ভোটে হারার ভয়েই কর সন্ত্রাস? ভয়াবহ অভিযোগ মোদি সরকারের বিরুদ্ধে
Modi Tax Terrorism: বাম দলগুলোর মধ্যে সিপিআইএম এবং সিপিআই-য়ের নামেও আয়কর দফতরের চিঠি এবং শাস্তি ধার্য হয়েছে।
লোকসভা নির্বাচনের প্রথম ভোট পড়তে আর বেশিদিন নেই। প্রায় সমস্ত জনমত সমীক্ষা, প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপির সুরে সুর মিলিয়ে বলছে, এবার ৫৪৩
আসনের লোকসভায় তাঁরা একাই ৪০০ আসন পাবেন। অনেকেই হতোদ্যম হয়ে পড়ছেন, তবে কি বিজেপিকে কোনওভাবেই পরাজিত করা সম্ভব নয়? কিছু প্রশ্ন থেকে যায় এরপরেও। বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী যদি এতটাই নিশ্চিত হন বিজেপির তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসা নিয়ে, তাহলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে, নির্বাচনে বিরোধীদের হারানোর কথা না বলে, সমস্ত বিরোধী দলগুলোকে এইভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে কেন? তাহলে কি মোদিও হেরে যাওয়ার ভয় পাচ্ছেন?
কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির তৎপরতা বেড়ে গেছে। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন হচ্ছে। ইডি এবং সিবিআই এতটা তৎপরতা কখনই কি দেখিয়েছে এর আগে? সাধারণত নির্বাচন ঘোষণা হয়ে গেলে, এই ধরনের যাবতীয় বিষয় স্থগিত রাখা হয়, কিন্তু এবার উল্টো। নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার পরে, বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম দু’জন শরিক আম আদমি পার্টি এবং ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার প্রথম সারির নেতৃত্ব এবং সেই রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে গ্রেফতারের পরে, বিশ্বের নানা দেশ থেকে সমালোচনা শুরু হয়েছে শাসকদলের। তবু নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের থামানো যাচ্ছে না। এমনকী উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়, যিনি একটি সাংবিধানিক পদে বহাল, যাঁর দলীয় রাজনীতিতে মন্তব্য করাই সমীচীন নয়, তিনি অবধি বলেছেন, বিদেশের উপদেশ নেওয়ার প্রয়োজন তাঁদের নেই। একদিকে গ্রেফতারি চলছে, পাশাপাশি বিভিন্ন জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলে বেড়াচ্ছেন, তিনি দুর্নীতির সঙ্গে আপোস করবেন না। যে কোনও দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে। অনেকেই আবারও বিশ্বাস করছেন, এইরকম কঠোরতাই দরকার, দুর্নীতি রুখতে এইরকম শক্ত লোকই দরকার।
আরও পড়ুন- ভোট-বাজারে ইলেক্টোরাল বন্ডকেই পাল্টা অস্ত্র করছে বিজেপি! যে ভয়াবহ ইঙ্গিত দিলেন মোদি
২০১৪ সালের আগে, দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের দুর্নীতি নিয়ে যখন রোজ খবর হচ্ছিল, তখন 'যুগপুরুষ' হিসেবে নরেন্দ্র মোদিকে খুব সচেতনভাবেই তুলে ধরা
হয়েছিল। স্লোগান উঠেছিল, ‘বহুত হুয়া ভ্রষ্টাচার, আব কি বার মোদি সরকার’। ক্ষমতায় আসার পরে গঙ্গা, যমুনা, নর্মদা দিয়ে বহু জল যাওয়ার পরে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা, যাঁদের বিরুদ্ধে এতদিন তদন্ত চলছিল, তাঁদের বিজেপিতে অন্তর্ভুক্তি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তাঁদের বিরুদ্ধে যে তদন্ত চলছিল, সেই তদন্তও বন্ধ করা হচ্ছে। যাঁদের বিরুদ্ধে, সকাল থেকে রাত অবধি নরেন্দ্র মোদি আঙুল তুলতেন, সেই হিমন্ত বিশ্বশর্মা, শুভেন্দু অধিকারী, প্রফুল্ল প্যাটেল, ছগন ভুজওয়াল কিংবা অজিত পাওয়ারদের আজকাল প্রধানমন্ত্রীর পাশেই দেখা যাচ্ছে। এমনকী, নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী, নির্মলা সীতারমণ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাঁদের দলের দরজা সকলের জন্য খোলা। অর্থাৎ, যে কোনও মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত হোন, কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে যদি তদন্তও চলে, তাতেও সেই নেতাকে দলে নিতে তাঁদের আপত্তি নেই।
বিরোধী দলের নেতামন্ত্রীদের হেনস্থা এবং গ্রেফতারিতেই কিন্তু বিষয়টা থেমে নেই। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের অভিযোগ, তাঁদের সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেওয়া হয়েছে আয়কর দফতরের পক্ষ থেকে। বলা হয়েছে, যেহেতু কংগ্রেসের তরফ থেকে ২০১৭-১৮ সাল থেকে পরপর পাঁচ বছর, আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া হয়নি, তাই এই পথ নিতে বাধ্য হয়েছে আয়কর দফতর। রাহুল গান্ধির অভিযোগ, ৩০ বছর আগের অভিযোগ সহ আয়কর ফাঁকির অভিযোগ তুলে আয়কর দফতর শতাব্দী প্রাচীন এই দলটির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেই ইতিমধ্যে বাজেয়াপ্ত করেছে ১৩৫ কোটি, যা আইনত করা যায় না। শুধু তাই নয়, কংগ্রেসের কাছে আয়কর দফতরের তরফ থেকে প্রাথমিকভাবে ১৮২৩ কোটি টাকা জরিমানা ধার্য করে চিঠি অবধি পৌঁছে গেছে। স্থাবর, অস্থাবর মিলিয়ে কংগ্রেসের মোট সম্পত্তি ১৪৩০ কোটি টাকা। শোনা যাচ্ছে, গত কয়েকদিনে আয়কর দফতর কংগ্রেসকে মোট ৩৫৩৬ কোটি টাকার নোটিশ ধরিয়েছে। অর্থাৎ দল দেউলিয়া হয়ে গেলেও অত টাকা দেওয়ার সাধ্য থাকবে না। আর ভোটের মুখে দলটির টাকা খরচ করার সাধ্যকে শূন্যে নামিয়ে আনাই লক্ষ্য। বিষয়টিকে কি কর সন্ত্রাস বললে ভুল হবে?
ইলেক্টোরাল বন্ডের থেকে যে টাকা বিজেপির ঘরে আসার ছিল তা সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বানচাল হয়ে যেতেই বিপক্ষকে আর্থিকভাবে পঙ্গু করার এই বিজেপীয় চাল দেশের ইতিহাসে কদর্য এক অধ্যায়ে লেখা থাকবে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের আগে এই কর সন্ত্রাস নিয়ে ইতিমধ্যেই শোরগোল পড়ে গেছে। অনেকে বলছেন, কংগ্রেস নিজের দোষেই এই বিপদে পড়েছে। শুধু কংগ্রেস নয়, বাম দলগুলোর মধ্যে সিপিআইএম এবং সিপিআই-য়ের নামেও আয়কর দফতরের চিঠি এবং শাস্তি ধার্য হয়েছে। বলা হয়েছে, তাঁরা যেহেতু পুরনো প্যানকার্ড ব্যবহার করে কর জমা করেছেন, সেই কারণে তাঁদেরও জরিমানা দিতে হবে। সিপিআইকে বলা হয়েছে ১১ কোটি টাকা জরিমানা দিতে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, নির্বাচনী বন্ডে একমাত্র বাম দলগুলোই টাকা নেয়নি। এই অভূতপূর্ব কর সন্ত্রাসের মুখে দাঁড়িয়ে বিজেপি বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দল প্রশ্ন তুলেছে, যে দল নির্বাচনী বন্ডে সবচেয়ে বেশি
লাভবান হয়েছে তাদের তো কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থা হেনস্থা করছে না! কেন তাদের আয়কর দফতরের চিঠি পেতে হচ্ছে না? শুধু বিরোধী দলের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম? না কি তারা বিজেপির চাপের কাছে মাথা নোয়ায়নি বলেই হেনস্থা?
আরও পড়ুন-শ্রীলঙ্কাকে দ্বীপ দান! ৫০ বছর আগে ইন্দিরা গান্ধির সিদ্ধান্ত নিয়ে ভোটের আগে কেন সরব বিজেপি?
শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, আয়কর দফতর দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে জানিয়েছে, আপাতত নির্বাচন চলে আসার কারণে, তাঁরা কংগ্রেসের কাছ থেকে জরিমানার টাকা আদায় করবে না, কিন্তু ভবিষ্যতে যে আদায় হবে না, তা বলা হয়নি। অর্থাৎ পরিষ্কার বোঝানো হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপির বিরুদ্ধে বেশি কথা বললেই হেনস্থার সম্মুখীন হতে হবে। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি মোদি হেরে যাওয়ার ভয় পাচ্ছেন? সেই ভয় থেকেই, বিরোধী নেতাদের গ্রেফতার কিংবা কর সন্ত্রাস?
৪০০ আসনের ফানুস তো বহুলাংশেই পোষা গণমাধ্যমের তৈরি। ক্ষমতা বদলালে পোষ্য মিডিয়াও পাল্টে যাবে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে একটু দূরে থাকলেই, যে সঙ্ঘ পরিবার এখন মোদির ছায়ায় আছে, তারাও অন্য মুখ খোঁজার চেষ্টা করবে। নতুন সমীকরণ তৈরি হবে এবং যেহেতু মোদির সঙ্গে অন্য নেতাদের দূরত্ব বেড়েছে, অনেকেই তখন তাঁর পাশে নাও থাকতে পারেন। তাই কোনও সুযোগ তিনি রাখতে চাইছেন না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে সারা বিশ্ব যা ইচ্ছে বলুক, মোদি অনড় নিজের লক্ষ্যে। এমন স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা ভাবেন, সারাজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন তারা কিন্তু ইতিহাস তা বলে না। সাম্প্রতিক, তুরস্কের বা ব্রাজিলের উদাহরণও তাই বলে না। ব্রাজিলের বোলসেনারোও ভেবেছিলেন এমনই। বিরোধী লুলাকে জেলেও ঢুকিয়েছিলেন, তাও পরাজিত হয়েছেন। তুরস্কের ২১ বছরের প্রধানমন্ত্রী এর্দোগানও কিন্তু তৃতীয়বার জেতার পরে ইস্তানবুল সহ বেশ কিছু শহরের সাম্প্রতিক নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে দেশের হিসেব উল্টে যাবেই যাবে।