যে'সমস্ত ব্যবসায়ীরা হার মানেননি, এবং তৈরি করেছেন সফলতার ইতিহাস
বাড়ির বাইরে হামেশাই লিখে থাকতে দেখা গেছে সেলস ম্যান প্রবেশ নিষেধ, এর উদ্যেশ্য আর যাই হোক রোদে বেরিয়ে সারাদিন ঘুরে নিজের টার্গেট সম্পূর্ন করতে চাওয়া মানুষটি কে সম্মান করা বোধ হয় নয়। কমবেশি প্রতিটা মানুষ নিজের জীবনে অন্তত এক আধবার বিপদের সম্মুখীন হন। কারও সমস্যা পরিবার সংক্রান্ত, কেউ রোজগার না করতে পেয়ে পথে বসেন, কেউ দুবেলার খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খান, আবার কেউ অসুখে জর্জরিত হয়ে লড়াই করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠেন। কিন্তু যে কোনও পরিস্থিতি সামলে নিতে অন্য সব কিছুর পাশাপাশি প্রয়োজন হয় মনের জোর, নিজেকে শান্ত রেখে সেই কঠিন সময়ের সাথে লড়াই করে যাওয়া। এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যাঁরা হাল ছেড়ে দিলে আজ পৃথিবীটা এতো সুন্দর নাও হতে পারতো, বিজ্ঞান প্রযুক্তির এতো ব্যবহার নাও জানতে পারতো, কিম্বা কোনও মা তাঁর হেরে যাওয়ার গল্প নিয়েই হারিয়ে যেতে পারতেন।
এই ভদ্রলোকের জন্ম হয়েছিল কুমারী মায়ের কোলে। মায়ের প্রেমিক বিয়ে করতে নারাজ হওয়ায় বাধ্য হয়ে সন্তানকে দত্তক দিয়ে দিলেন মা। শর্ত রাখলেন ছেলেটিকে কোনও অভাবের সম্মুখীন হতে দেওয়া যাবে না। এক উকিল সস্ত্রীক এগিয়ে এলেও শেষ মুহূর্তে তারা সিদ্ধান্ত নেন কোনও এক কন্যা সন্তানকে দত্তক নেওয়ার। বাধ্য হয়ে এক দরিদ্র পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হল তাকে। পরিবার লিখিত শর্তে রাজি হল যে এই সন্তানকে ভালো কলেজে পড়াবেন তারা। ছেলেটি ছোটো থেকেই প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত, অথচ পড়াশোনায় মন ছিল না তেমন একটা। হবেই বা কী করে! তিনি তো ততদিনে বাবার সাথে ইলেকট্রনিক্সের কাজ শিখতে ব্যস্ত। স্কুলের সহপাঠীদের সাথে হামেশাই বচসা, মারধরে জড়িয়ে পড়তেন ছোট্ট বয়সে। সারা সপ্তাহ ভালো খাওয়ার পেতেন না তাই সপ্তাহে একদিন অনেকটা রাস্তা হেঁটে একটি মন্দিরে যেতেন পেট ভরে খাবার খেতে।
বাবা, মা চুক্তিমতো নিজের সমস্ত সঞ্চিত টাকা ব্যয় করে ভর্তি করেন রিড কলেজে, যা সেই সময় অন্যতম খরচ সাপেক্ষ কলেজ ছিল। বাবা কলেজের খরচ চালাতে পারছেন না দেখে ভর্তি হওয়ার ছ'মাসের মধ্যেই ছেড়ে দেন কলেজ। বদলে শিখতে থাকেন ক্যালিগ্রাফি এবং অন্যান্য আর্টের কাজ। একুশ বছর বয়সে এক বন্ধুর সঙ্গে একটি গ্যারেজের মধ্যে খুলে ফেলেন একটি কম্পিউটার তৈরির কোম্পানি। আগামী কয়েক বছরে সাফল্যের ঢেউ আছড়ে পড়ে তার পায়ে। মাত্র ২৫ বছর বয়সে ফোর্বস ম্যাগাজিনের সবচেয়ে ধনী মানুষদের তালিকায় চলে আসে তার নাম, তাও আবার সবচেয়ে কম বয়সী ধনী হিসেবে। কিন্তু বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ বিবাদের জেরে তাঁর নিজের তৈরি কোম্পানি থেকে তাঁকেই বের করে দেন সেই কোম্পানির তৎকালীন সিইও। বলা হয়, এতো কম বয়সে এতো টাকার মালিক হয়ে অহংকার এবং দম্ভে চুর হয়ে গেছিলেন তিনি। এই সময় তিনি ভেঙে পড়েন মানসিক ভাবে। বহিষ্কৃত হওয়ার পর দীর্ঘদিন উত্তর ভারতে কাটিয়েছেন তিনি। কখনো উত্তর প্রদেশ, কখনো দিল্লি, উত্তরাখান্ড আবার হিমাচলের পাহাড়ে ধ্যান করেছেন নিজের মন কে শান্ত করার জন্য। যখন ফিরে গেছিলেন আমেরিকায় তখন তার পরিধান ছিল ভারতীয় বেশভূষা। কিছুটা সময় লাগে সামলে উঠতে।
এরপর নিজস্ব টাকায় তৈরি করেন আরও একটি কোম্পানি নেক্সট। এই কোম্পানি আংশিক ভাবে সফল হলেও সাফল্য আসে তার তৈরি পরবর্তী কোম্পানি পিক্সারের হাত ধরে। এদিকে তিনি কোম্পানি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে ক্রমশ মাটিতে মিশে যেতে থাকে তার আগের কোম্পানিটি, প্রতিযোগিতায় একদিকে ছিলেন মাইক্রোসফট, অন্যদিকে আইবিএম। এই গল্পটি অন্য কারও নয়, বিশ্বখ্যাত বিজনেস টাইকুন স্টিভ জবসের এবং যে কোম্পানি থেকে তাকে বহিষ্কৃত করা হয় সেটি আর কিছু নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইলেকট্রনিক গ্যাজেট তৈরির কোম্পানিগুলির মধ্যে একটি, অ্যাপেল। পিকসার ইতিমধ্যে অ্যানিমেশন এবং সিনেমার কাজ করে আকাশ ছুঁয়েছে। যে কোম্পানি থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল দশ বছর আগে, সেই মুহূর্তে সেখানে ফিরে আসতে অনুরোধ করেন বোর্ডের সদস্যরা। শেষে ১৯৯৭ সালে পুনরায় নিজের পুরোনো কোম্পানি অ্যাপেলে সিইও হিসেবে যুক্ত হন তিনি।
তামিলনাড়ুর নাগেরকয়েলে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন এই মহিলা। মাত্র সতেরো বছর বয়সে একজনকে ভালবেসে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বাবা মায়ের চরম আপত্তি থাকা সত্যেও নিজের থেকে তেরো বছরের বড় নারায়ণ কে বিয়ে করেন এবং বিয়ের তিন মাসের মাথায় জানতে পারেন যে নারায়ন প্রচণ্ড পরিমাণে মাদকাসক্ত। প্রতিদিন বাড়তে থাকে অশান্তি এবং এই অশান্তি ক্রমে আকার নিতে থাকে মারধরের। স্বামীর কোনও আয় না থাকায় বাধ্য হয়ে সাহায্য চাইতে হয় বাবার কাছে। পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করার কারণে রাগে, অভিমানে সাহায্য করতে অস্বীকার করেন বাবা। শেষে মায়ের অনেক কাকুতি মিনতির পর শুধু মাত্র বাড়িতে থাকার জায়গাটুকু পান। জীবনের প্রতি ক্রমশ হতাশা বাড়তে থাকলেও নিজের সন্তানদের কথা মাথায় রেখেই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মায়ের কাছ থেকে দুশো টাকা ধার নিয়েছিলেন ফিরিয়ে দেবেন কথা দিয়ে। রান্না জানতেন এবং রান্না করতে ভালোবাসতেন, শুধু এইটুকু কে ভরসা করেই মায়ের থেকে ধার নেওয়া টাকায় আচার, জ্যাম ও সরবত বানিয়ে বিক্রি করতে থাকেন মায়ের অফিসে এবং অন্য জায়গায়।
এই মুহূর্তে দেখা হয় বাবার এক বন্ধুর সাথে। বাবার এই বন্ধু চালাতেন বিকলাঙ্গদের স্কুল। তার সাহায্যেই স্কুলের সামনে জোগাড় হয় একটি ঠেলাগাড়ি এবং দুজন শারীরিক ভাবে অক্ষম ছাত্রকে সাথে নিয়ে শুরু হয় তাঁর দোকান। এরপর কিছু টাকা জমিয়ে দোকান শুরু করেন মেরিন ড্রাইভে। চা, কফি, চিপস বিক্রি করে চলতে থাকে জীবন। সেই দোকানে চা খেতে এসেই পরিচয় হয় এক সরকারি চাকরিজীবী অফিসারের সাথে। তার কাজ দেখে খুশি হন এই অফিসার এবং তার মাধ্যমেই পান একটি অফিস ক্যান্টিন চালানোর সুযোগ। এদিকে উপার্জন করার কোনরকম ইচ্ছে তো ছিলই না, বরং মাঝে মাঝেই নিখোঁজ হয়ে যেতেন তাঁর স্বামী। এমনই একদিন আসে তার মৃত্যুর খবর। এর দুবছর পর আরও একটি দুর্ঘটনায় মারা যান তাঁর মেয়ে ও জামাই। দুর্ঘটনার পর অ্যাম্বুলেন্স বা কোনও গাড়ি জোগাড় না হওয়ায়, এক ব্যক্তি তার গাড়ির ডিকিতে করেই হাসপাতাল নিয়ে যায় তার মৃতপ্রায় মেয়েকে। এই ঘটনা কোনওভাবেই মেনে নিতে পারেননি তিনি এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে সিদ্ধান্ত নেন তার ক্যান্টিন বন্ধ করে দেওয়ার। স্বাভাবিক হতে সময় লাগে অনেকটা, এই সময় ছেলের অনেক বোঝানোর পর মেয়ের নামে খোলেন নতুন রেস্তোরাঁ। এবং এখন তিনি এইরকম চোদ্দটি রেস্তোরাঁর মালকিন। এই মহিলার নাম প্যাট্রিসিয়া নারায়ণ। সন্দীপা রেস্তোরাঁ চেনের ফাউন্ডার। সাথে ২০১০ ও ২০১৬ সালে যথাক্রমে FICCI woman entrepreneur of the year এবং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস দেবী আওয়ার্ড পুরস্কার জয়ী। প্যাট্রিসিয়া আজ ২০০র থেকেও বেশি কর্মী নিয়ে নিজের রেস্তোরাঁ চালিয়ে যাচ্ছেন। সাথে সাথেই ১০০ জন দুঃস্থ পথ শিশুদের খাবারের যোগান দিয়ে থাকেন। মেয়ের শেষদিনের পরিণতির কথা মাথায় রেখে দুর্ঘটনা গ্রস্থ মানুষের জন্যে বেশ কিছু অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও করেছেন তিনি।
অথচ এই মানুষগুলি এই উচ্চতায় পৌঁছনোর আগে একদিন আমার, আপনার মতো সাধারণ মানুষ ছিলেন। শুধু হার না মানা মনোভাব এই মানুষগুলোকে এখানে পৌঁছে দিয়েছে। আমরা আক্ষেপ করে সময় নষ্ট করছি না তো?