ট্যাটু বলে দেবে আপনার রক্তচাপ! অভাবনীয় আবিষ্কার এবার হাতের মুঠোয়
ট্যাটুই বলে দেবে রক্তচাপ! গ্রাফিন ট্যাটু নিয়ে প্রবল আলোচনা বিজ্ঞানমহলে।
আগের প্রজন্মের বাবা-মায়েরা ট্যাটুর নাম শুনলে নাক সিঁটকোন বটে, কিন্তু ট্যাটু বিষয়টা মিলেনিয়াল থেকে শুরু করে জেন ওয়াই বা জি়, প্রায় সকলেরই অল্প-বিস্তর পছন্দ। তবে এই ট্যাটু ষাট-সত্তরের দশকের বাবা-মায়েদেরও পছন্দ হতে বাধ্য। কারণ অস্থায়ী এই ট্যাটু টানা বেশ কিছুদিন নজরে রাখবে রক্তচাপের (Blood pressure) ওঠাপড়া। আর এই ট্যাটু বানানো হয়েছে গ্রাফিন (Graphene) দিয়ে। ঠিক হিরে যেমন কার্বনের একটি ভিন্ন রূপ (Allotrope), গ্রাফিনও তাই। বলা যেতে পারে, গ্রাফিন হল কার্বন দিয়ে তৈরি, একটি দ্বি-মাত্রিক (টু-ডায়মেনশানাল) মৌচাক।
শুনে মনে হচ্ছে তো এই ট্যাটুর ওজন বেশি হবে? তা কিন্তু একেবারেই না। ভেবে দেখতে গেলে গ্রাফিনের সাহায্যে রক্তচাপ মাপার এই, এত বছর ধরে প্রচলিত রক্তচাপ মাপার পদ্ধতির থেকে ভীষণ আলাদা। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের অধ্যাপক, ড: ডেজি আকিনওয়ানডে (Dr. Deji Akinwande) জানাচ্ছেন, গ্রাফিনের ট্যাটু একেবারেই হাল্কা। আপনার শরীরে থাকলে আপনি ভুলেই যাবেন, আপনি যে একটি ট্যাটু বয়ে বেড়াচ্ছেন।
তিনি জানাচ্ছেন, এই গ্রাফিন সেন্সরটির বিশেষত্ব হল, কোনো মানুষের ব্লাড প্রেশার তার অজান্তেই, যে কোনো অবস্থায় মাপা যায়। এর ফলে, ধীর-স্থির থাকা অবস্থা কিংবা ভারী কাজ করার সময়ে, হৃৎপিন্ড কী ভাবে কাজ করছে, তা বোঝা যায়।
গ্রাফিনের বারোটি স্ট্রিপ, দুটি সারিতে বসানো থাকবে আপনার কব্জির কাছে থাকা দুটি ধমনীতে। প্রতিটি সারির বাইরের দিকে থাকা স্ট্রিপগুলি ছোটো ছোটো ইলেক্ট্রিক সঙ্কেত (Electric Signal) পাঠাবে আপনার বাহুর ভেতরের অংশে। অন্যদিকে, প্রতিটি সারির ভেতর দিকে থাকা স্ট্রিপগুলি বাহু থাকে আসা শারীরিক প্রতিক্রিয়াকে গ্রহণ করবে এবং ফিরে আসা প্রতিক্রিয়ায় প্রতি মুহুর্তে কোনো অদল-বদল হচ্ছে কি-না, তা-ও দেখবে।
আর সেই প্রতিক্রিয়া ও তার প্রতি মুহুর্তের পরিবর্তন দেখেই গ্রাফিনের সেন্সরগুলি মেপে ফেলবে আপনার রক্তপ্রবাহ। ‘নিউ সায়েন্টিস্ট’ (New Scientist) সূত্রে জানা যাচ্ছে, ট্যাটুর মত দেখতে গ্রাফিনের এই সেন্সরগুলি একদম সঠিক ভাবে (গ্রেড এ অ্যাকিউরেসি) জানিয়ে দেবে আপনার রক্তচাপ। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের গবেষকরা এই ট্যাটুগুলি মোট ছ’জন ব্যক্তির উপর পরীক্ষা করে দেখেছেন। তাঁদের রক্তচাপ মাপা হয়েছে যখন তাঁরা কম্পিউটারে কাজ করেছেন আর যখন তাঁরা চলাফেরা করে বেড়িয়েছেন।
এর পাশাপাশি তাঁরা যখন পুশ-আপের মত ব্যায়াম করেছেন বা গ্রাফিনের ট্যাটু-সমেত হাতের কব্জি বরফের বালতিতে এক মিনিটের জন্যে চুবিয়ে দিয়েছেন, তখনও সঠিকভাবে রক্তচাপ মাপতে পেরেছে গ্রাফিনের ট্যাটুগুলি।
ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস এবং টেক্সাস এ. এম. ইউনিভার্সিটির যৌথ গবেষণার ফল খুব সম্প্রতি ‘নেচার বায়োটেকনোলজি’
(Nature Biotechnology) নামে সায়েন্টিফিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। নিউ সায়েন্টিস্ট সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই ছয় ব্যক্তি যখন রাতে ঘুমিয়েছেন, তাঁদের ঘুম না ভাঙিয়েই বা কোনো কায়িক পরিশ্রম না করিয়েই, তাঁদের রক্তচাপ একটানা মেপে গেছে গ্রাফিনের এই ট্যাটুগুলি।
ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের গবেষক, ড: আকিনওয়ানডে জানাচ্ছেন, ট্যাটুগুলোর সাহায্যে পাওয়া ডেটা বিশ্লেষণ করতে কেবল একটি হার্ডওয়্যার ডিভাইসের প্রয়োজন। প্রচলিত ভাবে ব্যবহৃত রক্তচাপ মাপার যন্ত্রে কিন্তু তা একেবারেই সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে, রক্তচাপ মাপার সময়ে ধীরস্থির না থাকলে, সঠিক রক্তচাপ জানতেও সমস্যা হয়। তাছাড়া প্রচলিত ভাবে ব্যবহার করা যন্ত্রগুলিকে টানা কয়েকদিন ধরে রক্তচাপ মাপা তো একেবারেই সম্ভব নয়। তাই এই গ্রাফিন ট্যাটুগুলো বয়স্ক মানুষদের ক্ষেতে তো বটেই, হৃদরোগের সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তি বা হার্টের পরীক্ষা করাতে চান যাঁরা, তাঁদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি যথেষ্ঠ সুবিধের হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
আপনি যদি সেই সময়ে স্ট্রেস বা ডি-হাইড্রেশনে ভোগেন বা আপনার রক্তে গ্লোকোজে়র মাত্রা এদিক-ওদিক হয়, তখন প্রচলিত ভাবে ব্যবহৃত যন্ত্র যে রক্তচাপ দেখায়, তা সঠিক হয় না। সেক্ষেত্রে হার্টে আদৌ কোনো সমস্যা আছে কি-না, তা নির্ভুল ভাবে বোঝা মুশকিল হয়ে যায়।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বাজার চলতি একাধিক ফিটনেস রিস্ট ব্যান্ডও তো হার্ট রেট থেকে শুরু করে ব্লাড প্রেশার, এমনকি শরীরের তাপমাত্রা প্রত্যেক মুহুর্তে মাপতে পারে। তার জন্যে ফিটবিট (Fitbit), অ্যাপেল ওয়াচ (Apple Watch), বোট (BoAt), শাওমি (Xiaomi), নিদেনপক্ষে গোকির (GoQii) মত ব্র্যান্ড রয়েছে। সে-সব থাকতে থাকতে এই গ্রাফিন ট্যাটু (বা সেন্সর) আমরা
কেন ব্লাড প্রেশার মাপতে ব্যবহার করব?
বাজার চলতি ফিটনেস রিস্ট ব্যান্ড হার্ট রেট, ব্লাড প্রেশার ইত্যাদি মাপতে আলো ব্যবহার করে, যাকে বলে লাইট-বেসড মেথড। লাইট-বেসড মেথডে ত্বকের নীচে ফ্যাটের আস্তরণ, এমনকী চামড়ার রঙের জন্যেও রক্তচাপ মাপতে ভুল হতে পারে। সেক্ষেত্রে সঠিকভাবে হার্টের পরীক্ষা সম্ভব হয় না।
ফোটোপ্লাইথিস্মোগ্রাফি (Photoplethysmography (PPG)) নিয়ে গবেষণা করেন, এমন একদল গবেষক ফিটবিটের মত ব্র্যান্ডের
ফিটনেস রিস্ট ব্যান্ড দিয়ে তা পরীক্ষা করেও দেখেছেন। ফোটোপ্লাইথিস্মোগ্রাফির সাহায্যে আলোকে (অপটিকস) কাজে লাগিয়ে রক্তের উপর বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা করা হয়। যার মধ্যে ব্লাড প্রেশার ও হার্ট রেট পরীক্ষা অন্যতম।
ফোটোপ্লাইথিস্মোগ্রাফির সঙ্গে এই গ্রাফিন সেন্সরের তুলনা করলে, রক্তচাপ মাপার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টি অনেকবেশি কার্যকরী ও নির্ভুল। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস এবং টেক্সাস এ. এম. ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এই গ্রাফিন ট্যাটু শারীরিক ভাবে সুস্থ মানুষদের উপর প্রয়োগ করেই আশানুরূপ ফল পেয়েছেন। এখনও অসুস্থ রোগীদের উপর পরীক্ষা করে দেখে না হলেও, খুব তাড়াতাড়ি উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনে ভোগেন যাঁরা, তাদের উপর পরীক্ষা করে দেখা হবে।

Whatsapp
