একজন নয়, গোপাল ভাঁড় আসলে একাধিক ব্যক্তি! ঐতিহাসিক এই চরিত্রকে ঘিরে হাজারও রহস্য
বাংলায় গোপাল ভাঁড়ের মতো কিংবদন্তি খুব কম রয়েছেন এবং বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, বাংলার বেশিরভাগ মানুষের কাছে গোপাল ভাঁড় সদাহাস্যময়, উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী এক রক্তমাংসের মানুষ।
বাংলার মানুষের কাছে খুবই পরিচিত একটা নাম গোপাল ভাঁড়। হাস্যরস, কৌতুক এবং উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার জন্য লোকমুখে এবং বিভিন্ন লেখায় তাকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য গল্প। যদিও এই বিখ্যাত মানুষটিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে অসংখ্য বিতর্ক। তার অস্তিত্ব নিয়ে রয়েছে সবথেকে বড় বিতর্ক। মানুষের পরিচিত গোপাল ভাঁড় কি সত্যি বাস্তবের কোনও চরিত্র নাকি শুধুই তিনি শুধু এক কাল্পনিক চরিত্র?
গোপাল ভাঁড় যে আসলে বাস্তবের এক চরিত্র সেই সংক্রান্ত প্রচুর তথ্য রয়েছে। বিভিন্ন নথি এবং জনশ্রুতি অনুযায়ী গোপাল ভাঁড়ের জন্ম হয়েছিলো নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের কাছে ঘূর্ণিতে। যদিও বিরোধী কিছু তথ্য অনুযায়ী মুর্শিদাবাদে গোপালের জন্ম হয়েছিল। এই জন্মস্থান সম্পর্কিত বিবাদ ছাড়া গোপালকে বাস্তব জগতের মানুষ হিসেবে প্রমাণ করা সমস্ত তথ্য এবং নথি গোপালের জীবন সম্পর্কে মোটামুটি একইরকম ঘটনা বলে। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল গোপালচন্দ্র প্রামাণিক। ছোটবেলায় গোপাল তাঁর মা, বাবাকে হারিয়েছিলেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার সভাসদ গোপাল হাস্যরস, কৌতুকের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এই হাস্যরস তাঁকে গোপাল ভাঁড় নাম এনে দিয়েছিল কারণ তিনি রাজসভার ভাঁড়ের ভূমিকা পালন করতেন। যদিও শুধুমাত্র মানুষকে হাসানোর মধ্যে তাঁর কাজ সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর প্রখর বুদ্ধিমত্তার কারণে মহারাজ অনেক সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতেন। কৌতুকের সঙ্গে তাঁর উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় তাঁকে ঘিরে তৈরি হওয়া বহু ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারি। লোকমুখে প্রচলিত থাকলেও গোপাল ভাঁড়ের সম্পর্কে প্রথম বই ঊনবিংশ শতকে প্রকাশিত হয়। গোপাল মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রর সভার পঞ্চরত্নের মধ্যে একজন ছিলেন।
কথিত আছে যে, সিরাজ-উদ-দৌল্লার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে গোপাল কৃষ্ণচন্দ্রকে বারণ করেছিলেন। মহারাজ নিজে সিরাজ-উদ-দৌল্লার বিরোধী ছিলেন এবং বন্ধু জগৎ শেঠকে সাহায্য করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। তাই শুরুতে গোপালকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও পরে তিনি ষড়যন্ত্র থেকে সরে আসার জন্য গোপালের কাছে একটা শর্ত রেখেছিলেন। সেই শর্ত অনুযায়ী গোপাল নবাবের সভায় গিয়ে জনসমক্ষে নবাবকে ভেংচি কাটেন। নবাব প্রথমে অবাক এবং ক্রমে ক্রুদ্ধ হয়ে গোপালকে বন্দি করার আদেশ দিয়েছিলেন। বন্দি অবস্থায় গোপাল কোনওক্রমে মিরজাফরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং কৃষ্ণচন্দ্রকে জানাতে বলেন যে তিনি শর্ত পূরণ করেছেন। মিরজাফর এই ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে গোপালকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য নবাবকে বোঝাতে শুরু করেন। নবাব প্রথমে গোপালকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কথা ভাবলেও পরে তাঁকে পাগল ভেবে মৃত্যুদণ্ড খারিজ করে মুক্তি দিয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদ থেকে মুক্তি পেয়ে গোপাল কৃষ্ণনগরে ফিরে এসে কৃষ্ণচন্দ্রকে পুনরায় বোঝানোর চেষ্টা করেন কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র তার কথা কানে তোলেননি। পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের জয়ের পরে গোপাল ভাঁড় কৃষ্ণনগর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। সেই ঘটনার পরে তাঁর সম্পর্কে আর কোনও তথ্য পাওয়া যায় না।
আরও পড়ুন: বিজ্ঞাপনের আকাল, কী অবস্থায় রয়েছে চিৎপুরের যাত্রাপাড়া?
গোপাল ভাঁড় সংক্রান্ত এই সকল তথ্য বিভিন্ন বই, নথি এবং জনশ্রুতি থেকেই জানতে পারা যায়। যদিও সুকুমার সেনের মতে গোপাল ভাঁড় আসলে কোনও মানুষ না, বরং উপাধি বলা যেতে পারে। শঙ্কর এবং তরঙ্গ। অনেকের মতে দু'জন মানুষ, আবার অনেকের মতে একজন মানুষ। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এই শঙ্কর তরঙ্গকে উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা এবং সাহসের জন্য নিজের সভায় বিশেষ স্থান দিয়েছিলেন। সুকুমার সেনের মতে এই ঘটনা গোপাল ভাঁড়ের কিংবদন্তির জন্ম দিয়েছিল। গোপাল ভাঁড়ের গল্প আসলে এই ঘটনা থেকেই তৈরি হয়েছে। যদিও গোপাল ভাঁড়ের সন্ধানে বইয়ের লেখক সুজিত রায়ের মতে গোপাল ভাঁড় কোনও কাল্পনিক চরিত্র না। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সময়কালে ছবি তোলার জন্য ক্যামেরার ব্যবহার শুরু হয় নি। সেই সময়ের হাতে আঁকা এক ছবিতে দেখা যায় যে মহারাজকে তার সভাসদদের সাথে বসে আলোচনা করছেন। সুজিত রায়ের মতে ছবিতে উপস্থিত সকলের মধ্যে এক ব্যক্তিকে গোপাল ভাঁড় হিসাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। গোপাল ভাঁড়ের বিভিন্ন গল্প নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। গোপাল ভাঁড়ের সম্পর্কে লেখা অনেক গল্পের সঙ্গে বীরবল এবং তেনালি রামনের বিভিন্ন গল্পের মিল রয়েছে। ইতিহাস গতিপথ অনুযায়ী প্রথমে তেনালি, তারপর বীরবল এবং শেষে গোপাল রয়েছে। গৌতম ভদ্রর মতে এটা খুবই সম্ভব যে, গোপাল সম্পর্কিত কিছু গল্প অন্য কোনও ভাঁড়ের জীবন থেকে নেওয়া হয়েছে, কারণ ঊনবিংশ শতকের প্রথম বই প্রকাশের পর গোপাল এবং তাঁর গল্প পড়ার কৌতূহলী পাঠকের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল।
বাংলায় গোপাল ভাঁড়ের মতো কিংবদন্তি খুব কম রয়েছেন এবং বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, বাংলার বেশিরভাগ মানুষের কাছে গোপাল ভাঁড় সদাহাস্যময়, উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী এক রক্তমাংসের মানুষ।

Whatsapp
