিন কাটিয়েছিলেন তারা। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কারণে তারপর বন্যপ্রাণীও মেলা বন্ধ হয়ে যায়। খিদের জ্বালাতে যেন একে অপরকে খেয়ে ফেলাই বাকি ছিল স্রেফ! শুকনো কাঠ সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে যখন প্যাকার একদিন ফিরে আসেন, দেখেন ইসরায়েল সোয়ানের লাশ পড়ে আছে। লাশের চারপাশে চারজনকে দেখতে পান। সোয়ানকে মাথায় আঘাত করে খুন করা হয়েছিল। দলের সেই চারজন মিলে সোয়ানের দেহ থেকে মাংস আলাদা করতে থাকে, যোগ দেয় প্যাকারও। সোয়ানের কাছে কয়েক হাজার ডলার পাওয়া যায়, তা বাকিদের মধ্যে সমানভাগে ভাগ হয়ে যায়। সোয়ানের দেহের কিছু অংশ খেয়ে ফেলে তারা, কিছুটা নেওয়া হয় সঙ্গে। প্যাকার সোয়ানের রাইফেলটি সঙ্গে নিয়ে এগোতে থাকে দলের সঙ্গে। কিছুদিন পর ফের খাবার ফুরিয়ে আসে। দলের বাকিরা সিদ্ধান্ত নেয় মিলারকে হত্যা করে মাংস খাওয়া হবে। মিলারের নরম মাংসের জন্য সেই ছিল সকলের লক্ষ্য। একইভাবে মাথায় আঘাত করে মিলারকে হত্যা করে মাংস খাওয়া হয়। মিলারের কাছের টাকা ভাগ করে নেওয়া হয়। প্যাকার মিলারের ছুরিটি সঙ্গে নেয়।

আরও পড়ুন- বাংলার বীভৎসতম হত্যা! টিকিট কেটে ১৮৭৩ সালের পরকীয়া মামলার শুনানি দেখেছিল মানুষ

শীত তবু ফুরোয় না, অনন্ত বরফ ফুরোয় না। হামফ্রেকেও একইভাবে হত্যা করে মাংস খাওয়া হয়। জর্জ নুন এবং বেল পরস্পরকে না খাওয়ার শপথ করেন। শপথ করেন এই ঘটনা কোনওদিন কাউকে না বলার। তবে খিদের জ্বালা আর অসহনীয় পরিস্থিতিতে কোনও শপথই দীর্ঘমেয়াদি নয়। বেল একদিন রাইফেল দিয়ে প্যাকারকে খুন করতে ছোটে, প্যাকার নিজেকে বাঁচিয়ে ফেলেন, খুন করেন বেলকে। বেলকে কেটে মাংস আলাদা করেন। যতটা সম্ভব খেয়ে ফেলেন, বাকিটা নিয়ে রওনা দেন। পরে বেলের মাংসের অবশিষ্ট অংশগুলি দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন প্যাকার। ভেবেছিলেন পশুতে খেয়ে ফেলবে। তবে পরে তিনি স্বীকার করেন, মানুষের মাংস তাঁর ভালো লেগেছে এবং স্তনের চারপাশের অংশ বিশেষভাবে সুস্বাদু বলে মনে হয়েছে তাঁর।

পরে ওই জায়গায় একইসঙ্গে ৫ জনের দেহ মেলে। চারজনের মাথার খুলি ভাঙা, একজনের মাথা নেই এবং সবগুলো দেহেরই মাংস কাটা হয়েছে। অর্থাৎ এই পুরুষদের একই জায়গায় একসঙ্গেই মারা হয়েছিল। আদালতে প্যাকার আত্মরক্ষায় খুনের দাবি তুললেও তা খারিজ হয়ে যায়। দণ্ডিত করা হয় প্যাকারকে, কিন্তু পালিয়ে যান তিনি। নয় বছর পরে দেখা যায়, জন শোয়ার্টজ নাম নিয়ে ওয়াইমিংয়ে বসবাস করছেন প্যাকার। ফের তাঁর বিচার বসে। ফাঁসির সাজা ঘোষণা হলেও পরে ৪০ বছরের কারাদণ্ড হয়। পনেরো বছর সাজাভোগের পর মুক্তি পান তিনি। ১৯০৭ সালে মারা যান প্যাকার।

More Articles