ভৈরবী অনুকোমল শিখিয়েছিলেন রুদ্রপ্রয়াগের সেই ফক্কড় বাবা!

Teachers' Day 2023: ধর্মশালার লোকজন বলল, "ওহ তো ফক্কড় বাবা হ্যায়। উপর এক মন্দির হ্যায়, উনকা।"

তখন আমি কর্মসূত্রে দিল্লিতে। পুরোদমে সপ্তাহ দুয়েক রেকর্ডিংয়ের কাজ চলে, আর টানা দিন পনেরো ছুটি। সালটা ৯৭। বাজারে রিমিক্সের রমরমা। ছুটিগুলোয় বাড়ি না ফিরে আমরা মিউজিশিয়ানরা নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম। পাড়ি দিলাম বদ্রীনাথ। মাঝে কংখল-এ একদিনের বিরতি। তারপরেই রুদ্র প্রয়াগ। কালী কমলি ধর্মশালায় ঠাঁই নিলাম। ভয়ানক ঠান্ডা। পরের দিন সকালে উঠে বদ্রীনাথ যাত্রা। অভ্যাসবশত খুব ভোরে ঘুম ভাঙল। অপার নৈঃশব্দ্য। শুধু অলকানন্দার কল কল শব্দ। তাতে স্থবির হৃদি ভেসে যায়। কানে এল পুরুষ কণ্ঠ। কী অপার্থিব ও অনবদ্য সেই সুর। ক্রমরক্তিম ভোরে ছড়িয়ে পড়ছে ভৈরবীর সুর। এক সহ কুশীলব, বারাণসীর বাসিন্দা, তাঁকে ডেকে তুললাম। "ক্যায়া বাত অমিত, ডর গয়ে ক্যায়া। আরে ভাই শুনিয়ে তো, কহিঁ সে এক মিঠি ধুন শুনাই দে রহি হ্যায়"।

ধর্মশালার লোকজন বলল, "ওহ তো ফক্কড় বাবা হ্যায়। উপর এক মন্দির হ্যায়, উনকা।"

মন্ত্রমুগ্ধ আমি পৌঁছলাম সেই অজানা, অখ্যাত মন্দিরে। দেখি এক স্বাস্থ্যবান পুরুষ বসে গাইছেন। উর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, গায়ে শুধু একটি সাদা উত্তরীয়। পরনে ধুতি। আমি ওঁর গান শুনতে লাগলাম মগ্ন হয়ে। সেই স্বর্গীয় সঙ্গীত শেষ হলে, তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করলাম, "এই গান কোথায় শিখলেন বাবা।" শুনে তিনি শিশুর মতো খিলখিলিয়ে হেসে বললেন, "আরে কহিঁ সে নহি বেটা, ইয়ে তো উপরওয়ালে নে দিয়া হ্যায়, উনহি কি কৃপা সে ইয়ে ধুন নিকলা।"

তারপর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তরতরিয়ে নেমে গিয়ে চোখের নিমেষে উধাও। ঘোর নিয়ে নেমে এলাম। বদ্রীনাথের উদ্দেশে রওনা দিলাম, মনে অনেক প্রশ্ন নিয়ে। ফেরার সময়, আবার রুদ্রপ্রয়াগে দলের সবাইকে রাজি করালাম একদিন বেশি থাকতে। উদ্দেশ্য, আরেকবার ফক্কড় বাবার দর্শন।

সেই মন্দিরে গিয়ে দেখি দেবালয় শূন্য। স্থানীয় লোকজন কেউই বলতে পারে না বাবা কোথায়। "আরে উনকা কোই ঠিকানা নহি হ্যায়, ইধার উধার ঘুমতে রেহতে হ্যায়!"। একজন বলল, "নদী কিনারে এক কোঠি হ্যায়, উধার দেখ লিজিয়ে।"

অনেক কষ্টে সেই কুটিরে পৌঁছে দেখি ধ্যানস্থ ফক্কড় বাবা। সারা কুটির বাহুল্য বর্জিত। মাটিতে ধবধবে সাদা চাদর পাতা। কোনও মূর্তি নেই, ছবি নেই। বললাম, "বাবা আপকো ঢুন্ডনে মন্দির গয়া থা।" আবার সেই হাসি তারপর বললেন, "ওহ তো ইঁহা হ্যায়, মন্দির মে কিঁউ যাউঁ। উস দিন বুলাওয়া আয়া। চলা গয়া।"

আমি তখন এক অদ্ভুত ভাবে। আমরা মূর্তি পূজো করি। বীণা বা অস্ত্র দেখে ফারাক করি কে সরস্বতী আর কে দুর্গা। এ কী কথা সাধু বাবা! এত চরম সত্য, নেওয়া যায় না। পৌত্তলিক মনে আলোড়ন উঠল।

রুদ্রপ্রয়াগের পরম প্রশান্ত পরিবেশে আমি সেদিন এক অধ্যাত্ম পুরুষের সঙ্গ পেয়েছিলাম। নিরাভরণ সেই সন্ন্যাসীর দেহের অপরূপ জ্যোতিতে আমি ক্ষণিকের জন্য হলেও ভৈরবীর অনুকোমল রিষভ-কে চাক্ষুষ করেছিলাম।

স্বচক্ষে দেখিনি, আমার ভায়োলিন গুরু শ্রী অমিতাভ ঘোষ এই গল্পটি বলেছিলেন। স্যারের বর্ণনায় যেন আজও যেন ফক্কড় বাবা কে দেখতে পাই, তাঁর চোখে আমি দেখতে পাই এক অধ্যাত্ম পুরুষকে। 

More Articles