মা, তোমার জেদ আর অধ্যবসায়ই আমার শিক্ষা, তুমিই শিক্ষক...
Teachers' Day 2023 : সকালবেলা দেরি করে ওঠার বকুনিটা খেয়ে, এই লেখাখানা পড়ে শোনাব।
ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে সেপ্টেম্বর ঢুকলেই শিক্ষার্থী মহলে শিক্ষক দিবস নিয়ে একটা আবছা ফিসফাস শুরু হয়। বাকি মনুষ্য জাতি ও ব্যাঙ্কের চাকুরিজীবী লোকজন হলিডে না থাকায় ওই দিনটিকে নিতান্তই কীভাবে অমুক স্যার জীবন পাল্টে দিয়েছিলেন, তমুক ম্যামের জন্যই আজ জীবনে এতটা সাফল্য লাভ করেছি-র মতো গালগল্পে টাইমলাইন ভরে ওঠার দিন হিসাবে পালন করে। শিক্ষক দিবসের দোরগোড়ায় বেশিরভাগ সরকারি ইস্কুলগুলোর ক্লাসে ক্লাসে বেশ একটা সাজো-সাজো রব পড়ে। পাঁচ-দশ টাকা চাঁদা তুলে রঙিন রিবন, বেলুন দিয়ে সাজানো ক্লাসরুমে প্রিয় মিস বা স্যার প্রবেশ করা মাত্রই সব্বার আগে পায়ের ধুলো একদম মাথায় তুলে নেওয়ার হুটোপাটি। সেরকম প্রিয় শিক্ষক বা শিক্ষিকা হলে তাঁর জন্য হাতে আঁকা গ্রিটিংস কার্ড বা মাস দুয়েকের পকেটমানি জমিয়ে নিদেনপক্ষে একখানা সেলোর পেন দেওয়া আবশ্যিক।
এসব নির্ঝঞ্ঝাট দিন বহুকাল আগেই পেরিয়ে এসেছি, তবুও প্রতি বছর শিক্ষক দিবস এলেই এক দু'জন পছন্দের শিক্ষক, শিক্ষিকার বাড়িতে আজও অভ্যাসবশতই ঘুরে আসি। তবুও আজ পর্যন্ত কোনও শিক্ষক দিবসেই নিজের দ্বিধা কাটিয়ে প্রিয় শিক্ষিকাকেই একটা প্রণাম করে উঠতে পারিনি। মা খুব ছোটবেলায় বর্ণপরিচয় আর অ্যালফাবেট বইয়ের পাশাপাশি এনে দিয়েছিলেন 'হাঁদা ভোদা' আর 'নন্টে ফন্টে' কমিক্স। আর ওই রঙিন কমিক্সের এক বর্ণও পড়তে অক্ষম আমাকে প্রতিদিন রাতে নিয়ম করে তা পড়ে শোনানোর পাশাপাশি বাংলা শিশু সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করানোই ছিল ভদ্রমহিলার প্রধান কাজ। বাকি পাঁচটা মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির নিয়ম মেনে, বয়স প্রায় পাঁচ হওয়ার আগেই আমাকেও সুবোধ বালিকার মতো নাচের স্কুলে পাঠানো শুরু হয়। ওই বয়সে দাদরা থেকে কাহারবা সব তালই বেতালে লাগত, তার উপর আবার মেঘের কোলে নাকি রোদ হেসেছে! পরের দিন ক্লাসে গিয়ে তালে তাল মিলিয়ে পা ফেলতে ভুল হলেই নাচের গুরুজি মাথায় তবলা ভেঙে দেওয়ার ভয় দেখাতেন। এমতাবস্থায় মেয়ে যাতে নৃত্যে ঊর্বশী বা অন্তত যেন রম্ভা হয়ে ওঠে তাই কোনওদিন তাল, সুর, লয়ের ধারে কাছেও না যাওয়া আমার মা নাচের ক্লাসের দরজার বাইরে প্রতি হপ্তায় দু'ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে শুরু করেন। তারপর বাড়িতে ফিরে দরজার বাইরে থেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রায় হুবহু রপ্ত করা নাচ মেয়েকে তালিম দিতে শুরু করেন। আজ বহু বছর পর এসব ভাবলে নিজেই অবাক হই মায়ের জেদ আর অধ্যবসায় দেখে।
নিজের ব্যক্তিগত পছন্দ যে কারও উপরেই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটার জন্যও এই ভদ্রমহিলার আরেকবার প্রণাম প্রাপ্য। আজন্ম আমার পড়াশোনার ব্যাপারে রক্তচক্ষু ধারণকারী মা, মেয়ে তাঁর ডাক্তার হবে সেই স্বপ্নে জল ঢেলে উচ্চমাধ্যমিকের পর সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করতে চায় জেনে রাগ করেননি; বরং বাকিদের মন্তব্যে কান না দিয়ে মেয়েকে তার পছন্দের পথে হাঁটতে গিয়ে যাতে বিপদে না পড়তে হয় সেদিকে খেয়াল রেখেছেন। আজকাল যে হারে রাজ্য থেকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলির অবলুপ্তিকরণ ঘটছে, কিছুদিন পর বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিকে ডাইনোসরের ডিম বলে ভ্রম হতেই পারে। কিন্তু আমার মা আজীবন তাঁর নিজের ভাষা, ইস্কুলের পড়ার বইয়ের ভাষা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার ভাষাতেই মেয়েকে শিক্ষিত করতে চেয়েছেন। এই ভাষাতে পড়াশোনা করিয়েই আমার মাধ্যমিক পাস মা মেয়েকে হাত ধরে পার করিয়ে দিয়েছেন অন্যতম নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট।
এসব কথা লেখার জন্য বা কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য এমনিতেই ক্যালেন্ডার দিন নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাহলে হঠাৎ মাতৃদিবস ছেড়ে শিক্ষক দিবসে এসব কেন বাপু, বলে অনেকেই ভ্রু কোঁচাকাতেই পারেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলি, আমার মাতৃ দেবী আজকাল তাঁর মধ্য চল্লিশে এসেও আমার মতো কুল, জেন জি'কেও রীতিমত কাগজ কলম নিয়ে বসে জীবনের বহু নিত্যনতুন জিনিসপত্র শিখতে বাধ্য করছেন। জীবনের প্রায় মাঝপথে এসেও নিজের সামান্যতম ইচ্ছে থাকলেই যে স্বাবলম্বী হওয়া যায় অথবা নিজের সমস্ত কুণ্ঠাবোধ কাটিয়ে মেয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠে দিব্যি নেচে ফেলা যায় একথা আমি মা'কে না দেখলে হয়তো এ জম্মে বিশ্বাস করতাম না। আজকাল মাঝে মাঝেই মা ও পাড়ার কাকিমাদের রবীন্দ্র জয়ন্তী বা বিজয়া দশমীর মজলিসের জন্য নাচ শিখিয়ে দিই। মা'কে শেখাতে গিয়ে মাকে বেশ নিজের ছাত্রী বলে মনে হয়, ভুলভাল হলে মাঝে মাঝে বকুনিও দিয়ে ফেলি। তারপর মনে মনে খুব হাসি এই রোল রিভার্সাল দেখে। ঠিক তারপরেই আমার আজীবন ছাপোষা, গৃহিণী মা'য়ের দিকে তাকাই। এক পৃথিবী মনের জোর নিয়ে ভদ্রমহিলা কী নির্দ্বিধায় এই মাঝ বয়সে এসে নিজের পছন্দগুলোকে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আজকাল প্রতিদিন এসব ছোট ছোট জিনিস শিখি, নিজের জীবনেও প্রয়োগ করার চেষ্টা করি। তবুও ভুল ত্রুটি থেকেই যায়! যদিও এবছর শিক্ষক দিবসে আর কোনও ভুল করবো না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সকালবেলা দেরি করে ওঠার বকুনিটা খেয়ে, এই লেখাখানা পড়ে শোনাব। তারপর না হয় বড়জোর আবার সেই একখান সেলোর পেন দিয়ে টুক করে প্রণামটাও সেরেই ফেলব।