সুরকার যখন গল্প বলেন || এ আর রহমান এক উত্তরণের পথযাত্রী

A. R. Rahman Birthday: ১৯৯২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছায়াছবি 'রোজা'-র সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তাঁর জয়যাত্রা শুরু।

এ. আর. রহমান- শুধু এই নামটা স্মরণে এলেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে কয়েকটি মন ভরানো শব্দ- উৎকর্ষ, পূর্ণতা, গুণ| তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি সারা পৃথিবীর দরবারে দেশকে গর্বিত করেছেন বিগত কয়েক দশক ধরে। তিনি এমন একজন সুরকার যার সৃষ্টি ভারত তথা বিশ্বের সঙ্গীতপ্রেমীদের ভালোবাসায় স্নিগ্ধ করেছে, আবেগে মথিত করেছে, আশা ও উদ্দীপনায় ভরপুর করেছে। ১৯৯২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি 'রোজা'-র সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তাঁর জয়যাত্রা শুরু। ছবিটির গানগুলি প্রকাশিত হওয়ার পরে সঙ্গীত রসিকরা বলতে শুরু করেন, এমন অভিনবত্বে ভরা নিটোল সুর, কম্পোজিশনের এমন মাধুর্য্য অনেকদিন পর আস্বাদ করা গেল। তাঁর সৃষ্টি সুরের বর্ণ তারপরেই বইতে থাকল। হিন্দি ও দক্ষিণ ভারতীয় চলচিত্র জগতে তাঁর একের পর এক সুর দেশকে মুগ্ধ করল। প্রায় দেড় দশক আগে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি 'স্লামডগ মিলিওনেয়ার'-এ তাঁর অপূর্ব সুর দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর জন্য রাজমুকুট এনে দিল। তিনি দুটি অস্কার অ্যাওয়ার্ড অর্জন করলেন। এত বড় আন্তর্জাতিক সম্মান লাভের আনন্দ ভারতবাসীকে আবেগে আপ্লুত করল। 'লগান' ছবিতে তাঁর সুরারোপিত গানগুলি আজও নতুন বলে মনে হয়, মন দিয়ে শোনার আগ্রহ জাগায়। তাঁকে যে 'The Mozart of Madras' বলা হয় তাতে বিন্দুমাত্র অতিশয়োক্তি নেই। ইউরোপের অবিস্মরণীয় সুর সৃষ্টিকারী মোজার্টের সিম্ফোনিগুলি আজও যেমন সঙ্গীত বোদ্ধাদের ভাবায়, রহমানের সৃষ্টির স্নিগ্ধতা ও গভীরতাও তেমন করে সঙ্গীত প্রেমীদের বিস্মিত করে।

স্রষ্টা হিসেবে তাঁর অনন্য উৎকর্ষ, তাঁর সৃষ্টির স্বাধীনতার আকাশকে আরও প্রসারিত করেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তিনি বেশ কিছু হলিউডের ছবিতেও সঙ্গীত পরিচলনা করেছেন। 'পেলে' নামক একটি দক্ষিণ আমেরিকান ছবিতেও তিনি সুরারোপ করেছেন। এরপর মজিদ মজিদি পরিচালিত একটি ইরানি ছবি, 'Muhammad : The Messanger of God'-এ সুর দিয়েছেন। 'The Flying Lotus' নামে একটি সিম্ফোনি সৃষ্টি করেছেন। আমাজন প্রাইম ভিডিওর জন্য একটি হারমোনি বানিয়েছেন যার উপজীব্য বিষয়, 'রহমানের চোখে ভারতীয় সঙ্গীত সাধনার অতীত ও ভবিষ্যৎ'। অসংখ্য কনসার্টও তিনি কম্পোজ করেছেন। সৃষ্টির বিচিত্র পথে তাঁর এই যে যাত্রা, তার সুযোগ যে তিনি কোনওদিন পাবেন তা তাঁর ভাবনার অতীত ছিল। কিন্তু যে কাজেরই সুযোগ তিনি পেয়েছেন সেই কাজটিকে তিনি অন্তর থেকে ভালবেসে শ্রদ্ধার সঙ্গে করেছেন। তাই আনন্দও পেয়েছেন প্রচুর, নজরুলের কবিতা, থেকে ধার করে বলতে হয় 'সৃষ্টিসুখের উল্লাস'।

এর মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চয় এবং নিজেকে প্রমাণিত করতে পারার সুযোগ। এই যাত্রাপথে তিনি পল এলেন, কুয়েন্টিন ট্যারেন্টিনো, মাইক জ্যাগার, জোশ স্টোন, ডেভ স্টুয়ার্ট এবং ডেমিয়ান মারলের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁকে রকস্টার বলে স্বচ্ছন্দেই সকলে স্বীকার করেছে।

কিন্তু এত সাফল্য, এত স্বীকৃতি, এত খ্যাতি তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে থামতে দেয়নি। তিনি উপলব্ধি করেছেন, ভারত পরিবর্তিত হচ্ছে আর সেই পরিবর্তনশীল দেশের সঙ্গী হওয়া দরকার, অংশ হওয়া দরকার। বিপুল প্রতিষ্ঠা লাভের পরে, তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা ও মন্তব্য করাকে তিনি নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর বলে মনে করেন। কিন্তু তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দেশে ফিরে আসা, দেশের মানুষের আশা-নিরাশার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা, দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা, যার কাহিনির মধ্যে এবং বক্তব্যের মধ্যে মানবিকতার ছাপ থাকবে, মানবমনের স্পন্দন ধরা পড়বে। এইরকম তাগিদই তাকে চালিত করেছে ‘99 Songs' নামের  চলচ্চিত্র নির্মাণে।

কিছুদিন আগে এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, দু'টি অস্কার অ্যাওয়ার্ড কি তাঁকে আরও আরও প্রত্যাশার চাপে ভারাক্রান্ত করে ফেলেছে? প্রশ্নের জবাবে তিনি স্মিত হেসে বলেছিলেন, "জীবনে যে কোনও বিষয়কে আপনি ভার অথবা আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। এমনটাই বলা হয়ে থাকে। অখ্যাতি ছাড়া কখনও খ্যাতি আসে না। এক মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু বদলে যেতে পারে। কিন্তু আপনাকে যা দেওয়া হয়েছে সেটি আপনাকে সঠিক পথে সদ্ব্যবহার করতে হবে। আমার ক্ষেত্রে, আমার জীবনের যে কোনও বিষয়ে, জলের গ্লাসটি অর্ধেক পরিপূর্ণ। আমি চিরকাল বিশ্বাস করে এসেছি যে চরমতম বিপদের মধ্যে থেকেও আমাদের কিছু শিক্ষা গ্রহণ করার থাকে এবং সেই অনভিপ্রেত বিষয়টির মধ্যেও কিছু মঙ্গলদায়ক বস্তু লুকিয়ে থাকে। আমার শিল্পী জীবনের সূচনা পর্ব থেকেই আমি সেই সঠিক কাজটি করে এসেছি | আমি মনে করি এটাই আমাকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছে | নিজের কাজে যতক্ষণ না সন্তুষ্ট হচ্ছি ততক্ষণ কাজে লেগে থাকি। আমার কাছে এটা আসলে আমার বোধ এবং আমার হৃদয়ের এক লড়াই। ...একটা ব্যাপারে আমি সচেতন, পৃথিবীতে পছন্দ করার মতো এত বিষয় থাকতে মানুষ কেন আমার সঙ্গীত কান পেতে শুনবে? সেই কারণে আমি নিজেকে বার বার প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাই। কোন কাজ, কোন সৃষ্টি, মানুষকে ব্যাপৃত রাখবে? সঙ্গীতের মধ্যে কোন গুণ থাকলে মানুষ আগ্রহে শুনবে? আমি সব সময় নিশ্চিত করি যাতে আমার সঙ্গীত সব অর্থে পরিপূর্ণ হয় এবং মানুষের ভাবনার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তবে একথাও ঠিক যে আমার সৃষ্টি মানুষের কাছে পৌঁছনোর পর তারা কীভাবে সেটিকে গ্রহণ করবেন, তার উপর আমার কোনও হাত থাকে না।"

এই ভাবনাকে মাথায় রেখেই তিনি '99 Songs' ছবিটি নির্মাণ করেছেন। এ এক নতুন রণক্ষেত্রে তাঁর সাহসী পদক্ষেপ। এই ছবি নির্মাণ করতে গিয়ে তাঁকে গল্পকার, প্রযোজক, কম্পোজার নানা ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হতে হয়েছে। যেকোনও গানের মধ্যে একটা গল্প লুকিয়ে থাকে। সুরকারের কাজ হলো, সেই গল্পকে সুরের মধ্যে দিয়ে জীবন্ত করে তোলা। তাঁর গল্পকার হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "অনেক চিন্তা করে আমি দেখেছি যে গল্প বলা একটি উন্নত শিল্প। জীবনে পৃথিবীর বহু প্রান্তে ঘুরেছি, অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। তাই আমার মনে হয়েছে যে আমার ভেতরে অনেক গল্প জমা হয়েছে... যা আমি মানুষকে শোনাতে চাই। এই ভাবনা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, একটা অন্য ভুবনকে দেখতে এবং আমার নিজের মতো করে তার গল্প শোনাতে।"

'99 Songs' এই ছবিটি যাতে পৃথিবীর মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, শ্রবণযোগ্য হয় সেটি সুনিশ্চিত করার জন্য রহমান ছবিটির প্রতিটি দিক নিজে এবং সহকারীদের নিয়ে ২৫ থেকে ৩০ বার পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখেছেন, নতুন করে ভেবেছেন এবং পরিমার্জনা করেছেন। ছবিটির অনেক রেকর্ডিং বুদাপেস্টে হয়েছে। তাঁর কথায়, "আমাদের কাজের সামনে একটা 'উচ্চ মান' স্থির হয়ে গিয়েছিল। আমরা কাজটা সততার সঙ্গে, নিষ্ঠার সঙ্গে করেছি | আশা করব, ছবিটির মর্মকথা মানুষ খুশি মনে গ্রহণ করবেন।"

 

তথ্য সূত্র : সংবাদপত্র

More Articles