উটচালকদের গান কীভাবে হয়ে উঠল বাঙালির নিজস্ব টপ্পা

Tappa songs: টপ্পা গান কলকাতা অঞ্চলের একটি লৌকিক গান। পাঞ্জাব অঞ্চলের মূল গানের সঙ্গে মিল থাকলেও বাংলায় এটি রাগাশ্রয়ী গান হিসেবে পরিচিত।

ভারতীয় হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় স‌ংগীতের নানা প্রকার। যেমন ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, ঠুংরি আছে ঠিক তেমনই টপ্পাও একটি প্রকার। টপ্পা বাংলার গান না হওয়ায় খুব বেশি লোক এই গানের ধরন সম্পর্কে অবগত নয়। টপ্পা গানের বিষয়বস্তু প্রেম, আবেগ, বিরহ, ভালবাসা। এই গান পাঞ্জাব অঞ্চলে লোকগীতি হিসেবে বিবেচিত হতো। এই গানে শাস্ত্রীয় সংগীতের রাগের প্রভাব অবধারিতভাবে থাকবে এবং তানের প্রাচুর্যই এই গানের মূল বৈশিষ্ট্য। বিদ্যুৎ-চমকের মতোই গলায় চমকাতে থাকে সুরের সাত রং।

টপ্পা গান যেহেতু তানের কারণে চটুল প্রকৃতির হয়, সেজন্য টপ্পা গানের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু রাগ ব্যবহৃত হয়, যেমন- কাফি, খাম্বাজ, পিলু, ভৈরবী, তিলককামোদ ইত্যাদি। এসব রাগের চলন তেমন ভাবগম্ভীর হয় না, তাই টপ্পা গানের চটুল গতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই, এসব রাগকে টপ্পা গানের জন্য নির্বাচিত করা হয়।

কীভাবে এল এই টপ্পা গান
টপ্পা মূলত চটুল প্রকৃতির দ্রুতগতির গান। সংগীতের প্রধান চার ধারার একটি হলো টপ্পা। হিন্দুস্তানি ও বাংলা— এই দুই প্রকারেরই টপ্পা রয়েছে। বাংলায় তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই গান।

আরও পড়ুন: সিংহের ওপর বসে জগদ্ধাত্রী! আজও ঐতিহ্য মেনে পুজো হয় বটকৃষ্ণ পালের অট্টালিকায়

বাংলায় কীভাবে এই টপ্পা গানের জন্ম হলো, তা এক চমকপ্রদ কাহিনি। কারণ, এই গানের আঁতুড়ঘর বাংলা নয়।

টপ্পার উৎপত্তি কখন এবং কীভাবে হয়েছিল, তা নিয়ে নানা রকমের গল্প আছে। A. F. Strangways তাঁর 'Music of India' গ্রন্থে বলেছেন, পাঞ্জাবের উটচালকদের লোকগান থেকে টপ্পার উৎপত্তি, কিন্তু অনেকেই এই কথা মানতে রাজি নন। তবে আদি টপ্পাতে পাঞ্জাবি ভাষার আধিক্য রয়েছে। এই বিচারে বলা যায়, পাঞ্জাবের লোকগীতি থেকে এই গানের সূত্রপাত ঘটেছিল। হয়তো অন্যান্য পেশার মানুষের সঙ্গে উটচালকরা এই গান গাইতেন। ইতিহাসবিদরা ধারণা করেন, টপ্পা গানের জন্ম পাঞ্জাব-সিন্ধ অঞ্চলের উটচালকদের গান থেকে। বহুকাল আগে বাণিজ্যের জন্যে আরব বণিকরা ইরান ও আফগানিস্তান হয়ে ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলে আসত। বাণিজ্যের সওদা উটের পিঠে চাপিয়ে রাতের বেলায় তারা দল বেঁধে পথ চলত। সেসময় পায়ের চলার ছন্দের সঙ্গে এক ধরনের ‘হু হু’ শব্দ যোগ করে কম্পনযুক্ত সংগীতের মতো সুর তৈরি করত তারা। সময়ের আবর্তে এটি পাঞ্জাবের উটচালকদের আঞ্চলিক সংগীতে পরিণত হয়। এই গানের বিষয়বস্তু ছিল প্রেম, আবেগ, বিরহ, ভালবাসা। পাঞ্জাবে এই লোকসংগীতকে বলা হতো ‘ডপা’। পরে এই ডপাই হিন্দিতে ‘টপ্পা’ নাম নেয়। টপ্পার জন্ম সম্পর্কে রাধামোহন সেন তার ‘সঙ্গীত-তরঙ্গ’ বইয়ে লিখেছেন

 পাঞ্জাব হইতে হইল টপ্পার জনম /

দুই চরণের মধ্যে তাহার নিয়ম।

টপ্পার জনক
টপ্পা গানকে স‌ংগীতের আসরে প্রথম যিনি নিয়ে আসেন, তিনি শোরী মিয়া। শোরী মিয়ার পিতা গোলাম রসুল ছিলেন লখনউয়ের নবাব সুজা-উদ-দৌল্লার সভায় সভাগায়ক। সেই সূত্রে, শোরী মিয়া, যিনি নিজেও পিতার কাছে গান শিখতেন, ওই উটচালকদের গান, যা আঞ্চলিক লোকগীতি হিসেবে বিবেচিত হতো, সেই গানকে এক অন্য আঙ্গিকে নবাবের সভায় পরিবেশন করে নবাবের প্রশংসা লাভ করেন। সংগীতের জগতে জন্ম নেয় এক নতুন গানের শৈলী। টপ্পা গান আর শোরী মিয়ার নাম এক হয়ে যায়। সেজন্য টপ্পা গানের জনক বলা হয় শোরী মিয়াকে। শোরীর পর সেই কাজ এগিয়ে নেন তাঁর শিষ্য গামু মিয়া। এরপর ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে টপ্পা।

বাংলার টপ্পা
টপ্পা গান কলকাতা অঞ্চলের একটি লৌকিক গান। পাঞ্জাব অঞ্চলের মূল গানের সঙ্গে মিল থাকলেও বাংলায় এটি রাগাশ্রয়ী গান হিসেবে পরিচিত। টপ্পাকে বাংলায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব দেওয়া হয় রামনিধি গুপ্তকে। আবার অনেকের মতে, বাংলায় এই গান আসে কালি মির্জার হাত ধরে। তাঁর প্রকৃত নাম কালিদাস মুখোপাধ্যায়। দিল্লি ও লখনউ-তে ফারসি ও উর্দু ভাষায় শিক্ষালাভ, ওস্তাদি গানে তালিম গ্রহণ এবং শরিফ মুসলমানের মতো বেশভূষা পরিধান ও আচরণ পালনের জন্য তিনি ‘মির্জা’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। কালি মির্জা টোলে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করে বারাণসীতে হিন্দুশাস্ত্র ও সঙ্গীতবিদ্যা অর্জন করেন। কালি মির্জা ছিলেন একজন সুশিক্ষিত ব্যক্তি; কলকাতার গোপীমোহন ঠাকুর ছিলেন তাঁর পৃষ্ঠপোষক। তিনি কিছুকাল বর্ধমানের মহারাজা প্রতাপচন্দ্রের সভাগায়ক ছিলেন। রাজা রামমোহন রায়কে তিনি সংগীতশিক্ষা দিয়েছেন। তিনি হুগলিতে এসে বসবাস শুরু করার পর এখানেই বাংলা টপ্পা গানের চর্চা শুরু করেন। তিনি নিধুবাবুর অনেক আগে থেকে বাংলা টপ্পার প্রচলন করেন। উল্লেখ্য, ছাপুরা থেকে কলকাতায় ফিরে নিধুবাবু বাংলা টপ্পা শুরু করেন ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দে। সময়ের নিরিখে বাংলা টপ্পার আদিপুরুষ বলতে কালি মির্জাকে বিবেচনা করা হয়।

তবে বাংলায় টপ্পা জনপ্রিয় হয় রামনিধি গুপ্ত ওরফে নিধুবাবুর হাত ধরেই। এখানেই ভারতীয় বা হিন্দুস্থানী রাগসংগীতের ধারার সঙ্গে বাংলার রাগসংগীত-চর্চা যুক্ত হয়। রামনিধির জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চাপ্তায়, মাতুলালয়ে। কলকাতায় এক পাদরির কাছে তিনি ইংরেজি ও ফারসি শেখেন। ইংরেজি জানার সুবাদে কেরানির চাকরি পেয়ে যান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-তে। ১৭৭৬ সালে তিনি বিহারের ছাপরা জেলার কালেক্টর অফিসে সেকেন্ড ক্লার্ক হিসেবে কাজ শুরু করেন।

রামনিধি ছাপরা-তেই প্রথম এক ওস্তাদের কাছে রাগ সংগীতের তালিম নিতে শুরু করেন। পরে ছাপরা জেলার রতনপুরা গ্রামের ভিখন রামস্বামীর মন্ত্রশিষ্য হন। এই সময় তিনি উত্তর ভারতের বিভিন্ন ধরনের গানের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেন এবং বিভিন্ন সংগীতশিল্পীদের কাছে রাগস‌ংগীত শেখেন। ওই সময় লখনউতে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল শোরী-র টপ্পা। সম্ভবত সেখানেই টপ্পার সঙ্গে পরিচয় রামনিধির। তবে শোরী মিয়া-র কাব্য ও রস রামনিধি গুপ্ত ব্যবহার করেননি। কারণ, তাঁর গান ছিল বাঙালিয়ানায় ভর্তি। ১৭৯৪ সালে কলকাতায় ফেরেন নিধুবাবু। ফিরেই শোভাবাজারের একটা আটচালা ঘরে গানের আসর বসানো আরম্ভ করেন। এই আসরেই টপ্পার সূচনা করেন রামনিধি। এরকম নানা আসরের মধ্য দিয়েই রামনিধি গুপ্তর গান বিখ্যাত হয়ে ওঠে ‘নিধুবাবুর টপ্পা’ নামে। তার গানের ভক্ত হয়ে ওঠেন বর্ধমানের মহারাজা তেজেশচন্দ্র রায়বাহাদুরও।

হিন্দি টপ্পার অনুকরণে বাংলা টপ্পা রচনা করলেও নানা রাগের মিশ্রণ আনায় রামনিধির টপ্পাতে নিজস্ব ছাপ ছিল। নিধুবাবুর টপ্পার অনেকাংশজুড়েই ছিল মানবীয় প্রেম। তবে মজার ব্যাপার হলো, রামনিধির টপ্পাকে নারীদের প্রতি অশালীন ইঙ্গিত করা হতো বলে মনে করত তখনকার লোকে। এছাড়া তাঁর গানে দেশপ্রেমেরও প্রবল উপস্থিতি রয়েছে। ‘নানান দেশের নানান ভাষা/ বিনে স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা’ এই গানেই তা ফুটে ওঠে।

তাছাড়া নানা লেখা থেকে জানা যায়, নিধুবাবুর বহু গানই তাঁর প্রেমাস্পদ শ্রীমতী নামের এক নারীকে উদ্দেশ্য করে রচিত। শ্রীমতী ছিলেন মুর্শিদাবাদ কালেক্টরেটের দেওয়ান মহানন্দ রায়ের উপপত্নী। ১৮২৮ সালে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে যাতায়াত শুরু হয় রামনিধির। লোকশ্রুতি আছে, ব্রাহ্ম সমাজ-মন্দিরে বসে একটি ব্রহ্মসংগীত রচনা করে শোনান তিনি। ১৮৩৭ সালে ‘গীতরত্ন গ্রন্থ’ নামে রামনিধির রচিত গানগুলোর একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। ১৮৩৯ সালে মারা যান রামনিধি গুপ্ত।

তারপর এই গানের ধারাকে সচল রাখেন শ্রীধর কথক। তাঁর নাম না বললেই নয়। এই শ্রীধর নিধুবাবুকেও চ্যালেঞ্জে করেছেন বহুবার। তরুণ বয়স থেকেই সঙ্গীসাথীদের নিয়ে পাঁচালী আর কবিগান গেয়ে বেড়াতেন। বহরমপুরে সেকালের বিশিষ্ট কথক কালীচরণ ভট্টাচার্যর সঙ্গে দেখা হবার পর তিনি কথকতার প্রতি নতুন করে আকৃষ্ট হন। এই শিল্পটিতে তাঁর লোকপ্রিয়তা সেকালে আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল। নামকরা কথক হয়ে উঠেছিলেন অল্প বয়সেই। লোকে শেষ পর্যন্ত তাঁকে ডাকত শ্রীধর কথক নামেই। তাঁর রচিত মাতৃসংগীত জনপ্রিয়তায় রামপ্রসাদের সঙ্গে এবং টপ্পা স্বয়ং নিধুবাবুর সঙ্গে পাল্লা দিত। শ্রীধরের বহু গান এখনও নিধুবাবুর নামে চলে। অতি জনপ্রিয় গানটি হলো ‘ভালবাসিবে বলে ভালবাসিনে’, এই গানটি তাঁরই রচনা, যা অনেকে নিধুবাবুর গান বলে জানেন।

শ্রীধর কথকের পর টপ্পা-জগতের বিখ্যাত নাম মহেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত তাঁর হাত ধরে সজীব থাকে গানের এই ধারার স্রোত। টপ্পার সর্বশেষ জনপ্রিয় গায়ক ছিলেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৯২১-২০০৯)।

টপ্পার ভবিষ্যৎ
কিন্তু আজ বাঙালি সব ভুলতে বসেছে। কেউ কেউ বলে, বাঙালি বিস্মরণপ্রিয় জাতি। কেন এইসব গান আমাদের পাঠক্রমে থাকলেও খুব সম্মান ও আদরের সঙ্গে এদের তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি? কই, দক্ষিণ ভারত তো নিজেদের ফেলে আসা সংস্কৃতিকে ভোলেনি। বাঙালির শেকড় আছে এই গানে। এগুলো সব বাঙালির সংস্কৃতির বিবর্তন। রাজ্যেশ্বর মিত্র লিখেছেন: ‘টপ্পা আমাদের গৌরবের বস্তু এই কারণে যে, টপ্পায় বাঙালি শিল্পীর স্বকীয়তার পরিচয় যথেষ্ট পাওয়া যায়।' কালি মির্জা, নিধুবাবু, শ্রীধর– এঁদের রচনা এত পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর, যা বাংলা সাহিত্যে খুঁজলে খুব কমই পাওয়া যাবে। তিনজনের মধ্যে নিধুবাবুর শ্রেষ্ঠত্বকে সকলে স্বীকার করে নিয়েছেন। সাহিত্য কিংবা সংগীত যেদিক থেকেই দেখি না কেন, এ-কথা স্বীকার করতেই হবে যে অষ্টাদশ শতাব্দীর তরজা, খেউড়, পক্ষীদলের গান, কবিগানের যুগে নিধুবাবু একটা নতুন পথের নির্দেশ দিয়ে গেছেন।

টপ্পা গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে হয়তো বলা যাবে না, কারণ, এখনও শাস্ত্রীয় সংগীতের আসরে বা বাংলা গানের আসরে টপ্পা গান শোনা যায়। তবে, এই গানের পৃষ্ঠপোষকতা অনেকটাই কমে গেছে। তার কারণ, এই গান মূলত: বৈঠকী আসরের গান, রসিক জনের গান। এই গানের মূল পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নবাব, বাদশা, রাজ-রাজড়া, জমিদাররা। বর্তমান সময়ে, রাজন্য প্রথা আর নেই, জমিদারবাড়িও আর তেমনভাবে নেই। তবুও কিছু কিছু শিল্পী আজও টপ্পা গানকে ধরে রেখেছেন, বিলুপ্তির হাত থেকে এই গানকে রক্ষা করতে।

More Articles