সুদীপ না তাপস? উত্তরের উত্তর শুধুই ধাঁধা
Sudip Bandyopadhyay vs Tapas Roy: উত্তর কলকাতায় হিন্দিভাষী ভোটারদের সন্তুষ্ট করার জন্যই কিনা কে জানে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় আজকাল একটা বিসদৃশ পাগড়ি পরে থাকেন।
উত্তরের উত্তরেই যত ধাঁধা। আপাতত উত্তর কলকাতার অলিগলিতে এই ধাঁধা নিয়েই জোর চর্চা। কে জিতবে উত্তর কলকাতা? গোটা বঙ্গে নরেন্দ্র মোদি একটিই 'রোড শো' করলেন। তাও সেটা উত্তর কলকাতায়। সেই রোড শো-তে মানুষের উচ্ছ্বাস দেখে রাজ্য বিজেপির শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের একটা অংশ বেশ আত্মপ্রত্যয়ী যে, কলকাতার বুকে প্রথমবার পদ্ম ফুটতে চলেছে! কলকাতা শহর যে তৃণমূল কংগ্রেসের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি এটা নরেন্দ্র মোদি জানেন না, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই এবং জানেন বলেই খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শহরেই পদ্ম ফোটাতে এতটা মরিয়া তিনি।
সেক্ষেত্রে, ২০২৬-এর আগে এই একটা আসনের জয় নিয়ে বিজেপি যেমন গোটা দেশে প্রচারের শিরোনামে আনবে একইসঙ্গে তুঙ্গে উঠবে গোটা রাজ্যের কর্মীদের আত্মবিশ্বাস! তেমনই গোটা বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের লক্ষ লক্ষ কর্মী সমর্থকদের আত্মবিশ্বাসেও চিড় ধরানো যাবে যে, খোদ কলকাতায় যদি পদ্মের চাষ হয় তাহলে গোটা বাংলাতেও সম্ভব!
যদিও তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব এসব সম্ভাবনাকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, ''উত্তর কলকাতা জেতাটা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।'' প্রবীণ এক তৃণমূল নেতার কথায়, "এসব 'রোড শো'-তে ভিড় স্রেফ 'ফ্লুক'। ভোটবাক্সে এসবের প্রভাব পড়বে না। ভিড় দেখে ভোট হলে এতদিনে অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার গঠন হয়ে যেত! এখানে ভোট হবে দিদিকে দেখে!” তৃণমূল কংগ্রেসের পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা নির্বাচন অবধি সমস্ত স্তরের সমস্ত নির্বাচনেই যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর, এ আর নতুন কথা কী! কিন্তু, রাজনৈতিক মহলের কৌতূহল হলো, এই নির্বাচনে কি উত্তর কলকাতা নিয়ে একটু বাড়তি তৎপরতা দেখাতে হচ্ছে তৃণমূল সুপ্রিমোকেও? প্রশ্ন অনেক... আর তার উত্তর অজানা...
আরও পড়ুন- যাদবপুরে সততা বনাম দুর্নীতি! সায়নী ঘোষের বিরুদ্ধে কতটা শক্তিশালী সৃজন ভট্টাচার্য?
উত্তর কলকাতা আসলে অনেকগুলো ধাঁধা তৈরি করেছে। খালি চোখে দেখলে, এই লোকসভা তৃণমূল কংগ্রেসের হাসতে হাসতে জেতা উচিত। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী, এই লোকসভার ৭ টির মধ্যে ৭ টিই তৃণমূলের দখলে। রাজ্যের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, বিধায়ক, তৃণমূল নেতৃত্ব এই লোকসভার বিভিন্ন বিধানসভায় নেতৃত্ব দেন। স্বাভাবিকভাবেই এই লোকসভা তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে অনেক সহজ লড়াই। শেষ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের হিসেবে এই লোকসভার ৭ টি বিধানসভা মিলিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস ২,৬১,৬৩২ ভোটে এগিয়ে আছে। কিন্তু তারপরেও এই সংশ্লিষ্ট লোকসভাটিকে ঘিরে বারবার অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে কেন রাজ্যের শাসক দলকে?
ফিরে যেতে হবে ২০২২-এর কলকাতা পৌর নিগমের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে। সেই সময়ে তাপস রায় উত্তর কলকাতায় তৃণমূলের জেলা সভাপতি। নেতাজি ইন্ডোরে দলের একটি সভা থেকে প্রকাশ্যে তাপস রায়কে সরিয়ে দেন দলনেত্রী। তাঁর জায়গায় ফের ফিরিয়ে আনা হয় সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরে, তাপস রায়কে আর নিজের ক্যাবিনেটে ফেরত আনেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মাত্র দু'বছরেই ক্যাবিনেট থেকে বিতাড়িত হন তাপস। নির্বাচনের মাস দু'য়েকের মধ্যে রাজ্য জুড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের জেলা-ব্লক-টাউন সভাপতিদের নাম ঘোষণা হয়। দেখা যায়, উত্তর কলকাতার সভাপতি সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরিয়ে করা হয়েছে তাপস রায়কে। মন্ত্রিত্ব না পাওয়ার কষ্ট বোধহয় খানিক ভুলেও ছিলেন তাপস। কারণ, তাঁর বরাবরই লক্ষ্য ছিল উত্তর কলকাতায় রাজনীতি করা (২০১১ থেকে তাঁকে বরানগরের বিধায়ক করে কার্যত উত্তর কলকাতার রাজনীতি থেকেই ব্রাত্য করে দেওয়া হয়েছে বলে বারবার ঘনিষ্ঠ মহলে অভিযোগ করতেন তাপস রায়)। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় জেলা সভাপতির পদ থেকে সরে গেলেও, নেত্রী যে সুদীপের সঙ্গেই ছিলেন সেটা বোঝা যায়, যখন ফের তাঁকে প্রকাশ্য মঞ্চ থেকে জেলা সভাপতির পদে ফিরিয়ে আনেন স্বয়ং দলনেত্রী। সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা কথা বলেন, "সুদীপদা বারবার বলছে জেলা সভাপতির জন্য৷ তাই সুদীপদাই উত্তর কলকাতার জেলা সভাপতি থাকুন!” এই বক্তব্যে যেমন চমকে ছিলেন রাজ্য রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা, তেমনই সবচেয়ে বেশি চমকে ছিলেন তাপস রায় নিজে। কিন্তু তৃণমূল নেত্রীর কথায় একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই জেলা সভাপতি পদ ফিরে পাওয়ার জন্য বারবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তদ্বির করতেন! এই ঘটনাই প্রথম উত্তর কলকাতায় তাপস বনাম সুদীপের প্রকাশ্য সংঘাতের প্রাথমিক আবহ তৈরি করে। এরপরে গত দুই-আড়াই বছরে একাধিকবার দু'জনের দ্বন্দ্বে মুখরিত হয়েছে রাজ্য রাজনীতি। উত্তর কলকাতার তৃণমূলের অন্দরেও আড়াআড়ি ভাগ স্পষ্ট হয়েছে। বড় বড় নেতা নেত্রী থেকে কাউন্সিলরদের মধ্যেও এক শ্রেণি সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষ নিয়েছেন, আরেক শ্রেণি তাপস রায়ের।
তাপস রায় তখনও তৃণমূলে। তাপস রায়ের সঙ্গে কুণাল ঘোষের সুসম্পর্ক দেখেছে গোটা উত্তর কলকাতা তথা রাজ্য। বস্তুত সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তৃণমূল কংগ্রেসের একটা বৃহত্তর অংশের কর্মীদের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের দিকে টেনে নিতে পেরেছিলেন তাপস-কুণালরা। কিন্তু এবছরের গোড়ায় তাপসের বাড়িতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তল্লাশি আর তার কয়েকমাসের মধ্যেই দল এবং দলনেত্রীর প্রতি 'অভিমানে' তাপসের দলত্যাগ আর বিজেপিতেও সঙ্গে সঙ্গে টিকিট পেয়ে যাওয়া উত্তর কলকাতার রাজনীতিকে আরও নাটকীয় মুহূর্তে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন- মমতা-বর্জিত একনায়কতন্ত্রের চেষ্টা আদৌ সফল হবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের?
আপাতদৃষ্টিতে এখন ঐক্যবদ্ধ তৃণমূল। যে কুণাল ঘোষ প্রথম থেকে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা করেছেন, দলীয় পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন, দল প্রথমে সেই ইস্তফাপত্র গ্রহণ করতে গররাজি থাকলেও, তাপস রায়ের সঙ্গে রক্তদানের মঞ্চ ভাগ করার সঙ্গে সঙ্গে তা গ্রহণ করে নিয়েছিল, সেই কুণাল ঘোষও সুদীপের সমর্থনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসভায় বক্তব্য রাখছেন। যে সমস্ত কাউন্সিলরদের সঙ্গে তাপস রায়ের ঘনিষ্ঠতার কথা শোনা যাচ্ছিল, তাঁরাও নিজেদের ওয়ার্ডে প্রচারে মন দিয়েছেন। সার্বিকভাবে আশির দশকের তরুণ মজুমদারের ছবিতে যেমন 'ঐক্যবদ্ধ মিষ্টি বাঙালি পরিবার' দেখা যেত, তেমন একটা ছবি। কিন্তু অন্দরে একটু উঁকি মারলেই বোঝা যাচ্ছে, ভিতরটা একতা কপূরের হিন্দি মেগাধারাবাহিকের মতো। যেখানে অহরহ চলছে অবিশ্বাসের বাতাবরণ!
সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে উত্তর কলকাতার বৃহত্তর অংশের কর্মীদের অভিযোগ, তাঁর আত্মঅহংকার, তিনি কর্মীদের সঙ্গে দেখা করেন না! উত্তর কলকাতা, তৃণমূল কংগ্রেসের একমাত্র সাংগঠনিক জেলা, যেখানে এখনও জেলার দলীয় কার্যালয় নেই! সুদীপ থাকেন 'ক্যালকাটা বয়েজ স্কুল'-এর ভিতরে! এবং এটিই তৃণমূল কংগ্রেসের একমাত্র জেলা, যার চেয়ারম্যান, সভাপতি এবং সাংসদ একই ব্যক্তি! আরও অনেক কিছুই উত্তর কলকাতায় ব্যতিক্রমী। যা আজকের 'নতুন তৃণমূল'-এর সঙ্গে একেবারেই মানানসই না বলে অভিযোগ।
যেমন, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় যে নিজের ইস্তেহার প্রকাশ করেছেন, সেখানে কোথাও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি নেই! আছে কেবল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনে ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সামনে তৃণমূল নেত্রী যে সভা করেন, সেই সভাস্থলে বা আশেপাশের কোথাও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও ছবি নেই। নির্বাচনের আবহে এসব নিয়ে হয়তো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বিশেষ মাথা ঘামাচ্ছেন না কিন্তু ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোনালিসা বন্দ্যোপাধ্যায় এ নিয়ে সরব হয়েছেন। তাঁকে প্রচারে ডাকা হচ্ছে না, এই অভিযোগে ধর্নাতেও বসেছিলেন মোনালিসা! সেই ধর্নাতে গিয়ে নিজের সমর্থনের কথা জানিয়ে এসেছিলেন কুণাল ঘোষ। রাজ্য যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক মৃত্যুঞ্জয় পালও নিজের অনুগামীদের নিয়ে সুদীপকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখান! কারণ, তাঁকেও নাকি প্রচারে ডাকা হচ্ছে না।
সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় যদিও এই সবে খুব একটা পাত্তা দেন না। কথায় কথায় ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি প্রায়ই বলেন নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর অত্যন্ত 'সুসম্পর্কে'-র কথা। কয়েকমাস আগেই, তাপস রায় তাঁর সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করায় সংবাদমাধ্যম যখন তাঁর প্রতিক্রিয়া চায়, তখন বলেছিলেন, "আমি যার তার কথার উত্তর দিই না। আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করি! বাবু যায় বাজার কুত্তা ভোকে হাজার!” গণমাধ্যমে সেই বক্তব্য এখনও আছে, ইউটিউব ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে।
তাপস রায় তৃণমূল ছাড়ার আগে প্রায়ই বলতেন, সুদীপই নাকি বিজেপির সঙ্গে যোগসাজশ করে তাঁর বাড়িতে ইডি পাঠিয়েছে! সুদীপের ঘনিষ্ঠ সেই বিজেপিকে রুখতেই তিনি এই বয়সে এসে নিজেই কীভাবে বিজেপি হয়ে গেলেন এটাও একটা বড় বিস্ময়!
সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ। দীর্ঘদিনের সাংসদ। তাই, এসব ছোটখাটো 'উটকো' ঝামেলাকে তিনি বিশেষ আমলও দিচ্ছেন বলে মনে হয় না কিন্তু উত্তর কলকাতার রাজনীতিকে যারা দীর্ঘ দিন ধরে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁরা কিন্তু বুঝছেন সব ঠিক নেই।
রাজনীতির কিছু কিছু অঙ্ক জটিল হয়ে যায়। যেসব অঙ্ক দু'য়ে দু'য়ে চার না হয়ে বাইশও হয়। এই যেমন, কুণাল ঘোষ। কুণাল ঘোষের ইস্তফাপত্র যেদিন তৃণমূল গ্রহণ করল এবং পরের দিনই তাঁকে তৃণমূলের তারকা প্রচারকের তালিকা থেকে বের করে দেওয়া হলো, তখন সুদীপ ঘনিষ্ঠদের উল্লাস চাপা থাকেনি। সামাজিক মাধ্যমে তাঁরা কুণাল ঘোষ সম্পর্কে বাছা-বাছা বিশেষণ ব্যবহার করতে থাকেন। কুণালও পরের তিন দিন বাংলার প্রায় প্রতিটি গণমাধ্যমে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ ছিল তা বলে বেড়ান! এমন এমন অভিযোগ তিনি ওই তিনদিন করেন, যা বিজেপিও করতে পারেনি। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, একটি সাক্ষাৎকারেও দলনেত্রী এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে একটিও সমালোচনা তিনি করেননি! উল্টে, দল এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে প্রশংসা ঝরে পড়েছে তাঁর গলায়। উত্তর কলকাতার এতজন তৃণমূল বিধায়ক, মন্ত্রী, গুরুত্বপূর্ণ কাউন্সিলর একজনও প্রকাশ্যে কুণাল ঘোষের সমালোচনা করলেন না! কেউ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডিফেন্ডও করলেন না! মজার বিষয় হলো, এর ঠিক তিনদিনের মাথাতেই কুণাল ঘোষকে ফের দলের তারকা প্রচারকের তালিকায় যুক্ত করে দিল তৃণমূল! কুণালও প্রকাশ্যে বিবৃতি দেওয়া বন্ধ করেন কিন্তু ততক্ষণে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে যা যা সমালোচনা করার সবটা করে ফেলেছেন তিনি।
এসব 'ছোট` ঘটনাই এখন মস্ত বড় কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ভোটের অঙ্ক। যে ভোটের অঙ্কই উত্তর কলকাতার বিজেপিকে আরও উৎসাহিত করছে এই লোকসভাটিতে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপাতে।
২০১৪ সালে এই লোকসভায় তৃণমূল প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় পান ৩,৪৩,৩৮৯ টি ভোট। বিজেপির রাহুল সিনহা পেয়েছিলেন ২,৪৭,৩১৬ টি ভোট। কংগ্রেসের সৌমেন মিত্র এবং সিপিএমের রূপা বাগচি পান যথাক্রমে ১,৩০,৭১৪ টি এবং ১,৯৫,৫৯১ টি ভোট।
আবার ২০১৯ সালে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় পান ৪,৭৪,৪৯০ টি ভোট। বিজেপির রাহুল সিনহার পক্ষে যায় ৩,৪৭,৩০৭ টি ভোট, কংগ্রেসের সৈয়দ শাহিদ ইমাম মাত্র ২৬ হাজার ভোট এবং সিপিএমের কনীনিকা বসু মাত্র ৭০ হাজারের মতো ভোট পান। লক্ষ্যণীয় বিষয়, ২০১৪-এর তুলনায় প্রায় ১ লাখ করে ভোট বৃদ্ধি হয়েছে তৃণমূল এবং বিজেপি দুই দলেরই। আর কংগ্রেস ও সিপিএম প্রায় মুছে গেছে। উত্তর কলকাতায় কংগ্রেসের একটা ভোট ছিলই। সৌমেন মিত্ররও নিজস্ব কিছু ভোট ছিল কিন্তু সৌমেন মিত্র পরবর্তীকালে সেই ভোট সম্ভবত তৃণমূলে ঢুকে গেছে। এবং বাম ভোট গোটা রাজ্যের মতো এখানেও সম্ভবত বিজেপিতে মিশে গেছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ৭ টি বিধানসভা মিলিয়ে তৃণমূল পায় ৫০.৩% ভোট। বিজেপি ৩৬.৮%। বামেরা ৭.৫% ও কংগ্রেস ২.৮%। বাম ও কংগ্রেস মেলালে হচ্ছে ১০.৩% ভোট। বাম-কংগ্রেস এবং বিজেপির প্রাপ্ত ভোট যোগ করলে তৃণমূলের সঙ্গে পার্থক্য দাঁড়াচ্ছে মাত্র ৪% এর! সাধে কী আর তাপস আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে যাচ্ছেন বাম ভোট চাইতে?
তাপস রায় প্রায়ই বলছেন, বহু সিপিএম ভোটার তাঁকে ভোট দেবেন। তৃণমূলেরও একটা বড় অংশ তাকে ভোট দেবেন বলে তাঁর বিশ্বাস। আর এরমধ্যেই লড়ে চলেছেন বাংলার কংগ্রেসি রাজনীতির এক নীরব কুশীলব, প্রদীপ ভট্টাচার্য, কংগ্রেস প্রার্থী। বড়বাজারের একটা অংশে এখনও কংগ্রেসের একটা ভোট ব্যাঙ্ক আছে। কলকাতায় কংগ্রেসের একমাত্র কাউন্সিলর সন্তোষ পাঠক আছেন। কলকাতার কিছু বনেদি পরিবার এখনও কংগ্রেসের ভোটার। এই ভোট কি কংগ্রেস ধরে রাখতে পারবে? নাকি সেই ভোট 'হাত' ছেড়ে একফুল বা জোড়া ফুলে ভাগ হয়ে যাবে? আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্যি যে, দীর্ঘদিন সিপিএমের সাংসদ থাকা উত্তর কলকাতায় এবার কোনও সিপিএম প্রার্থীই নেই! সিপিএমের সমস্ত ভোটাররা যে ঢেলে প্রদীপ ভট্টাচার্যকে ভোট দেবেন না সেটা এখনই বলে দেওয়া যায়! তাহলে এই ভোট কোন দিকে ঘুরে যাবে?
আরও পড়ুন- টিকিট পাননি, পাঁচ বছরে যাদবপুরের জন্য কী করলেন মিমি চক্রবর্তী?
সবচেয়ে বড় কথা ২০.৬% সংখ্যালঘু ভোটার কোন দিকে যাবেন? তাপস রায় ঘনিষ্ঠরা বলছেন, "রাজাবাজার মৌলালি সহ উত্তর কলকাতার সংখ্যালঘুরা শুধু তাপস রায়কে দেখেই বিজেপিকে ভোট দেবে। 'দল' এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ না! উত্তর কলকাতার সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু সবাই সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে নিস্তার চাইছে!” উল্টেদিকে, সুদীপ ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, "এখানকার সংখ্যালঘুরা বেইমান না! তাঁরা জানেন, দিদি আছেন বলেই এখানে সংখ্যালঘুরা সুরক্ষিত। বিজেপি সিএএ, ইউনিফর্ম সিভিল কোড এনে সংখ্যালঘুদের শেষ করতে চাইছে! তাই সংখ্যালঘু ভোট দিদির সঙ্গেই থাকবে।"
আবার উত্তর কলকাতায় একটা বড় অংশের ভোটার হিন্দিভাষী হিন্দু। এই হিন্দিভাষী ভোটারদের সন্তুষ্ট করার জন্যই কিনা কে জানে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় আজকাল একটা বিসদৃশ পাগড়ি পরে থাকেন। এই অবাঙালি হিন্দিভাষী ভোটারদের একটা বড় অংশ আবার সরাসরি নরেন্দ্র মোদির সমর্থক! এই ভোটারদের কাছে আবার প্রার্থী গুরুত্বপূর্ণই নন। নরেন্দ্র মোদি গুরুত্বপূর্ণ। এটাও সত্যি, রাহুল সিনহা যতই বরাবরের 'পরাজিত'-র তকমা পান, গত লোকসভা নির্বাচনে ৭টির মধ্যে ২টি বিধানসভায় বিজেপিকে 'লিড' এনে দিয়েছিলেন তিনিই! জোড়াসাঁকোয় ৩৮৮২ ভোটে এবং শ্যামপুকুরে ২১৭০ ভোটে লিড নেয় বিজেপি! মানিকতলা বিধানসভাতেও দুর্দান্ত ফল করে। মাত্র ৮৬১ ভোটে মানিকতলায় লিড পায় তৃণমূল। যদিও তখনও উত্তর কলকাতার আরেক কিংবদন্তি নেতা সাধন পাণ্ডে জীবিত ছিলেন। তাঁর নিজস্ব একটা ভোট ছিল। তাঁর প্রয়াণের পর আজও মানিকতলায় ভোট না হওয়ার জন্য দোষী কে? তা নিয়ে বিজেপি-তৃণমূলের মধ্যে দড়ি টানাটানি চলছে। কিন্তু একথা রাজনৈতিক মহলের সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন, সাধন পাণ্ডের বিকল্প কোনও মুখ শুধু মানিকতলা নয় গোটা উত্তর কলকাতার রাজনীতিতেই এখনও অবধি তৃণমূল কংগ্রেস খুঁজে পায়নি।
উত্তর কলকাতার অলিগলিতে অনেক রহস্য আছে। ইতিহাস আছে। ইচ্ছে করলেই সেসব গলিতে হারিয়ে যাওয়া যায়। উত্তর কলকাতার রাজনীতিতে প্রাজ্ঞ দুই প্রবীণের লড়াইয়ে কে হারিয়ে যাবেন, আর কে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবেন তার শেষ মুহূর্তের লড়াই চলছে। আহিরীটোলা-বাগবাজার-শোভাবাজার ঘাটে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে। ৪ তারিখ কোন প্রবীণের রাজনৈতিক জীবনে সন্ধে নামবে,আর কার জীবনে গোধূলির মায়াভরা আলো ছড়িয়ে যাবে দেখার জন্য এখন তাকিয়ে গোটা বাংলা তথা গোটা দেশ!