ছাত্র বলছে, 'শিক্ষকের কলার ধরতে পারি', কে এই যাদবপুরের ছাত্রনেতা সঞ্জীব?

আলিয়ার পর এবার যাদবপুর। ফের শিক্ষককে ফের কুৎসিত ভাষায় হুমকি দেওয়ার অভিযোগ তৃণমূলের ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে।  যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএমসিপি ইউনিট সভাপতি সঞ্জীব প্রামাণিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, শিক্ষকদের সঙ্গে অভব্য আচরণ করেছেন তিনি। ভাইরাল হওয়া এক অডিও ক্লিপে শোনা যায়, তিনি বলছেন, ‘যাদবপুরের কোন টিচারের কলার ধরতে হবে, সঞ্জীব প্রামাণিককে বলো, এত বড় ক্ষমতা রাখে সে।’ যদিও এই অডিও ক্লিপের সত্যতা যাচাই করা হয়নি ইনস্ক্রিপ্টের তরফে। তবে সঞ্জীব পক্ষান্তরে মেনেও নিয়েছেন কণ্ঠস্বর তাঁরই।

শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে নতুন নয়। এ-রাজ্যে কখনও স্থানীয় নেতা কলেজের শিক্ষিকাকে জলের জগ ছুড়ে মারেন, কখনও আবার ছাত্রনেতা উপাচার্যকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। সঞ্জীবের কটূক্তির মধ্যে দিয়ে শিক্ষাঙ্গনে শাসক দলের ক্ষমতা প্রদর্শনের রাজনীতির সেই ধারাবাহিকতাই যেন বজায় থাকছে। কিন্তু কে এই সঞ্জীব প্রামাণিক? তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনে কীভাবে ধাপে ধাপে উত্থান ঘটেছে তাঁর? এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক।

নদিয়ার করিমপুরের বাসিন্দা সঞ্জীব। সমাজতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনো করতে তিনি স্নাতক স্তরে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানেই রাজনীতিতে তাঁর প্রথম হাতেখড়ি ঘটে, যোগাযোগ তৈরি হয় তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সঙ্গে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সঞ্জীব ছিলেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সাধারণ কর্মী। যাদবপুরে আসার পর থেকে দলে তাঁর গুরুত্ব বাড়তে থাকে। ২০১৪-'১৫ নাগাদ সমাজতত্ত্ব নিয়ে স্নাতকোত্তর করতে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তখন থেকেই সঞ্জীব হয়ে ওঠেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের যাদবপুর শাখার অন্যতম মুখ বা ‘ব্লু আয়েড বয়’। যাদবপুরে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সাংগঠনিক অবস্থা কোনওদিনই বিশেষ সুবিধের ছিল না। একে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ রাজনীতিসচেতন পড়ুয়াই বাম মনস্ক, তার ওপর কয়েক বছর আগেই ঘটে গেছে ‘হোক কলরব’ আন্দোলন। ফলত, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সমর্থক সংখ্যায় ছিল নেহাতই কম। এমতাবস্থায় সঞ্জীবের দক্ষ পরিচালনায় সংগঠনের হাল কিছুটা হলেও ফেরে।

যাদবপুরের কলা বিভাগে একসময় তৃণমূলকে লড়তে হত এসএফআই, আইসা, ইউএসডিএফ (অধুনা আরএসএফ) এবং ফ্যাসের বিরুদ্ধে। বিজ্ঞান এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ফ্যাস-এর পরিবর্তে ডাব্লিউটিআই এবং ডিএসএফ-এর মতো ‘নির্দল মঞ্চ’গুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করত। এই দুই বিভাগে টিএমসিপির অস্তিত্ব একসময় প্রায় ছিল না বললেই চলে। তাদের অধিকাংশ ভোটই আসত কলা বিভাগ থেকে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই খেলা ঘুরতে আরম্ভ করল।

আরও পড়ুন: মেয়াদ শেষ, তবু কেন আজও জেলের ভিতর সুদীপ্ত সেন

‘ফ্যাস’ বা ‘ফোরাম ফর আর্টস স্টুডেন্টস’ নামক সংগঠনটি গড়ে ওঠে ২০০৫ সালে ‘লাঠির মুখে গানের সুর’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সে-বছর পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বাম সরকারের অধীন পুলিশ যাদবপুরের আন্দোলনরত পড়ুয়াদের ওপর ব্যাপকভাবে লাঠিচার্জ করে। ফলস্বরূপ পড়ুয়ারা বৃহত্তর আন্দোলনের পথে হাঁটেন। সেই আন্দোলন থেকেই কালক্রমে গড়ে ওঠে ফ্যাস। এই সংগঠন কেবলমাত্র বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত ছিল না। বামপন্থীদের পাশাপাশি সেখানে বহু তৃণমূল এবং নকশালপন্থীরাও ছিলেন। এছাড়াও ছিলেন সিপিএম-বিরোধী বহু ‘মধ্যপন্থী’। ফ্যাস সে-সময় সিপিএম-বিরোধী পড়ুয়াদের একটা ‘মঞ্চ’ ছিল। ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামের উচ্ছেদ-বিরোধী আন্দোলনেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এই সংগঠনেরই নেতৃস্থানীয় ছিলেন অভিষেক মুখোপাধ্যায়, যাঁকে মাওবাদী কার্যকলাপে যুক্ত থাকবার অভিযোগে ২০১২ সালে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১০ সালে লালগড় আন্দোলন নিয়ে মতাদর্শগত অবস্থান নেওয়াকে কেন্দ্র করে সংগঠন ভাগ হয়ে যায়। তারপরেও অন্তত দুটো নির্বাচনে জয়ী হয় ফ্যাস। কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে তাদের দুর্দিন শুরু হয়। দলের বহু গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক পাশ করে বেরিয়ে যাওয়ার ফলে ফ্যাস কার্যত সংগঠকহীন হয়ে ওঠে। ২০২০ সালের নির্বাচনে এসএফআই-এর কাছে প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় পরাজিত হয় তারা। এর অল্প কিছুদিন পরেই কোভিডের প্রকোপে শুরু হয় লকডাউন। লকডাউনের মধ্যে যাদবপুরের অন্যান্য সংগঠন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নিজেদের কার্যকলাপ বজায় রাখলেও ফ্যাস প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে এবং এই নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নেয় টিএমসিপি।

ফ্যাস অচল হয়ে যাওয়ার ফলে তাদের ভেতরের ‘মধ্যপন্থী’ অংশটা পড়ে গেল দ্বন্দ্বে। সরাসরি বামপন্থী রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার মতো মতাদর্শত অবস্থান তাদের নেই। এবিভিপি-তে তারা যোগ দেবে না। কিন্তু ফ্যাসের বিকল্প হিসেবে কোন সংগঠনকে বেছে নেবে তারা। এই অবস্থায় তাদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে আরম্ভ করল টিএমসিপি। যদিও গোড়ার দিকে তা করতে গিয়ে তাদের বেশ কিছুটা বেগ পেতে হয়েছিল, কারণ এই ‘মধ্যপন্থী’দের সিংহভাগই শহুরে উচ্চ-মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর মতো সদস্য টিএমসিপি-তে খুব বেশি ছিল না। এমতাবস্থায় ময়দানে নামলেন সঞ্জীব। নিজের সাংগঠনিক দক্ষতায় এই ‘মধ্যপন্থী’-দের একাংশকে দলে টানতে সক্ষম হলেন তিনি।

আরও পড়ুন: তৃতীয় জয়ের এক বছরেই নড়বড়ে তৃণমূল? দল কি ভাঙছে আড়াআড়ি?

তৃণমূল ছাত্র পরিষদে দিন দিন প্রতাপ বাড়ছে সঞ্জীবের। বর্তমানে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএমসিপি-র ইউনিট সভাপতি হওয়ার পাশাপাশি পলাশি কলেজ এবং কৃষ্ণনগর মহিলা কলেজে পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষা সংসদের প্রতিনিধি। ইতিপূর্বে নানা কারণে দলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল সঞ্জীবের। ২০১৬-'১৭ নাগাদ তিনি তৈরি করেছিলেন ‘আম্বেদকর দলিত স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটা সংগঠন। কিন্তু অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই  দ্বিধা-দ্বন্দ্ব মিটিয়ে তিনি ফের পুরনো দলেই ফিরে যান। রাজনীতির পাশাপাশি বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগে গবেষণা করছেন সঞ্জীব।

সাম্প্রতিককালে টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্যর সঙ্গে তাঁর বিশেষ ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে বলে শোনা যায়। তাঁর হাত ধরেই যাদবপুরের বাম-অধ্যুষিত ক্যাম্পাসে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের এক নব্য পর্যায়ের উত্থান ঘটছে বলে মনে করেন অনেকে। যাদবপুরের এক পড়ুয়া বলছিলেন, ‘সঞ্জীব আসলে একটা নতুন টিএমসিপির উত্থান ঘটাচ্ছে, যারা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পুরনো লবি থেকে বেরিয়ে তৃণাঙ্কুরের নেতৃত্বে কাজ করবে।’ তিনি আরও বলছিলেন, ‘আসলে এই অডিও ক্লিপটা ভাইরাল হওয়ার ফলে ওর লাভই হল, কারণ সঞ্জীবের এমনিতেও বিশেষ পপ্যুলারিটি ছিল না। এই ক্লিপটার মধ্য দিয়েই ওকে এবার পাঁচটা লোক চিনবে।’

২০১২ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজের বেকার ল্যাব ভাঙচুর থেকে আরম্ভ করে একাধিকবার শিক্ষাঙ্গণে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। যে তৃণমূল বাম জমানায় অহরহ শিক্ষাঙ্গণের ‘অনিলায়ন’-এর অভিযোগ তুলত, তারাই এখন হাঁটছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মমতায়ন’-এর পথে। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে দলের ভাবমূর্তি। পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষই বিজেপি-বিরোধী শক্তি হিসেবে ক্ষমতায় ফিরিয়েছিলেন তৃণমূলকে। কিন্তু একের পর এক বিতর্কিত কাণ্ডে জড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের জনপ্রিয়তা কতদিন থাকবে, তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। 

 

More Articles