'অতিকথন মারাত্মক দোষ— শুধরে নাও,' শিখিয়েছিলেন সংগ্রাম স্যার...
Teachers' Day 2023 : কিছু প্রশ্নের উত্তর লিখে খাতাটা সংগ্রাম স্যারকে দিয়ে এলাম চুপি চুপি। নিজের কলমের ওপর অগাধ আস্থা।
সংগ্রাম স্যারের সঙ্গে প্রথম এনকাউন্টারটা ছিল মিঠেকড়া। ২০০৬ সাল। ক্লাস নাইন, সেকশন 'এ'। রুটিনে লেখা 'বাংলা (পদ্য)'। শিবেনবাবুর আসার কথা। কিন্তু বদলে রুমে ঢুকলেন যিনি, তিনি কোনও কেতাদুরস্ত 'বাবু' নন, 'দাদা'। আনকোরা নতুন দাদা। ফিটফাট পোশাক। চাপদাড়ি। চাহনি নম্র, কিন্তু ধারালো। ঈষৎ দোদুলগতিতে চক-ডাস্টার আর 'পাঠ সংকলন' হাতে ডায়াসে উঠলেন। তারপর খানিক ঝুঁকে আলগা মেপে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন—"বাংলা ভাষা আর বাংলা সাহিত্য বলতে কী বোঝো? এ দুইয়ের মধ্যে সম্পর্কই বা কী? গুছিয়ে বলো দেখি!"
আলতো ভাবে ভাসিয়ে দেওয়া সওয়াল। 'এ আর এমন কী'-গোছের প্রতিক্রিয়া দেখাল কেউ কেউ। কিন্তু খানিক বাদে টনক নড়ল। মনে যে উত্তরের বুদ্বুদ উঠছে, সবই ভাসা ভাসা৷ স্পষ্ট নয়। 'গুছিয়ে বলা'-ও বেশ কষ্টকর। প্রশ্নটা স্যার 'হ্যান্টামেন্টি' (মালদাইয়া বুলি, অর্থ: 'এমনি এমনি') করেননি। ফলে সমবেত 'ভাবো ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো'-র টানে গুঞ্জন ঘনীভূত হলো। জমে উঠল কথোপকথন। সদ্যপাঠের সুঘ্রাণ সমেত উঠে এল 'আবোল তাবোল', চাটুজ্জেদের রোয়াক ছেড়ে টেনিদা, ভূমিপুত্র শিব্রাম—এমনকী স্বল্পতম পাঠের দুর্মর অস্মিতাসুদ্ধ রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, বিভূতিভূষণ, সত্যজিৎ-ও। খোলা মনে যে যার মতো তত্ত্ব দাঁড় করাল। একে অন্যের প্রস্থান যুক্তিজালে অসার প্রতিপন্ন করতে চাইল। কথায় কাটল কথার প্যাঁচ। আর নেপথ্যে দাঁড়ানো নবাগত মাস্টারমশাই বিতর্কের গাঁটগুলো একে একে আলগা টানে খুলে ফেলতে থাকলেন। পাঠ্যসূচির 'পতিত হেরিয়া কাঁদে'-র গৌরচন্দ্রিকা সেদিনের মতো তোলা রইল। বদলে ক্লাসে বসে সিলেবাসের বাইরের সাহিত্যে স্নান করলাম সকলে মিলে। সেই প্রথম।
মোটে একদিনের আলাপ। তাতেই মনে হলো, চোখ খুলেছে। এবার হাত-মকশোর পালা। টেক্সটের কিছু প্রশ্নের উত্তর লিখে খাতাটা সংগ্রাম স্যারকে দিয়ে এলাম চুপি চুপি। নিজের কলমের ওপর অগাধ আস্থা। ততদিনে 'উঠতি লেখক' হিসেবে স্কুলের অন্দরে খানিক সুনামও জুটেছে। নতুন শিক্ষকের মুখে সম্ভাব্য প্রশংসা শোনার রোমাঞ্চে বুঁদ হয়ে থাকলাম দু'দিন। তিনদিনের মাথায় ডাক পড়ল। থমথমে মুখে খাতা ফেরত দিলেন স্যার। দেখি পাতার পর পাতা জুড়ে আন্ডারলাইন, টিপ্পনী, সংশোধন। এল দীর্ঘ বাক্য ভেঙে লেখার নিদান, যথাসম্ভব আলংকারিকতা বর্জনের নির্দেশ। ভূমিকার নামে অতিকথন মারাত্মক দোষ— শুধরে নাও। সচেতন লেখালিখির গোড়ার পর্বের সেই আঘাত, সেই জরুরি অভিঘাত আমাকে আয়নার সামনে দাঁড় করাল। দুঃখ হলো খানিক। কিন্তু আনন্দ বহুগুণ। শেখার আনন্দ, সংশোধনের আনন্দ, নিজেকে আরও শাণিত করতে পারার আনন্দ৷
আক্ষরিক অর্থে হাতে ধরে বাংলা লিখতে শেখালেন সংগ্রাম স্যার৷ শেখালেন, কীভাবে টেক্সট পড়তে হয়। সিলেবাসের সিসিটিভি ফাঁকি দিয়ে মাঝেসাঝে পড়ে শোনাতেন 'বাইরের গল্প'। মনে আছে, ক্লাস টেনে বনফুলের 'নিমগাছ'-এর শেষ বাক্য শুনে আমি বহুক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সেদিন গোটা ক্লাসের স্তম্ভনমূর্তিটুকু দেখে বিনা মন্তব্যে, অল্প হেসে, স্যার পরের গল্পে চলে গেছিলেন। এত বছর কেটে গেল। তবু 'হারুন সালেমের মাসি'-র ক্লাইম্যাক্সের অনবদ্য ব্যাখ্যা আজও ভুলতে পারিনি। আজও শব্দ আর বাক্যের গোপন আঁতাত ধরে ফেলি যখন, স্মৃতি-বিস্মৃতির আলোছায়ায় মন ঘাই মারে দুপুরের সেই পদ্মকাঁপা বিলে।