ঘরপালানো গানক্ষ্য়াপার ভক্ত স্বয়ং হৃত্বিক রোশন! শাকিলের গল্পটা হাজার ছেলেমেয়েকে স্বপ্ন দেখাবে

অত্যন্ত সাধারণ একটি স্ট্রিট পারফরম্যান্স। জনৈক এক শিল্পী হাতে একটা সাধারণ মানের গিটার নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাইছেন কিংবদন্তি কুমার শানুর জনপ্রিয় গান, 'যব কোই বাত বিগর জায়ে'। ইতিউতি মানুষজন হাততালিতে ভরিয়ে দিচ্ছেন তাঁকে। অনেকে তাঁর গান রেকর্ড করছেন মুঠোফোনে, তো অনেকে গলা মেলাচ্ছেন তারই তালে তালে; যেরকমটা সাধারণত হয়ে থাকে আর কি। কিন্তু, কে জানত এই একটি স্ট্রিট পারফরম্যান্স একদিন জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে ওই গায়কের; করে তুলবে স্বয়ং হৃত্বিক রোশনের প্রিয় পাত্র! 

৯ অক্টোবর ২০২১, বিকেল সাড়ে পাঁচটা, মুম্বইয়ের মীরা রোডের বাসিন্দা বছর চব্বিশের একটি দোহারা চেহারার ছেলে হাতে একটা গিটার আর ছোট্ট একটা মিউজিক সেটআপ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন স্বপ্নকে ছোঁয়ার লক্ষ্য নিয়ে। মীরা রোড থেকে এসে পৌঁছলেন মুম্বইয়ের অন্যতম অভিজাত এলাকা আন্ধেরির ভারসোভা অঞ্চলে। সেখানেই প্রতিদিন বিকেলে তিনি স্ট্রিট পারফরম্যান্স করেন। এই পারফরম্যান্স করে যা টাকা ওঠে তা নিয়ে নিজের মিউজিক স্কুলের মাইনে দেন। কিন্তু গান শুরু করার আগে, হয়তো নিজেও জানতেন না এই একটি পারফরমেন্স তার জীবন সম্পূর্ণ পাল্টে দিতে চলেছে। 

অক্টোবরের একটি শান্ত শনিবারের বিকেলে জুর্ম(১৯৯০) সিনেমার কুমার শানুর গাওয়া 'জব কোই বাত বিগর জায়ে' গানটি শুরু করতেই সাধারণ মানুষের ঢল নামল। অনেকেই তার গান রেকর্ড করতেও শুরু করেন নিজের মোবাইলে। তার মধ্যেই অঙ্কিত নামের এক ব্যক্তি সেই গান রেকর্ড করে তা আপলোড করে দিলেন সোশ্যাল নেটওয়ার্ক টুইটার এবং ইনস্টাগ্রামে। ব্যাস্! মুহূর্তের মধ্যেই সেই গান হয়ে গেল ভাইরাল! ইনস্টাগ্রাম এবং টুইটারের পর ফেসবুক এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মেও দারুন জনপ্রিয়তা পেল গানটা।

দেখুন সেই পারফরম্যান্স

 
 
 
 
 
View this post on Instagram
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

A post shared by Shakeel (@shakeel.music)

 

পরদিন ঘুম ভাঙল লাগাতার ফোন কলে। মোবাইলের নেটওয়ার্ক অন করতেই উপচে পড়তে শুরু করলো নোটিফিকেশন। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টেও ব্যালেন্স বেড়ে গিয়েছে অনেকটাই। এক রাতের মধ্যেই  রোজগার হয়েছে ৭০,০০০ টাকা। সবটা বুঝে ওঠার আগেই নজরে এল একটি বিশেষ মেসেজের নোটিফিকেশন। আর সেই মেসেজটি করেছেন স্বয়ং বলিউডের গ্রিক গড হৃত্বিক রোশন! হৃত্বিক লিখেছেন, 'তুমি অসাধারণ! তোমার গান আমাকে মুগ্ধ করেছে।'

সঙ্গীতশিল্পী সোনু নিগম এবং অভিনেতা কুনাল কাপুরও তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তখনও বুঝতে পারেননি কী ভাবে এসব হলো। তারপর ইনস্টাগ্রামটা খুলতেই সে একেবারে হতবাক। সোশ্যাল মিডিয়াতে রীতিমতো ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর গান। তিনি তখন আর আর কর্ণাটকের চিত্রদূর্গের একটা সাদামাটা ছেলে নন, যে নিজের মিউজিক স্কুলে পড়ার স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মুম্বইতে। সেই ছেলেই হয়ে গিয়েছে একজন সোশ্যাল মিডিয়া সেনসেশন, যাকে সবাই একডাকে চেনে শাকিল বলে।

একটি সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, "মানুষ প্রায় সময়েই আমার গান মোবাইলে রেকর্ড করে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করতো। আমার বিষয়টা খুব ভালো লাগত প্রথম থেকেই। আমার গান শুনে কারো ভালো লাগছে, কেউ সময় নিয়ে আমার গলায় গাওয়া গান তার নিজের প্রোফাইলে আপলোড করছে, বিষয়টা আমার খুব প্রিয়। কিন্তু, এবারের অনুভূতিটা একদম আলাদা রকমের। আমি বিগত ৩ কি ৪ দিন ধরে আমার মিউজিক স্কুলের মাইনে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছিলাম, আমি কাজের সন্ধানে একাধিক জায়গায় ঘুরেছি, অনেকের সঙ্গেই কথা বলেছি। বাবা-মাও আমার বেশ ক্ষুব্ধ ছিলেন, কারণ আমি শুধুমাত্র আমার প্যাশন ফলো করবো বলে নিজের পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে কলেজ ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ছেড়ে মুম্বাইয়ে এসে রয়েছি। তাই আমার জন্য এই জিনিসটা সম্পূর্ণ অন্য রকম একটা ভালোলাগার জায়গা।"

ছোট বয়স থেকে গান গাওয়া শুরু হলেও শাকিলের তেমন কোনও পুঁথিগত সংগীত শিক্ষা ছিল না। তাঁর বাবা নিজে একজন লরিচালক, মা একজন গৃহবধূ। তার পরিবারের সঙ্গে সংগীত বিষয়টি অনেকদিন ধরে জড়িয়ে থাকলেও, পেশাগতভাবে সংগীতকে গ্রহণ করাকে তাদের বাড়িতে খুব একটা কোনোদিনই সমর্থন করা হয়নি। স্বভাবতই দ্বাদশ শ্রেণীর পর শাকিলের বাড়ি থেকে তাকে একটি কম্পিউটার ডিগ্রী কোর্স পড়ার জন্য ভর্তি করে দেওয়া কর্নাটকের স্থানীয় একটি কলেজে। কিন্তু কম্পিউটারের মত একটি কঠিন কোর্স নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য কিছুটা হলেও তাঁর সংগীত নিয়ে ক্যারিয়ার তৈরি করার স্বপ্ন অনেকটাই ব্যাকফুটে যাওয়া শুরু করেছিল। তাই তার কাছে তখন বাকি শুধু মাত্র একটাই রাস্তা, কলেজের পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে শুধুমাত্র গান নিয়েই পরিশ্রম করতে হবে।

সংগীতশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ২০১৮ সালে শাকিল চলে আসেন বেঙ্গালুরুতে। বিপিও তে টেলিকলার হিসেবে কাজ করা থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্টের একজন কর্মী, গান নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য টাকা রোজগার করতে  যে কোন কাজ করতে রাজি ছিলেন। তারপরেই তার কাছে আসে জীবনের প্রথম ব্রেক। বেঙ্গালুরুর একটি স্থানীয় মিউজিক স্কুলে সহকারী সঙ্গীত শিক্ষকের চাকরি পেলেন শাকিল। সেই চাকরির মাইনেও ছিল মোটামুটি বেশ ভালোই। সহকারি সংগীত শিক্ষক হিসেবে বেশ কয়েক বছর কাজ করে সেই টাকা জমিয়ে  কিনে ফেলেন নিজের জন্য একটি মিউজিক সেট আপ। আয়ারল্যান্ডের একজন স্ট্রিট সিঙ্গার অ্যালি শার্লকের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে স্ট্রিট পারফরম্যান্স করতে শুরু করেন শাকিল। তবে, বেঙ্গালুরুতে স্ট্রিট পারফরম্যান্স করতে গিয়ে প্রথমেই হোঁচট খেতে হয়েছিল।

একটি সাক্ষাৎকারে শাকিল বলছেন, 'স্ট্রিট পারফরম্যান্স করতে গিয়ে আমি প্রথমে ব্যাঙ্গালুরুতে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হলাম। প্রথমদিকে কেউই আমার গান শুনত না। তারপরে আমার ভাই ড্যানিশ এর পরামর্শে বেঙ্গালুরুর চার্চ স্ট্রিটে আমি পারফর্ম করতে গেলাম। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, আমি যখন প্রথমবার স্ট্রিট পারফরম্যান্স করলাম, আমার মনে আছে, আমি 'অ্যায় মেরে হামসফর' গানটি গেয়েছিলাম। ২৫ জনের মতো আমার চারিপাশে আমাকে হাততালিতে ভরিয়ে দিচ্ছিল। ওই একদিনে আমি ৬,০০০ টাকা রোজগার করেছিলাম।' 

শাকিল আরও বলেছেন, 'সেই থেকে শুরু; এরপর ব্যাঙ্গালুরুতে একাধিক স্ট্রীট পারফরম্যান্স করার পর সেখান থেকে পাওয়া টাকা সংগ্রহ করে আমি চলে এলাম মুম্বইয়ে। কিন্তু, আমার মুম্বইয়ের সফর খুব একটা সহজ ছিল না। আমি যখন মুম্বাইয়ে আসি সেই সময় শুরু হয়েছিল করোনাভাইরাস প্যানডেমিক। সারা মুম্বাই জুড়ে ঘোষণা করা হয়েছিল লকডাউন। একাধিক জায়গায় কনটেইনমেন্ট জোন, অফিস বাজার সব বন্ধ, এই অবস্থায় আমার পক্ষে মুম্বাইয়ে জীবন যাপন করা খুব একটা সহজ ছিল না। তার মধ্যে আবার মুম্বাইয়ের গানের স্কুলের বেতন, বাড়ির ভাড়া এবং খাবার সব কিছুই কিনতে হচ্ছিল ওই টাকা দিয়ে।'

মুম্বইয়ে যখন লকডাউন তুলে নেওয়া হল তখন শাকিল এর কাছে ছিল মাত্র ১০,০০০ টাকা। মুম্বাইয়ের মতো জায়গায় এই টাকা দিয়ে একমাসও ঠিক করে চলা যায় না। তাই, শাকিলকে প্রত্যেকদিন কোথাও না কোথাও পারফরম্যান্স করতে যেতে হতো। আর প্রত্যেকদিন হাতে আসত পাঁচশো টাকা, বরাত ভালো থাকলে হাজার। তা দিয়ে আর রীতিমতো চলছিল না। এই অবস্থায় যখন নিজের মিউজিক ক্যারিয়ার গড়ার আশা প্রায় শেষ, সেই সময়েই একটি পারফরম্যান্স, যা মুহূর্তেই হয়ে গেল ভাইরাল।  

তার এই গানটি ভাইরাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শাকিল ডাক পেতে শুরু করলেন মুম্বাইয়ের বড় বড় কিছু সঙ্গীত শিল্পীদের থেকে। জনপ্রিয় হিন্দি পপ গায়ক মিকা সিং তার সঙ্গে একটি ছোট গান রেকর্ড করলেন। সোনু নিগমের সঙ্গীত অ্যাকাডেমিতে গান গাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পেল শাকিল। স্মৃতিরোমন্থন করে শাকিল বললেন, 'কয়েক বছর আগে, আমার বাবা আমার উপরে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ছিলেন কারণ আমি গান নিয়ে ক্যারিয়ার তৈরি করার জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছিলাম। কিন্তু এখন তিনি আমাকে নিয়ে অত্যন্ত গর্বিত কারণ তার সবথেকে পছন্দের শিল্পী পূজা ভট্ট আমার গানের ক্লিপ নিজে শেয়ার করেছেন। আর আমি নিজে অত্যন্ত খুশি কারণ, আমি নিজেকে এবং আমার সংগীত দক্ষতাকে সারা ভারতের কাছে প্রমাণ করতে পেরেছি।'

More Articles