'শেষে সব আকাশে মিলায়': বিবেক-অনুধ্যান
নীলাকাশে ভাসে মেঘকুল,
শ্বেত কৃষ্ণ বিবিধ বরণ—
তাহে তারতম্য তারল্যের
পীত ভানু মাঙিছে বিদায়,
রাগচ্ছটা জলদ দেখায়।বহে বায়ু আপনার মনে,
প্রভঞ্জন করিছে গঠন—
ক্ষণে গড়ে, ভাঙে আর ক্ষণে—
কতমত সত্য অসম্ভব—
জড়, জীব, বর্ণ, রূপ, ভাব।ঐ আসে তুলারাশি সম,
পরক্ষণে হের মহানাগ,
দেখ সিংহ বিকাশে বিক্রম;
আর দেখ প্রণয়িযুগল;
শেষে সব আকাশে মিলায়।নীচে সিন্ধু গায় নানা তান;
মহীয়ান্ সে নহে, ভারত!
অম্বুরাশি বিখ্যাত তোমার;
রূপরাগ হ’য়ে জলময়
গায় হেথা, না করে গর্জন।
--(সাগর বক্ষে / স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা ৬ষ্ঠ খণ্ড)
মিত-আয়তন কবিতাটি প্রায়শই প্রখ্যাত বিবেকানন্দ-গবেষকদের আলোচনার কেন্দ্রে স্থান পায়নি। প্রায়শই অনালোচিত, অনুল্লিখিত এই কবিতা বিপুল কলেবর বিবেকানন্দ-সাহিত্যের একপাশে পড়ে আছে কোনোমতে। এমনটা হওয়ার সম্ভাব্য কারণ অনুমান করা যায়। প্রথমত, এ কবিতায় নেই কোনো বলদৃপ্ত বিঘোষণা—যে বিঘোষণা ও বিবেকানন্দ প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছেন গত শতাব্দী জুড়ে। সেই প্রফেটিক বিস্ফার ও নিনাদ এ কবিতায় নেই। দ্বিতীয়ত, এই কবিতা রিলিজিয়াস ইউটিলিটেরিয়ানিজম বা ধর্মীয় উপযোগিতাবাদের ব্যাদিত আননে খাদ্য তুলে দিতে অপারগ; প্রথাগত ধর্মভাবনা কিংবা প্রথাপ্রকীর্ণ প্রতীক-উপাসনার উপযোগী চিন্তা এখানে নেই—তথাকথিত ‘ধর্মভাবুক’ মানুষ এ কবিতা থেকে কী আর পাবেন? তৃতীয়ত, এ কবিতার অন্তর্নিহিত দর্শন কবিতাটির চিত্রকল্পের আড়ালে লুকোনো; চিত্রকল্পের সেই আড়াল সরিয়ে দর্শনে উপনীত হওয়ার আয়াস প্রায়শই কেউ করেননি। চতুর্থত, এ কবিতা কবির এমন এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত, যে-অভিজ্ঞতা বাঙালির, বিশেষত আজকের বাঙালির অভিজ্ঞতা-বৃত্তের বাইরে বললেই চলে। জাহাজে করে কে আর এখন বিদেশে যায় বা বিদেশ থেকে ফেরে? বাঙালির চাঁদ-সদাগরি যুগ গিয়েছে। কবিতা-উপভোক্তার অভিজ্ঞতা যদি কবির অভিজ্ঞতা থেকে বহু দূরে অবস্থিত হয়, তখন অনুভূতির ঐক্যসেতু নির্মাণ কঠিন হয়ে পড়ে। পঞ্চমত, সাহিত্যবৃত্তস্থ আমাদের অনুদ্ধারণীয় স্নবারি, যার ফলে আমরা বিবেকানন্দকে একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে ধরে নিয়েই শতাব্দীব্যাপী আত্মতৃপ্তিতে ভুগছি, তাঁর রচনার অনুপম সৌন্দর্য, ভাবের গভীরতা ও ভাষার শৈলীকে যথাযথ মূল্য দিতে আমরা অপারগ। যদি তা পারতাম, তাহলে বিবেকানন্দের সাহিত্যকৃতির মধ্যে আমরা এক আদিত্যবর্ণ কবিপুরুষকে প্রত্যক্ষ করে আমাদেরই সমূহ সম্ভাবনার প্রাত্যহিক অপমৃত্যু থেকে উত্তীর্ণ হতে পারতাম। এই শেষ কারণটি অবশ্য সমগ্র বিবেকানন্দ-সাহিত্যেরই প্রতি স্নব বুদ্ধিজীবীদের শতাব্দী-ব্যাপী ঔদাসীন্য ও উপেক্ষার হেতু বললেও ভুল হয় না।
‘সাগর বক্ষে’-কবিতাটি লেখা হয়েছে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে। উনিশ ও বিশ শতকের সন্ধিমুহূর্তে। স্বামী বিবেকানন্দ তখন দ্বিতীয়বার পাশ্চাত্য থেকে ভারতে ফিরে আসছেন। জাহাজের ডেকে বসে এ কবিতা লেখা এবং জাহাজ তখন ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করছে। অর্থাৎ ভৌগোলিকভাবে এ কবিতার কবি তখন পুব ও পশ্চিমের মিলন বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছেন। রচনার সময় অস্তরাগরঞ্জিত সন্ধ্যাকাল। দিন যাচ্ছে, রাত্রি আসছে, অতএব সময়ের মাপেও সে এক সন্ধিমুহূর্ত। পারি-প্রদর্শনীর অন্তে ফ্রান্স থেকে জার্মানি হয়ে কনস্টান্টিনোপল দেখে মিশরের কায়রোতে উপনীত হয়ে, সেখান থেকে নেপলস-এর পোর্ট টাউফিক থেকে ভারতের জাহাজ ধরেছিলেন বিবেকানন্দ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ফরাসি সাহিত্যিক জুল বোয়া, মাদাম এমা কালভে ও জোসেফাইন ম্যাকলাউড। তিনি যখন পূর্বপরিকল্পিত ভ্রমণ অসমাপ্ত রেখে একাকী সাত-তাড়াতাড়ি ভারতে ফিরে আসতে চাইলেন, তখন মাদাম কালভে তাঁর এত তাড়াতাড়ি ভারতে ফিরতে চাওয়ার কারণ কী, জিজ্ঞাসা করেন। উত্তরে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘I want to go back to India to die.’ অর্থাৎ, যেভাবেই হোক, তিনি টের পেয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যু আসন্ন, তিনি জীবন ও মহাজীবনের সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে আছেন। এবং সেই মানসিক অবস্থাতেই এই কবিতা লেখা। কাজেই ‘সাগর বক্ষে’ কবিতাটি আক্ষরিক অর্থেই এক সন্ধিলেখ— যুগসন্ধি, দেশসন্ধি, কালসন্ধি ও জীবনসন্ধির কবিতা।
জাহাজের ডেক থেকে দেখা অস্তরাগে মাখা আকাশের রূপ এ কবিতার বিভাব-স্তবক। নিসর্গদৃশ্যটি আয়ু-অবশেষ অপরাহ্ণ বা আসন্ন সন্ধ্যার। এর পটভূমিকা রচনা করেছে নিরবয়ব নীলাকাশ। অর্থাৎ, পটভূমিটি মূর্ত নয়, প্রায় বিমূর্ত। এবং অনন্ত; কেননা প্রকৃতিতে অনন্তের বর্ণ নীল। সেই আকাশের বুকে মেঘ ভেসে যায়। মেঘগুলি নিয়তাকার হয় না, তাদের আকার পরিবর্তনশীল। মূর্ত হয়েও মেঘমালা অনিত্য, ক্ষণভঙ্গুর। আমাদের জীবন যেমন। জীবনের পটভূমি চির উদাসীন, অন্তহীন। অন্যদিকে জীবনের অভিজ্ঞতা ও ঘটনাসমূহ মূর্ত ও বাস্তব হয়ে দেখা দিলেও তার কিছুই স্থায়ী নয়। এক অজ্ঞাত, অনন্ত পটভূমির উপর ক্ষণভঙ্গুর সান্ত ঘটনাস্রোতেরই অন্য নাম জীবন।
‘শ্বেত, কৃষ্ণ বিবিধবরণ’ এই সব মেঘ। জীবনের ঘটনাসমূহের মতই বিচিত্র আকর্ষক বর্ণ তাদের। শুধু বর্ণ নয়, তাদের গভীরতাও বিচিত্র বটে! নানারকম শেড। বিবেকানন্দ লিখেছেন অনুপ্রাস-অলংকৃত শব্দবন্ধে—‘তাহে তারতম্য তারল্যের’। অর্থাৎ, অভিজ্ঞতাগুলির অভিঘাত ভিন্ন ভিন্ন। প্রতিটি মেঘ, প্রতিটি অভিজ্ঞতাই অনন্য। তাদের রূপ যেমন ভিন্ন, তেমনই উপরিতল থেকে গভীর দেশ— মনের নানা স্তর তারা স্পর্শ করে থাকে।
এসব অনেক দেখা হল। সমস্ত জীবন ধরে কত কিছু যে দেখা হল, ছুঁয়ে যাওয়া হল। এসবের থেকে সম্পূর্ণভাবে বিবিক্ত সূর্য ডুবে যাচ্ছে পরম উদাসীনতায়। ‘পীত ভানু মাঙিছে বিদায়’। অস্তগামী এই উদাসীন সূর্য জীবনের আজন্মপ্রয়াণ অভিজ্ঞতার সাক্ষীস্বরূপ। সেই সাক্ষী লীন হতে চলল নিরবয়ব আকাশের ভিতর। যেন পুনরাবির্ভাব আর হবে না। আরেকটু পরেই এসব অভিজ্ঞতারাশিও মিলিয়ে আসবে। সেই সূর্য এখন উদয়রবি নয়, মধ্যাহ্নদীপ্ত আরক্তসুন্দর মার্তণ্ডও নয় আর, এখন তা অস্তাচলগামী ‘পীত ভানু’—বিগত মোহ।
তবু নির্বাণোন্মুখ সত্তার সম্মুখেও জীবন তার রূপ দেখিয়ে চলে আজও এই মেঘেদের মতই। কিন্তু কোথা থেকে পেল তারা সেই রূপ? সেই রূপ কি তাদের নিজস্ব? প্রকাশ কি নিজস্ব? না। ‘রাগচ্ছটা জলদ দেখায়’। সূর্যের আলোতেই তারা আভাসিত। তমেব ভান্তং অনুভাতি সর্বম্। তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি। এই মেঘেদের নিজস্ব কোনো আকার নেই, রূপ নেই। তারা আসলে সৌরশক্তিরই ঘনীভূত রূপ। সূর্যের থেকেই আলো ধার করে নিয়ে, শক্তি ধার করে নিয়ে তারা ফুটে ওঠে চোখের সামনে। আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলিও তাই। তাদের কিছুমাত্র স্বাতন্ত্র্য নেই। তারা আমার সত্তাতেই সত্তাবান। আমার চেতনা থেকেই তাদের আবির্ভাব, বিকাশ। আমিই তাদের লয়স্থান। পীত ভানু কি আজ তা জেনেছে? জেনেছে বলেই মনে হয়, তাই তো সে উদাসীন হেসে চিরবিদায় জানিয়ে ডুবে যাচ্ছে না-ফেরার দেশে!
কিন্তু শুধু আলো নয়, মেঘের ঋণ জলের কাছেও। সে জলধর, জলবাহ, জলদ। বিবেকানন্দ বেছে নিয়েছেন মেঘের ওই উপাদান-নির্দেশক প্রতিশব্দটিই। ‘রাগচ্ছটা জলদ দেখায়’। এবং মেঘের এই রূপবিভঙ্গ, এই বিচিত্র রূপনির্মিতিতে বায়ুর ভূমিকাই প্রধান। বায়ু একেবারেই শিল্পী-স্বভাব। ‘বহে বায়ু আপনার মনে’। বায়ু স্বাধীনতাপ্রিয়; তার এই স্বাধীনতাপ্রিয়তা, এই আপন মনে উদাসীন বয়ে যাওয়া এই সবই শিল্পীর স্বধর্ম। কিন্তু পীত ভানু যেমন উদাসীন, বায়ুও কি তেমনই উদাসীন? না। পীত ভানু যেন দার্শনিক, আর প্রভঞ্জন যেন শিল্পী—সে যেন চিত্রী বা ভাস্কর। সে শুধু উদাসীন হয়ে ডুবে যায় না, সে নিরন্তর আপন মনে সৃজন করে চলে। ‘প্রভঞ্জন করিছে গঠন, ক্ষণে গড়ে, ভাঙে আর ক্ষণে’। তার কোনো তৃপ্তি নেই, কখনই সে তার নিজের সৃষ্টিতে সন্তুষ্ট হতে পারে না। এই অন্তহীন অতৃপ্তিই শিল্পসৃষ্টির প্রেরণা। আমাদের মনে পড়বে আমাদের সময়ের এক বিশিষ্ট কাব্যগ্রন্থের নাম: ‘ছবি আঁকে, ছিঁড়ে ফ্যালে’। এই যে গঠন করার পরক্ষণেই ভেঙে ফেলা—‘ক্ষণে গড়ে, ভাঙে আর ক্ষণে’—এ আরেকপ্রকার ঔদাসীন্য, যা জগৎ-সাক্ষী সূর্য বা পীত ভানুর ঔদাসীন্য নয়। দ্রষ্টার উদাসীনতা নয় এ, এই উদাসীনতা শিল্পীর; এ লিপ্ত অথচ নির্লিপ্ত, সংসক্ত অথচ নিস্পৃহ মনোভূমিকা থেকে সমুদ্ভূত।
ধুলো, আলো, জল, হাওয়া—এই সব কিছুর সহাবস্থানজনিত উপস্থিতিই মেঘকে সম্ভব করেছে। সুতরাং মেঘের উদ্ভব বা বিলয় এই সব শর্তাধীন। মনে পড়বে এখনই তথাগত-কথিত ‘প্রতীত্য-সমুৎপাদ’ বা ডিপেন্ডেন্ট কো-অরিজিনেশন-এর দার্শনিক তত্ত্ব। আসলে মেঘ বলে কিছু নেই। যা আছে, তা হচ্ছে এই সব শর্তসমূহের সহাবস্থান। এ কবিতায় মেঘমালার বিচিত্র রূপাবলী জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতামালারই রূপক। মেঘের আবির্ভাব, তিরোভাব যেমন ধুলো-আলো-জল-হাওয়াসাপেক্ষ, জীবনের অভিজ্ঞতাগুলিও জড়-শক্তি-চেতনা সাপেক্ষ। ধুলো আর জল এখানে জড় শারীরিক উপাদানের রূপক। হাওয়া ইচ্ছাশক্তির রূপক, শোপেনহাওয়ার যাকে ‘উইল-পাওয়ার’ বলেছিলেন এবং এই ‘উইল-পাওয়ার’-কেই জীবনের চরম তত্ত্ব বলে চিহ্নিত করে শোপেনহাওয়ার ভুল করেছিলেন। কেননা ‘উইল-পাওয়ার’ বা ইচ্ছাশক্তির উপরেও জাগ্রত মানুষের অনাবিল চেতনা, যা সাক্ষীর মতো, দ্রষ্টার মতো নির্নিমেষ চোখ মেলে আজন্মপ্রয়াণ জীবনের অভিজ্ঞতাগুলিকে নিঃস্পৃহভাবে দেখে চলে।
‘কত মত সত্য অসম্ভব’। শিল্পীস্বভাব বায়ু, যা এই কবিতায় ইচ্ছাশক্তির রূপক, গড়ে তুলছে কত না রূপ আকাশের গায়। আশ্চর্য মেঘের খেলায় রচিত হচ্ছে নানা আকার—কখনও অজস্র তুলো স্তূপীকৃত হয়ে আছে মনে হচ্ছে, কখনও যেন একটা বিশাল আকার অজগরের মতো মহাসর্প ফণা তুলে আছে, তার একটু পরেই হয়তো-বা কেশর-ফোলা সিংহ মুখ হাঁ করে আছে আকাশে, তার পরে আবার যেন প্রেমিক-প্রেমিকা আলিঙ্গননিরত হয়ে আকাশপটে আভাসিত হচ্ছে। এই সবই বিবেকানন্দের বর্ণনায়:‘কত মত সত্য অসম্ভব’।
যা সত্য, তা অসম্ভব হবে কীভাবে? যা সম্ভাবিত হয়, আমরা তো তাকেই সত্য বলে থাকি। আর যা একান্তই অসম্ভব, তাকে আমরা বলি অলীক। ‘বৃত্তাকার চতুষ্কোণ’ অলীক, কেননা তা অসম্ভব। ‘আকাশকুসুম’ অলীক, কেননা তা অসম্ভব। তাহলে ‘সত্য অসম্ভব’—এই দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত শব্দ পাশাপাশি বসিয়ে বিবেকানন্দ কী বোঝাতে চাইছেন? এ কি তাহলে শুধুই কোনো অক্সিমোরোন বা বিরোধাভাস?
তা যে নয়, তা বোঝা যায় ওই মেঘচ্ছবি আর আকাশকুসুমের তুলনা করলেই। আকাশকুসুম কখনও হয় না, তা দেখা যায় না বা অনুভবও করা যায় না। কেউ আকাশকুসুম প্রত্যক্ষ করেনি। কিন্তু মেঘের এইসব ছবি—তুলারাশি, মহানাগ, উদ্যত সিংহ কিংবা প্রণয়ীযুগল—আমরা আকাশপটে এদের প্রত্যহ দেখতে পাই। দেখতে পাই, কিন্তু সেই দেখার সঙ্গে সঙ্গে একথাও আমরা জানি যে, এই তুলো, এই সাপ, এই সিংহ, এই যুগল—এরা বাস্তব তুলো-সাপ-সিংহ-যুগল নয়। একটু পরেই হাওয়া লেগে ওদের আকার পালটে যাবে। অথচ এখন যে ওদের দেখছি, সেটা তো সত্যি। কাজেই একে একেবারে অলীক বলা যাচ্ছে না। আবার স্থায়ী কোনো পরম সত্যও বলতে পারছি না এদের। ক্ষণপরেই পালটে যাবে, তুলারাশি জুড়ে জুড়ে উদ্যতফণা মহাসর্পের আকার নেবে, মহাসর্প আরেকটু স্ফীত হয়ে কেশরফোলা সিংহের চেহারা পাবে, সেই সিংহাকৃতি মেঘ দু-টুকরো হয়ে আলাপরত প্রেমিক-প্রেমিকার মতো দেখাবে। শেষে সব ছবি ছিন্নভিন্ন হয়ে মিলিয়ে যাবে আকাশে। তুলোর সেই স্তূপ কোথায় গেল? সেই উদ্যতফণা মহানাগ কোথায় গেল? সেই গর্জনকারী সিংহ কোথায় গেল? সেই প্রণয়ী প্রণয়িনীই বা কোথায় গেলেন? আরে, ওরা ছিলই না তো যাবে কোথায়? ছিল না, অথচ দেখছিলাম। যা বস্তুত নেই, অথচ যা দেখা যায় কিংবা অনুভূত হয়, তাকে ‘মায়া’ বলে। ‘সৎ ন অপি, অসৎ ন অপি, উভয়াত্মিকা নো’—বলে আচার্য শঙ্কর যে অনির্বচনীয়রূপা মায়ার কথা বলেছেন, মেঘলোকের এসব ছবি, তারই অভিব্যক্তি। তাদের দেখছি, তাই তারা আপেক্ষিকভাবে সত্য। তারা এক কল্পবাস্তবতার নির্মাণ, তাই শেষ পর্যন্ত অসম্ভব। ওই আকাশের গায়ে বস্তুত মেঘ ছাড়া কিছুই নেই। আমরাই ওই মেঘের খেলা দেখে তুলা, সাপ, সিংহ, নারী, পুরুষ—এইসব উষ্টুম ধুষ্টুম কল্পনা করেছি। আর যা কল্পনা করছি, আকাশপটে তাই-ই দেখে চলেছি।
আপত্তি উঠতে পারে, নিসর্গদৃশ্যের বর্ণনামূলক একটি নিরীহ কবিতা নিয়ে আমরা অযথা দার্শনিকতা করছি। এই আপত্তি সানন্দে মেনে নিয়ে আমিও এই আলোচনা, এই ব্যাখ্যা প্রত্যাহারই করে নিতাম। বস্তুত, বিবেকানন্দকে কেবল দার্শনিক হিসেবে দেখতে আমার ভালো লাগে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই আপত্তি মেনে নেওয়া গেল না, দার্শনিক এই ব্যাখ্যা প্রত্যাহার করাও গেল না, কারণ বিবেকানন্দ নিজেই এর পর ওই দার্শনিক ইঙ্গিত দিয়ে বসেছেন। ‘কত মত সত্য অসম্ভব—জড়, জীব, বর্ণ, রূপ, ভাব’। অর্থাৎ এতক্ষণ তিনি শুধু অস্তাভাদীপ্ত আকাশের গায়ে মেঘের অলস খেলার ছবি আঁকছিলেন না। মেঘেদের খেলায় যেসব ছবি ফুটে উঠছিল, তা আসলে আমাদেরই জীবনের ছবি। এ শুধু প্রাতিভাসিকেই নয়, আমাদের ব্যবহারিক জীবনেও ঠিক এটাই ঘটে চলেছে। তুলারাশির মতো ওই মেঘ জীবনের আরামের ছবি, সুখের রূপক। যে-সুখ আমরা জীবনের পথে চলতে চলতে হারাই, জীবনের ভয়াবহ দাবি বিষাক্ত সর্পের মতো আমাদের ছোবল দিতে আসে। সেসব বিপদ, বাধার বিপরীতে আমাদেরই দাঁড়াতে হয় আত্মমর্যাদার মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে, প্রকাশ করতে হয় সিংহের বিক্রম। কারও কারও জীবনে সেসব বাধার অচল হয়তো চূর্ণ বিচূর্ণ হয়, কেউ কেউ-বা সেই যুদ্ধে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় নিজেই। তারও পরে কারও জীবনে আসে হয়তো একটু প্রণয়ের আস্বাদ। সেও জমে উঠতে না উঠতেই সময় ফুরিয়ে আসে। হারিয়ে যায় সবকিছুই। তুলা-সাপ-সিংহ-প্রণয়ী আমাদেরই জীবন-অভিজ্ঞতার বিভিন্ন পর্যায়ের ছবি। ‘শেষে সব আকাশে মিলায়’। আমরা বুঝতে পারি, অস্ত-আকাশের ওই মেঘের খেলার মতই আমরা এতদিন এক জীবনস্বপ্নে বিভোর হয়ে ছিলাম। বড় সত্য মনে হয়েছিল তাদের, এখন বুঝি জীবনের সুখ, ব্যথা, সংগ্রাম, প্রণয়—শেষ পর্যন্ত কিছুই বাস্তব নয়। যেন এক মহাশক্তিধর ঐন্দ্রজালিকের জাদুদণ্ডে নির্মিত ফ্যান্টাসম্যাগোরিয়া—মোহাবিষ্ট নেত্রে দৃষ্ট ছায়ামূর্তি সমূহের মিথ্যা ধারাবাহিক প্রবাহ। এখন সেসব মিলিয়ে গেছে আকাশে, যে আকাশ আমার স্বরূপ।
অনেক অনেক দিন আগে আমাদের দেশে এই আকাশ নিয়ে স্তবকের পর স্তবক কবিতা লেখা হয়েছিল অবধূত-গীতায়। সেসব কবিতায় এই আকাশের রূপক-এ বোঝাতে চাওয়া হয়েছিল মানুষের সীমাহীন স্বরূপকে। তেমনই একটি স্তবকে পাই অবধূত-গীতার কবি বলছেন:
মায়াপ্রপঞ্চরচনা ন চ মে বিকারঃ
কৌটিল্যদম্ভরচনা ন চ মে বিকারঃ।
সত্যানৃতেতিরচনা ন চ মে বিকারো
জ্ঞানামৃতং সমরসং গগনোপমোঽম্ ।।
—এই মায়ারচিত বিশ্বপ্রপঞ্চ আমার বিকার নয়। এই দম্ভ ও কুটিলতায় সৃষ্ট জীবন আমার বিকার নয়। এই সত্য ও অসত্যের মিশ্রণে গড়া জীবনের রূপচ্ছবি আমার বিকার নয়। আমি যে প্রজ্ঞার অমৃত, সমরস সমসত্ত্ব আকাশের মতন নির্লেপ!
সমস্ত জীবন ধরে বিবেকানন্দ তাঁর নিরঞ্জন দৃষ্টি মেলে জীবনের এইসব ছবি দেখেছেন। সুখ এসেছে, সাফল্য এসেছে, দুঃখ এসেছে, সীমাহীন অপমান এসেছে, প্রীতি এসেছে, বিক্রম এসেছে। তাঁর মতন করে আর কে ভুবন ভ্রমেছেন? কে আর দেখেছেন তাঁর মতন করে জীবনের নানা বর্ণ, রূপ, ভাব? ভূমধ্যসাগরে ভাসমান সেই জাহাজের ডেকের নীচে সমুদ্রের ঢেউশিশুরা যেন অন্তহীন কলতান করছে। পাশ্চাত্য জীবনের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছে বিবেকানন্দের। তাদের নানা ভাবের হারমনি, নানা জীবনস্রোতের মূর্ছনা তিনি উপলব্ধি করেছেন। সে ঐকতান, সে মূর্ছনা, পাশ্চাত্যের সেই জীবনপিপাসা যেন ডেকের নীচে অশান্ত ঊর্মিমালার লালায়িত মুখ। কিন্তু তাতে বৈচিত্র্য থাকলেও, মহত্ত্ব নেই। ‘নীচে সিন্ধু গায় নানা তান; মহীয়ান সে নহে’। আজ জীবনের সব খেলা দেখে তিনি ঘরে ফিরছেন। ফিরছেন সেই ভারতে, যেখানে চিরকাল জীবনের এই অতৃপ্ত মূর্ছনার ঊর্ধ্বে শান্ত সমাহিত গগনোপম সত্যকে প্রাণসার বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি চলেছেন বাত্যাবিক্ষুব্ধ ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে সেই শান্ত ভারতসমুদ্রের দিকে, যাকে সম্বোধন করে তিনি লিখছেন— ‘অম্বুরাশি বিখ্যাত তোমার’। যেখানে রূপ গলে যায় জলে, যে জলরাশি ‘গায় হেথা, না করে গর্জন’। সকল পরাক্রান্ত গর্জনের পর এক নিরবচ্ছিন্ন শান্ত সঙ্গীতের সেই আকাশ—শান্তং শিবম্ অদ্বৈতম্—সেই তাঁর স্বরূপ, যাতে তিনি লীন হবেন এবার, পরিত্যাগ করবেন নশ্বর এই শরীরের নির্মোক। এবার দীপাধার চূর্ণ হবে, নিরাধার শিখা শূন্যে প্রেমে ও প্রেরণায় প্রদীপ্ত হয়ে আলোক ও উত্তাপ ছড়াবে অনন্তকাল।