পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা মানুষ তিনি, সুলতান কোসেনের যে গল্প চোখে জল আনবে

World's tallest man: জন্ম থেকেই তাঁর উচ্চতার এই বৃদ্ধির কারণ হলো তাঁর মস্তিষ্কের পিটুইটারী গ্ল্যান্ডে একটি ছোট্ট টিউমারের অবস্থান।

ধরুন আপনার বাড়ির দোতলার ঘরের জানলাটা বন্ধ না করেই আপনি নীচে চলে এসেছেন, এদিকে সিঁড়ি চড়ে উপরে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করে আসতেও ইচ্ছে করছে না; এমতাবস্থায় আপনারই বাড়ির এক সদস্য উঠোনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দোতলার ঘরের জানলাটা বন্ধ করে দিলো বাইরে থেকে, কেমন লাগবে? আপনি কি চমকে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠবেন? নাকি অবাক হয়ে ভাববেন এটা কী করে সম্ভব? মই ছাড়া, সিঁড়ি ছাড়া, একতলার উঠোনে দাঁড়িয়ে দু'তলার ঘরের জানলা কীভাবে বন্ধ করে দিতে পারে কেউ?  পারে, ভারতবর্ষে না পারলেও, ভারতবর্ষ থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে তুর্কির এক ছোট্ট শহর মার্দিন-এর অধিবাসী বছর ৩৯ এর সুলতান কোসেন নামক এক ব্যক্তি এই কর্ম করতে পারেন অনায়াসে কারণ তিনি এই মুহূর্তে এই বিশ্বের সবথেকে লম্বা মানুষ। যার উচ্চতা প্রায় ৮ফুট ৩ইঞ্চি। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন, আট ফুট তিন ইঞ্চি অর্থাৎ ২৫১ সেন্টিমিটার।

সুলতান কোসেন এই মুহূর্তে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নিজের নাম লিখিয়ে ফেলেছেন বিশ্বের সবথেকে লম্বা মানুষ হিসাবে। বিশ্বের সব থেকে বড় হাতের পাতার অধিকারী হিসাবেও তিনি প্রণিধানযোগ্য। সুলতানের এক একটা হাতের পাতা প্রায় ১১ ইঞ্চির। অর্থাৎ একটি সাধারণ মানুষের হাতের পাতার প্রায় দ্বিগুণ। সুলতান এতটা লম্বা যে তিনি সাধারণ বাস, গাড়ি চড়তে পারেন না। তিনি সাধারণ দরজা দিয়ে প্রবেশও করতে পারেন না, বেরও হতে পারেন না। সাধারণ জামা কাপড় প্যান্ট জুতো তাঁর শরীরে আঁটে না। তিনি বিমানে যাতায়াত করা কালীন ইকোনমি বিভাগেও এঁটে ওঠেন না, তাই তাঁকে দেওয়া হয় ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট। সুলতান এতটা লম্বা যে তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটি দোতলা বাসের উপরের তলার যাত্রীদের সঙ্গে হাত মেলাতে পারেন, গল্প করতে পারেন। তাঁর হাতে একটি আইপ্যাডকে দেখলে মনে হয় সেটি একটি ছোট্ট আইফোন। সুলতান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বদলে দিতে পারেন বাড়ির উঁচু টিউবলাইট, জানালার পর্দা। সুলতানের দৃষ্টিশক্তি অন্যদের থেকে বেশি, তিনি এতটাই লম্বা যে তিনি যা দেখতে পান তাঁর উচ্চতা থেকে তা একটি সাধারণ মানুষের চোখেও পড়ে না। 

তাঁর এই মাত্রাতিরিক্ত উচ্চতার যেমন কিছু ভালো দিক আছে, তেমনই আছে কিছু খারাপ দিকও। ১০ ডিসেম্বর, ১৯৮২ সালে সুলতানের জন্ম। জন্ম থেকেই তাঁর উচ্চতার এই বৃদ্ধির কারণ হলো তাঁর মস্তিষ্কের পিটুইটারী গ্ল্যান্ডে একটি ছোট্ট টিউমারের অবস্থান। যা তাঁকে দৈত্যাকার করে তুলেছে দিনের পর দিন। ছোট থেকেই সুলতানের উচ্চতার কারণে তিনি বন্ধু পাননি, সাধারণ স্কুলে পড়াশোনা বন্ধ হয়েছে, রাতে ঘুমানোর সময় শোওয়ার বিছানা থেকে পা ঝুলে পড়েছে সুলতানের, ভালোবাসার মানুষ খুঁজতে তাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে, তিনি সহজে যাতায়াত করতে পারেন না এ'খান থেকে সেখানে কারণ তিনি কোনও গাড়িতেই এঁটে ওঠেন না। অবশেষে তিনি আমেরিকা যান নিজের চিকিৎসা করাতে, নিজের ক্রমবর্ধমান উচ্চতাকে আটকে রাখতে। উচ্চতা নিয়ে অসুবিধার কথা জিজ্ঞেস করা হলে সুলতান বলেন, আমায় সব সময়ে একটি লাঠির সাহায্যে হাঁটতে হয়। ছোটবেলায় একবার পা ভেঙে গেলে ১০ দিন হসপিটালে কোনও চিকিৎসা পাইনি। কারণ আমার দৈর্ঘ্যের কোনও বিছানা ছিল না সেই হাসপাতালে। ১০ দিন ছটফট করেছি যন্ত্রণায়। বিয়ে হওয়াটাও সম্ভব হচ্ছিল না উচ্চতার  জন্য। অবশেষে যাঁর সঙ্গে বিয়ে হয় তিনি কেবল আরবি ভাষায় কথা বলতে পারেন, তুর্কিশ ভাষা না বোঝেন না বলেন।"

আরও পড়ুন-‘আমায় রবি ঠাকুর বানিয়ে দে মা!’ মোহন ভাণ্ডারিকে দেশ চিনল যে গল্পে

সহজ নয়, জীবন নামক নদীর স্রোত যদি আজন্মকাল বিপরীতে বয়ে যায়, সে নদীতে আজন্মকাল টিকে থাকা সহজ নয় মোটেও। কিন্তু সুলতান কোসেনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো। সুলতান কখনও নিজের জীবন নিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ করেননি, কখনও জীবনের ওপর অসন্তুষ্ট হননি। বরং তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন নিজের স্রষ্টাকে, হাতজোড় করে বলেছেন 'আমি এই জীবনের জন্য কৃতজ্ঞ আমার ঈশ্বরের কাছে।'

সুলতান সব সময়ে হাসিমুখে থাকেন। নতুন মানুষজন তাঁর সাথে দেখা করতে গেলে আন্তরিকতার ওমে ছুঁয়ে নেন তাঁদের অন্তরাত্মা। বুকে জড়িয়ে ধরেন, ফ্লাইং কিস দেন। হাসিমুখে গল্প করেন, ১০১টা প্রশ্নের উত্তর দেন একটুও বিরক্ত না হয়ে। সুলতান পৃথিবীর ১২৮টা দেশ ঘুরে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই। বপন করেছেন হাজার হাজার বন্ধুত্বের বীজ। 

বন্ধুরা বলে সুলতান কোসেন আসলে পৃথিবীর সব থেকে লম্বা মানুষই নন, তিনি পৃথিবীর সব থেকে বড় হৃদয়ের অধিকারীও বটে। জীবনের সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে, ঝড়ের রাতের তাল গাছ কীভাবে হেসে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তা সুলতান কোসেন জানেন। যারা তাঁকে আলাদা করে দিয়েছিল  শরীরের অতিকায়ত্বের জন্য, যাঁরা তাঁকে বন্ধু হিসাবে অস্বীকার করেছিল এক সময়, যারা তাকে একলা করে দিয়েছিল, যাদের দেওয়া দুঃখ তাঁর গাল বেয়ে মাটি ছুঁয়েছিলো নিস্তব্ধে, তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, 'মানুষকে তাঁর শারীরিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে বিচার করতে নেই। মানুষ সুন্দর না অসুন্দর তার বিচার করে তাঁর মন। আমাদের উচিত একে অন্যকে ভালোবাসা, ঘেন্না করা নয়। আলাদা করে দেওয়া নয়, বুকে জড়িয়ে ধরা'।

আর এভাবেই পৃথিবীর বুকের সবথেকে লম্বা মানুষে পরিণত হন পৃথিবীর সব থেকে উঁচু মানুষে। সুলতান কোসেনের আয়ু এমনই দীর্ঘ হোক।

তথ্যসূত্র : গিনিস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের ওয়েব পেজ

More Articles