আত্মহত্যা না কি..., মহুয়া রায়চৌধুরীর অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে আজও অজস্র প্রশ্ন

কী হয়েছিল সেই দিন? বাড়ির লোক বারবার বলেছেন, ছেলের জন্য দুধ গরম করতে গিয়ে স্টোভটা ফেটে যায়। সেই থেকেই গায়ে আগুন লাগে। মেনে নেওয়া যেত, যদি না রান্নাঘর থেকে অক্ষত, শুকনো অবস্থায় স্টোভটা উদ্ধার না করত পুলিশ।

দিনটা ১৯৮৬ সালের ২২ জুলাই। বাইরে শেষ আষাঢ়ের অবিশ্রান্ত বৃষ্টি, ভেতরে দহনের মর্মান্তিক মৃত্যুযন্ত্রণা। এই দুইয়ের মাঝে দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত নার্সিংহোমের ৭২২ নম্বর ঘর। অভিনেত্রী শুয়ে আছেন। কাঁধে তখনও ১৫টি ছবির ভার। অদূরে বসে রয়েছেন প্রিয় বান্ধবী রত্না ঘোষাল। ডাক্তারেরা হার মেনেছেন। অস্ফুট স্বরে শোনা গেল, "আমার গোলা রইল। ওকে দেখিস।" এই শেষ কথা। টানা ১০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে হার মানলেন মহুয়া। মহুয়া রায়চৌধুরী। শরীরে বহুলাংশে থার্ড ডিগ্রি দহনের চিহ্ন নিয়ে চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। মহুয়ার মৃত্যুতে তরুণ মজুমদার বলেছিলেন, জীবনে মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু মহুয়ার মতো মৃত্যু যেন কারও জীবনে না আসে। কী এমন হয়েছিল? উৎস জানতে হলে খানিক উজান তো বাইতেই হবে।

যে-সময় মহুয়া মারা যাচ্ছেন, সেসময় গৃহহিংসা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। আজও স্বনামধন্য পরিচালক প্রকাশ্যে মিডিয়ায় বলেন, থাপ্পড় মারার অধিকার না থাকলে কীসের প্রেম? বস্তুত খাতায়-কলমে এই অধিকার পুরুষেরই। কাজেই কী হয়েছিল, তা বারবার আলোচনা হওয়া দরকার। ইতিহাস কেবল তথ্য নয়, ইতিহাস সেই তথ্যকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও। কাজেই বারংবার আলোচনার মধ্যে দিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির চুলচেরা বিশ্লেষণে খোদ ইতিহাসকেও প্রশ্ন করা সম্ভব।

মহুয়ার অস্বাভাবিক মৃত্যু বাংলায় তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল। সংবাদমাধ্যম যেমন নানা 'রসালো' গল্প ফাঁদছিল, তেমনই পাশাপাশি চলছিল আইনি তদন্ত। শোনা যায়, স্বয়ং জ্যোতি বসু মামলাটি দেখাশোনা করছিলেন। মাত্র তেরো বছরের অভিনয়জীবনে কী পরিমাণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন অভিনেত্রী, তা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। মাত্র ২৮ বছরে মৃত্যু। সে মৃত্যুর তদন্ত তদারক করছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী— এই ঘটনাই মহুয়ার ওজন বোঝানোর জন্য যথেষ্ট। নীলাঞ্জন রায়চৌধুরীকেই মহুয়ার বাবা হিসেবে চিনত মানুষ। কিন্তু সেই সময়কার তদন্তরত এক সিআইডি অফিসার জানিয়েছিলেন, নীলাঞ্জন ও তার স্ত্রী মহুয়াকে পালন করেছিলেন। জন্মগতভাবে তিনি নাকি অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সন্তান। অর্ধেন্দু সেই সময়কার নামকরা এডিটর। এক অভিনেত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রেই মহুয়ার জন্ম। যদিও অর্ধেন্দু এবং সেই অভিনেত্রী বিয়ে করেননি কোনওদিনই। নীলাঞ্জন ছিলেন সে-সময় অর্ধেন্দুর অধঃস্তন। সহকারী সম্পাদক বা অ্যাসিন্ট্যান্ট এডিটর। অর্ধেন্দুর অনুরোধে নিঃসন্তান রায়চৌধুরী দম্পত্তি মহুয়াকে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করতে থাকেন।

আরও পড়ুন: অন্তরালে থাকার সময় কার সঙ্গে দেখা করতেন সুচিত্রা সেন!

নীলাঞ্জনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল, কিন্তু ব্যক্তিজীবনে খুব একটা সফল হতে পারেননি। ফলে সেই চাপ এসে পড়েছিল মহুয়ার ওপর। তাঁর যখন বছরসাতেক বয়স, তখন চৌধুরীপাড়ার জলসায় মেয়েকে দিয়ে নাচ করালেন নীলাঞ্জন। সুচিত্রা সেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরা ছিলেন সেই জলসায়। তাদের সামনেই 'দিল ভিল প্যায়ার ভ্যায়ার' গানের সঙ্গে নাচেন ছোট্ট মহুয়া। শুরু হয় শিল্পীজীবন। জন্মসূত্রে নাম ছিল শিপ্রা। এই মাচার নৃত্যশিল্পীর জীবনে প্রবেশ করে তাঁর নাম হলো, সোনালী রায়। নাচ ভালবাসতেন। কিন্তু পরিবারের আর্থিক সংস্থানের চাপ কাঁধে অনুষ্ঠানের চাপে শৈশব অচিরেই হারিয়ে গিয়েছিল মহুয়ার। সুখেন দাস তাঁর 'নয়া মিছিল'-এর জন্য পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের ঠিক পছন্দ হল না নায়িকার চরিত্রে মহুয়াকে। সুচিত্রা সেনের ব্যক্তিগত মেক আপ ম্যান জামাল ভাইয়ের কাছে মেয়েটির খবর পেয়েছিলেন তরুণ মজুমদার। তাঁর হাতে বহু নতুন নতুন মুখ বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা করে নিয়েছে। তেরো বছর বয়সি সোনালীকে 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ'-এর নায়িকা হিসেবে নির্বাচন করলেন তিনি। তবে নামের ব্যাপারে খুঁতখুঁতে ছিলেন ভদ্রলোক। এর আগে ইন্দিরা হয়েছিলেন মৌসুমী, এবারে সোনালী ওরফে শিপ্রা হলেন মহুয়া রায়চৌধুরী।

সন্ধ্যা রায়, মাধবী নিজের হাতে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিয়েছিলেন মহুয়াকে। মাধবী ছিলেন তাঁর মাধুমা। দূর দমদম থেকে ভোরের কলটাইমে হাজির হতে হলে থেকে যেতেন মাধবীর কাছেই। সকাল সকাল ভাত রান্না করে দিতেন। সেই খেয়ে কাজে বেরোতেন মহুয়া। এরপর এল 'দাদার কীর্তি'। পঞ্চাশ সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলেছিল সেই ছবি। এরপর আর পিছন ফিরে দেখতে হয়নি। একের পর এক হিট— 'বাঘবন্দী খেলা', 'সেই চোখ', 'কবিতা', 'ঘটকালি', 'বেহুলা লখিন্দর', 'পাকা দেখা', 'প্রিয়তমা', 'সুবর্ণলতা', 'শেষ বিচার', 'সুবর্ণগোলক', 'সাহেব', 'কপালকুণ্ডলা', 'ফাদার', 'ইমনকল্যাণ', 'অমৃতকুম্ভের সন্ধানে', 'প্রায়শ্চিত্ত', 'লাল গোলাপ', অঞ্জন চৌধুরীর 'শত্রু'— নব্বইটির ওপর সিনেমা করেছিলেন। সুচিত্রা, সুপ্রিয়া, সাবিত্রী, মাধবী, সন্ধ্যার পর অন্যতম সম্ভাবনাময় অভিনেত্রী বলা হতো তাঁকে। পোস্টারে তাঁর নামের জন্য লোকে সিনেমা দেখতে আসত। সমসাময়িক নায়ক-নায়িকাদের থেকে পারিশ্রমিকও ছিল অনেকটাই বেশি। এক-একটি ছবির জন্য লাখ টাকার কাছাকাছি পারিশ্রমিক নিতেন, এতটাই চাহিদা ছিল তাঁর। সেটে পায়রাদের দানা দিতেন অর্ধেন্দু, অবিকল সেই ভঙ্গিতেই নাকি মহুয়াও পরবর্তীতে পায়রাদের দানা খাওয়াতেন। খ্যাতির মধ্যগগনে তখন মহুয়া। লোকে দেখে বলত, বাবার স্বভাবগুণই পেয়েছে মেয়ে।

Mahua Roy Chowdhury

কখনও সুখী ছিলেন না মহুয়া

কৈশোরেই প্রেম করে তিলককে বিয়ে করেছিলেন মহুয়া। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমে তিক্ত হয়েছিল। ছেলের নাম রেখেছিলেন তমাল। ডাকনাম গোলা। গোলাকে খুবই ভালোবাসতেন মহুয়া। নীলাঞ্জন তখন মহুয়ার ম্যানেজার। তাঁর সঙ্গেও সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। গোটা পরিবারের বোঝা বইতে বইতে মহুয়া তখন ক্লান্ত। উপরন্তু পুরুষালি হম্বিতম্বি সহ্য করতে হয়। স্বাধীন জীবনযাপনের মাশুল গুণতে হয় কড়ায়-গণ্ডায়। অবসাদে ভুগছিলেন। শোনা যায়, আত্মহত্যার চেষ্টাও নাকি করেছিলেন। হঠাৎ করেই ঘটে গেল দুর্ঘটনা।

কী হয়েছিল সেই দিন? বাড়ির লোক বারবার বলেছেন, ছেলের জন্য দুধ গরম করতে গিয়ে স্টোভটা ফেটে যায়। সেই থেকেই গায়ে আগুন লাগে। মেনে নেওয়া যেত, যদি না রান্নাঘর থেকে অক্ষত, শুকনো অবস্থায় স্টোভটা উদ্ধার না করত পুলিশ। রান্নাঘর পরিপাটি। কোথাও বিস্ফোরণের ছাপ নেই। এত নিট অ্যান্ড ক্লিন স্টোভ বিস্ফোরণ পৃথিবীর কোথাও হয়েছে কিনা সন্দেহ! স্টোভে একফোঁটা কেরোসিন নেই। অথচ চিকিৎসকরা বারবার দাবি করেছেন, হাসপাতালে নিয়ে আসার সময় সারা গায়ে কেরোসিনের গন্ধ ছিল মহুয়ার। আর বাড়ি-ভর্তি পরিচারক-পরিচারিকা থাকতে পার্টি থেকে ফিরে ক্লান্ত অভিনেত্রী ছেলের জন্য দুধ গরম করতেই বা যাবেন কেন? উত্তর নেই। মহুয়ার চোখের কোণে, পিঠে এবং শরীরের আরও কয়েকটি জায়গায় কালশিটের দাগ। তবে কি মারধর করা হয়েছিল তাঁকে? তিলকের পা মচকে গিয়েছিল। কীভাবে? খুব স্বাভাবিকভাবেই একটা দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা থেকে যায়।

Mahua Roy Chowdhury

'দাদার কীর্তি' ছবিতে

শুধু তাই নয়, দুর্ঘটনার পরপর, মহুয়ার মৃত্যুর তিন-চারদিন আগে তিলক, নীলাঞ্জন এবং মহুয়ার যৌথ অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। মুখের ডানদিকে একটা বিচিত্র ক্ষতচিহ্ন ছিল মহুয়ার। যা বেদম প্রহারে মুখ ফেটে বা থেঁতলে গিয়েই‌ তৈরি হওয়া সম্ভব। নীলাঞ্জনের বয়ানে একটা কাপড় পুড়ে মুখের ওই স্থানে আটকে গিয়েছিল। ছাড়াতে সমস্যা হওয়ায় মহুয়া ওটা ব্লেড দিয়ে কেটে নিতে বলেন। সত্তর শতাংশ থার্ড ডিগ্রি বার্ন নিয়ে এই উপদেশ দিচ্ছেন মহুয়া, বিশ্বাসযোগ্য? প্রচণ্ড আগুন থেকে মহুয়াকে বাঁচাবার প্রাণপণ চেষ্টা করলেন তিলক ও নীলাঞ্জন। দু'জনই অক্ষত। শুধু নীলাঞ্জনের তিনটি আঙুলের মাথায় সামান্য আঘাত ছিল— বিশ্বাসযোগ্য? দুর্ঘটনা হলো রান্নাঘরে, অথচ বেডরুম এবং বিছানা খুব বাজেভাবে পুড়ে গেল। কীভাবে? স্টোভ ফেটে বিস্ফোরণ হলো, আর মহুয়ার পিঠ, তলপেট এবং উরু ঝলসে গেল—কোন যুক্তিতে এই বয়ান সমর্থন করা যায়? পরিবারের তরফ থেকে কোনও এফআইআর করা হয়নি, এমনকী, মরণোত্তর শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর যে পুরস্কার পেয়েছিলেন, তা তপন সিংহর কাছেই রয়ে গেল। পরিবারের কেউ সেই পুরস্কার সংগ্রহ করতে এলেন না কখনও। কেন? দামাস্কাস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেই পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল মহুয়াকে।

Mahua Roy Chowdhury

সম্ভাবনার অপমৃত্যু, আজও রহস্যময় মহুয়ার মৃত্যু

অথচ নিজের বয়ানে কাউকেই দোষী করেননি মহুয়া। সে কি ছেলের মুখ চেয়েই? রত্না ঘোষাল জানিয়েছিলেন, প্রচণ্ড মদ্যপ অবস্থায় সেদিন বাড়ি ফিরেছিলেন মহুয়া। সেই অবস্থাতেই আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি। এই বয়ানও পরিবারের বয়ানের সঙ্গে মেলে না। মাধবী মনে করেন, পরিবারের মধ্যেই শত্রু ছিল মহুয়ার। শ্বশুর এবং আরেকজন ব্যক্তিত্ব, যাঁকে কাকা বলে ডাকতেন মহুয়া। আত্মহত্যা এটি কোনও মতেই নয়, কারণ, "আত্মহত্যা হলে গায়ে আগুন লাগবে সামনে দিয়ে, পিছন দিয়ে লাগবে না। আমাদের কারও দশটা হাত নেই," বলেছিলেন মাধবী।

মহুয়ার মৃত্যুর তদন্ত খুব বেশি দিন হয়নি। হঠাৎ করেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে আজও ওঁর অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে বহু প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে। এমনকী, কখনও এমন তথ্যও ভেসে বেড়িয়েছে হাওয়ায়, নীল ছবির চক্রে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল মহুয়াকে। কে বা কারা জড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাই নিয়ে সংশয় রয়েছে আজও। এক প্রবল সম্ভাবনাময় অভিনেত্রীর এহেন মৃত্যু দগদগে ক্ষত হয়ে রয়ে গেল বাংলা সিনেমার জগতে।

 

 

More Articles