৫০ বছর আগে কোন ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিল আন্দিজে? আজও রহস্যময় যে ঘটনা

Andes Plane Crash: ৫০ বছর পূর্ণ হলো আন্দিজ বিমান দুর্ঘটনার। যার ভয়াবহতা শুনলে আজও আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম সীমান্ত। সীমান্তজুড়ে প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে সুদীর্ঘ আন্দিজ পর্বতমালা। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল এবং দক্ষিণ আমেরিকার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এই আন্দিজে গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের লীলাভূমি, যা একে করেছে অনন্য এবং অসাধারণ। এছাড়াও এই অঞ্চলজুড়ে জীববৈচিত্র্য এবং উদ্ভিদজগতের এক অপূর্ব সমাহারের দেখা মেলে। এই আন্দিজেই গড়ে উঠেছিল ইনকা সভ্যতা। রহস্য-রোমাঞ্চ এই আন্দিজের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে আছে। বিপুলা এ পৃথিবীর আমরা কতটুকুই বা জানি। নিজের মধ্যে কতই না রহস্য সে লুকিয়ে রেখেছে। শুধু প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য নয়, অন্য অনেক কারণেই এই পর্বতমালা বারবার শিরোনামে উঠে এসেছে। যেমন, ১৯৭২ সালের বিমান দুর্ঘটনা। ১৯৭২-২০২২, ঠিক ৫০ বছর পূর্ণ হলো আন্দিজ বিমান দুর্ঘটনার। আসলে ঠিক কী হয়েছিল ১৯৭২ সালের ওই রাতে? যার ভয়াবহতা শুনলে আজও আমরা চমকে উঠি, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

আন্দিজ বিমান দুর্ঘটনার ইতিহাস
১৯৭২ সালের ১৩ অক্টোবর। আন্দিজ পর্বতের বুকে আছড়ে পড়েছিল একটি বিমান। ফ্লাইট নাম্বার ৫৭১। রাগবি খেলার জন্য চিলি যাচ্ছিল উরুগুয়ে রাগবি দল ওল্ড ক্রিশ্চিয়ানস এবং তাদের বন্ধুবান্ধব ও সমর্থকরা। কিন্তু হঠাৎই একটা ভয়াবহ শব্দ করে বিমানটা আন্দিজ পর্বতের ওপর ভেঙে পড়ল। শেষ হয়ে গিয়েছিল কয়েকটি তরতাজা জীবন। যাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নিয়েছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকা-য় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় তেমনই এক অভিজ্ঞতার কথা।

ফ্লাইট ৫৭১-এর যাত্রী ছিল রবার্ত। সেবার মোট ৪০ জন যাত্রী ও ৫ জন ক্রু নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল বিমানটি। গান-গল্প-হইহুল্লোড় করে ভালোই কাটছিল। এমন সুন্দর সময়ে, এত অল্প বয়সে, পায়ের নিচে থাকা দুধসাদা বরফের কোলে এমন কোনও বীভৎস অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে, সেটা ভুলেও মাথায় আসেনি কারও। বিমানের জানলা দিয়ে বাইরে দেখছিলেন রবার্ত। হঠাৎ মনে হলো, বিমানের ডানাদুটো যেন বরফে ঢাকা আন্দিজের চুড়োর খুব কাছে। রবার্তের কথায়, "বুঝতে পারছিলাম আমরা আকাশের থেকে অনেকটাই নিচ দিয়ে যাচ্ছি।"

আরও পড়ুন: মাটির নিচে ন’দিনের বিভীষিকা! সিনেমার সাসপেন্সকে হার মানাবে সেই কিশোরীর লড়াই

প্রথমে তাঁরা ভেবেছিলেন, হয়তো খারাপ আবহাওয়া। তারপর হঠাৎই একটা ভয়াবহ শব্দ করে বিমানটা আন্দিজ পর্বতের ওপর ভেঙে পড়ল। ধাতব কিছু একটা ওপর থেকে প্রচণ্ড শব্দ করে ঘুরতে ঘুরতে নিচে নেমে এলে যেমন হয়, ঠিক তেমনই মনে হচ্ছিল। যেন ভয়াবহ একটা ঘুর্ণিঝড়ের মুখে এসে পড়েছে। পাহাড়ের ঢাল ধরে বিমানটা স্লেজগাড়ির মতো নেমে আসছিল। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে পর পর সবক'টা আসন যাত্রীদের নিয়েই উপড়ে আসতে লাগল সামনের দিকে।

সব যখন শান্ত হলো, তখনও বোঝেননি রবার্ত, আদৌ বেঁচে আছেন কি না! সহযাত্রীদের কান্না আর আর্তনাদে আশেপাশের বাতাস ভারী। বিমানের অধিকাংশ অংশই ভেঙে পড়েছে। বরফ-সাদা পাহাড়ের অংশ দিব্যি দেখা যাচ্ছে আশেপাশে। হিম-ঠান্ডা হাওয়া এসে ধাক্কা দিচ্ছে। বাইরে তখন তাপমাত্রা মাইনাস ১০ ডিগ্রির নিচে। আর বিমানের ভেতরে তাপমাত্রা প্রায় ৭৫ ডিগ্রি। একসময় মনে হয়েছিল, যেন ওই রাতটাই তাঁর জীবনের শেষ রাত। দুঃস্বপ্নের ভেতর যেন জেগে রয়েছি বাস্তবটাকে জানব বলে। বিমান থেকে তার ছিঁড়ে ঝুলছে। দুর্ঘটনায় কেউ মারা গিয়েছেন, কেউ গুরুতর আহত, কেউ বা কোমায়। যা খাবার ছিল, ক্রমশ তা ফুরিয়ে এল।

এরপর শুরু হয় আসল ঘটনা। এই দুর্ঘটনার দশ দিনের মাথায় ট্রানজিস্টর মারফৎ খবর আসে যে, তাঁদের উদ্ধার করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তবে সময় লাগবে। কিন্তু ততদিনে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার ওপর খাবার নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর খাবারের অভাবে আরও লোক কমে আসতে লাগল। সেই সঙ্গে পর্বতের প্রবল ঠান্ডা। রবার্টের কথায়, "মনে হচ্ছিল, আমরা যেন অন্য কোনও গ্রহের প্রাণী।" বেঁচে যাওয়া আরেক যাত্রী পেদ্রো আলগারতো-র কথায়, “আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বেঁচে থাকা। কিন্তু আমাদের কোনও খাবার ছিল না। প্লেন থেকে জমানো খাবার কিছু পেয়েছিলাম, সেটাও অনেক আগের কথা। আর কিছুদিন পর যখন আমাদের শরীর অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়তে লাগল, তখন আমরা বুঝলাম যে, আশপাশে খাওয়ার মতো কোনও শাক কিংবা একটি পোকাও ছিল না।"

এরপর নিজেদের মধ্যে 'ভয়াবহ' চুক্তি করলেন তাঁরা। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, যাঁরা আগে মারা যাবেন, তাঁদের মাংস খেয়ে বাকিরা বেঁচে থাকবেন! হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। আর তা বাস্তবায়িতও হলো। যে সঙ্গীটি প্লেনের পাশের সিটে বসেছিলেন, মারা যাওয়ার পর অবস্থার চাপে পড়ে তাঁরই মাংস খেতে হয়েছিল। একমাত্র আশা ছিল, কেউ না কেউ, কোনও না কোনও দিন হয়তো তাদের খুঁজে বের করবে। মৃত্যুর আগে কিংবা পরে তাঁরা ফিরে যাবেন মানুষের কাছে।

২৩ ডিসেম্বর, বিমান দুর্ঘটনার ৭২ নম্বর দিনে অবশেষে সাহায্য আসে। মোট ১৬ জন মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হয়। রবার্তদের জীবিত অবস্থায় পাওয়া যাবে, তা হয়তো ভাবেননি কেউই। কিন্তু, ওই দীর্ঘ ৭১ দিন সত্যি কি একদল মানুষ নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য নরখাদকে পরিণত হয়েছিল?

মানুষ থেকে নরখাদক হয়ে ওঠার কাহিনি
কথায় আছে, খিদে পেলে বাঘ নাকি ঘাসও খায়। কিন্তু কতটা খিদে পেলে মানুষ নিজের স্বজাতির শরীরের মাংস খেতে পারে? কোনও মানুষ কি আদৌ তা পারবে? খিদে পেলে কোনও কিছু খাওয়া মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আর এই সহজাত প্রবৃত্তির কাছে হার মেনে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে মানুষের শরীরের মাংস কেটে খেতে বাধ্য হয়েছিলেন আন্দিজ পর্বতের বিমান দুর্ঘটনার যাত্রীরা। কিন্তু কতটা সত্যি এই নরখাদকের কাহিনি। একটি প্রতিবেদনে পেদ্রো জানিয়েছেন, "বাঁচার জন্য স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়েও লড়তে হয়েছিল। খিদের মুখে বরফের মধ্যে পড়ে থাকা বন্ধুদের মৃতদেহ থেকে খাবলে নেওয়া মাংস একটা ধাতব পাতে রেখে ঝলসে খেয়ে বেঁচেছিলেন ক'জন মানুষ।" শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাড়নায় সমস্ত রকম সংস্কার-কুসংস্কারের বেড়া টপকে গিয়েছিলেন রবার্ত-পেদ্রোরা। রবার্তের কথায়, "সেসময় এমন কাজ করেছি যা হয়তো মানুষের পক্ষে দুঃসহ।"

Andes Plane Crash

সত্যিই পরস্পরের মাংস খেয়ে বেঁচে ছিলেন ওঁরা

স্বজাতি-ভক্ষণ মানবসভ্যতায় কখনওই স্বীকৃতি পায়নি। মানুষ এমন বীভৎস ঘটনাকে স্থান দেয়নি নিজেদের মধ্যে। তবে বাধ্য হয়ে একটা সময় পেদ্রোকে সেটাই করতে হয়। তাঁকে সঙ্গ দেয় বাকীরাও। আন্দিজ বিমান দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা আরেকজন হলেন র‍্যামন সাবেলা। যুক্তরাজ্যের টাইম ম্যাগাজিনকে তিনি বলেছিলেন— "অবশ্যই মানুষের মাংস খাওয়ার ধারণাটি ছিল ভয়ানক ও ঘৃণ্য। মাংসগুলো মুখে নেওয়াই কঠিন ছিল। কিন্তু আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।" ওই দুর্ঘটনায় জীবিতরা প্রথমে মৃতদের চামড়া খেতে শুরু করেছিলেন। এরপর চর্বি, মাংসপেশি এবং সর্বশেষ মানুষের মস্তিষ্কও খেয়েছেন। এই বিষয়ে সাবেলা বলেন, "এক দিক থেকে, আমাদের বন্ধুরাই বিশ্বের প্রথম অঙ্গদাতা। কারণ তারাই আমাদের পুষ্টি জুগিয়ে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছে।"

কিন্তু কীভাবে পেরেছিলেন তাঁরা? মানসিক দৃঢ়তা ও বেঁচে থাকার জন্য হন্যে হয়ে স্বজাতি-ভক্ষণকেই নিজেদের বেঁচে থাকার পিছনের কারণ বলে মনে করেন ক্যানেসা ও পেদ্রো। নিজেদের অতীত নিয়ে কি তাঁরা ক্ষমাপ্রার্থী? কখনও কি মনে হয় যে এমনটা করে অপরাধ করে ফেলেছেন? এর উত্তর নিয়েও আছে ভিন্ন মত।

যেমন রবার্ত ক্যানেসা মন থেকে কখনওই সেই কালো অধ্যায়কে তাড়াতে পারেননি। সবাই অনেক সহজভাবে তাঁদের আপন করে নিলেও যে সঙ্গীদের শরীর থেকে মাংস খেয়েছিলেন তাঁরা, তাঁদের পরিবারের কাছে সবসময় নিরুত্তর থাকতে হবে বলে ভাবেন তিনি। আবার পেদ্রো আলগোরতার ভাবনাটা অন্যরকম। তার মতে, "পুরো ব্যাপারটিই ক্ষমা চাওয়ার আর না চাওয়ার অনেক উর্ধ্বে।" তাঁর মতে, সেসময় নিজেদের ইচ্ছায় কিছু করেননি তাঁরা। এটা অনেকটা যেন স্বাভাবিকভাবেই ঘটে যাওয়া। "কেউ যেন বলে দিচ্ছিল যে, তোমাকে এটা করতে হবে।" ৬৬ বছর বয়স্ক পেদ্রো তাই ব্যাপারটিকে আর দশটা ক্যানিবালিজম বা স্বজাতি-ভক্ষণের উদাহরণের মধ্যে ফেলেন না। শুধু তা-ই নয়, নিজের সেই সময়ের সেই অনুভূতিগুলোকেও খুব একটা মনে করতে চান না বলেই জানান পেদ্রো।

দুর্ঘটনার বীভৎস সেই দিনগুলো পার হয়েছে অনেক বছর আগে। তবে সেসব কখনওই মনে করতে চাননি তিনি। দুর্ঘটনার অনেক বছর পর হুট করেই ভাবেন পেদ্রো, নিজের অভিজ্ঞতাকে লিখে রাখবেন। আর তারপরেই ১৯৭২ সালের সেই গা শিউরে ওঠা অভিজ্ঞতাগুলোকে একটু একটু করে লিখতে থাকেন তিনি। লিখে ফেলেন বই- 'ইনটু দ্য মাউন্টেইনস'। নিজের নির্মম আর অবিশ্বাস্য সেই ৭১ দিনের বেঁচে থাকার গল্প বলেন পুরো পৃথিবীকে। গল্পটা কেবল পেদ্রো আলগারতো-র একার নয়। এই গল্পে ছিলেন আরও ১৬ জন মানুষ, যাঁরা শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে পেরেছিলেন মানবসভ্যতায়। এই ১৬ জনের একজন রবার্তো ক্যানেসা নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন 'আই হ্যাড টু সারভাইভ' নামের বইতে। এছাড়া ১৯৯৩ সালে এই ঘটনাকে ভিত্তি করে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র 'অ্যালাইভ'।

অনেকের পরিবার বিশ্বাস করতে চায়নি প্রথমে যে, তাঁদের কেউ মানুষের মাংস খেয়েছে। তবে ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে পেরেছে। পেদ্রো নিজেও মনে করেন যে, ব্যাপারটি খুব দ্রুত বুঝে ফেলার মতো নয়। ক্যানেসা-র জন্য ব্যাপারটি খুব দুর্ভাগ্যজনক, লজ্জার ও কষ্টের। তবে পেদ্রোর জন্য একেবারেই তা নয়। "সেদিন মানুষের মাংস না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে আজ আমি এখানে থাকতাম না”, এটা বলে নিজের কাজের প্রতি সম্মতি জানিয়ে কথা শেষ করেন পেদ্রো। সত্যিই কি ঠিক ছিলেন তিনি, না কি নয়? এর বিচার বোধহয় এত সহজ হবে না।

More Articles