খাদের ধারে 'লস্ট চাইল্ড'! চিন্তায় তাঁকে বারবার বাঁচিয়ে দিয়েছে সুমিতদা...
Teachers' Day 2023: স্যার বারবার বলে, সেভ ইওর মাইন্ড! কীভাবে বাঁচাব স্যার, খাদের ধারে আছি।
খাদের ধারে দাঁড়িয়ে আছি। টোকা মারছে অবসাদগ্রস্ত মেঘ। স্খলনের সমস্ত আয়োজন সারা। ধারেকাছে কেউ নেই, সিনেমার মতো, অন্তিম মুহূর্তে এসে হাত ধরবে এমন কেউ। তবু কী আশ্চর্য, পড়ছি না। সমস্ত টোকা, সমস্ত ধাক্কা, সমস্ত ফুরিয়ে যাওয়া নিয়ে খাড়ায়ে আছি। ধারেকাছে নেই, আসলে মগজে আছে। একাধিক খাদের ধার থেকে যিনি টেনে এনেছেন অনতিদূরে। ১৮ বছর হয়ে গেল, এখনও মনে পড়ে দ্য লস্ট চাইল্ড পড়েছিলাম প্রথম তাঁর কাছে। সেই আমার প্রথম বাইরে টিউশন।
সাত চড়ে রা না কাড়া বাচ্চা, বন্ধু নেই, স্কুলে টিফিনে অন্যরা খেলে, সে খেলে না। ঝগড়াও করে না। কথাও বলে না বিশেষ। দশম শ্রেণিতে মা নিয়ে গেল সুমিতদার টিউশনে, ইংরেজি আর বাংলা পড়াতে। দরজার ধারে বসলাম। চারদিকে ঝলমলে ছাত্রছাত্রীরা। অনেকেই পরিচিত, তবে বন্ধু না। আমি তো কখনও বাইরে টিউশন পড়তে যাইনি, কারও সঙ্গে মিশতেও পারি না। চুপ করে বসে আছি। স্যার বই খুলল। মুলক রাজ আনন্দের 'দ্য লস্ট চাইল্ড'। বাচ্চাটা মেলাতে হারিয়ে গেছে, সে খালি বলে আই ওয়ান্ট মাই মাদার, আই ওয়ান্ট মাই ফাদার। কী যে ম্যাজিক ঘটল জানি না। তবে একটা গল্প এভাবে পড়া যায় প্রথম বুঝলাম। স্যারও নিশ্চয়ই বুঝল (বুঝলেন বলা পেরিয়ে গেছে কেন, তা ক্রমপ্রকাশ্য)।
বুঝল বলেই না ২০০৬ সালে আমাকে একটা আমন্ত্রণপত্র দিল। 'নতুনদের কবিতাপাঠ ও আড্ডা'। আমি খুবই পচা কবিতা লিখতাম তখন। তবু, আমাদের ইস্কুলের উপরের হলঘরে একটা রবিবার সকালে আড্ডা বসল। অনেকে এল, আমার বন্ধু, পরিচিত, স্যারের অন্য ছাত্রছাত্রীরা। অনেকেই লেখে, অনেকেই গান করে, অনেকে আবার ভীষণ ভালো কথা বলে। আমি তো গান পারি না, কথা বলতে গেলে কান গরম হয়ে যায়। কবিতা পচা লিখি। তাও কবিতা বললাম। সবাই বলল এই আড্ডাটা রোজ রোববার হোক, সবাই আসবে। শুরু হলো। উড়ান গড়ে উঠল। উড়ান পাঠচক্র। উড়ানের ১৮ বছর হয়ে গেল! কী আশ্চর্য, উড়ান না থাকলে এই ১৮ বছরে কী করতাম?
স্যার, তোমাকে বলি, শিক্ষক বা কারও প্রতিই আমার অন্ধ শ্রদ্ধা নেই। তবু, এখন অনেক ঝগড়া বা তর্কের নেপথ্যে জেনো, শ্রদ্ধা আছে। আমি কোনওদিনই একলাইন লিখতে পারতাম না সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায় না থাকলে। কোনওদিনই লিখে পেট চালাতে পারতাম না, কোনওদিনই বুঝতে পারতাম না থিয়েটার করাটাই আমার মূল লক্ষ্য। বুঝতামই না ছবি আঁকা পেন্সিল বা তুলিতে হয় না, ভাবনায় হয়। চিন্তার রিহার্সাল দিতে হয়। ইংরেজি বা বাংলা পড়ানো মাস্টারমশাই কালে কালে হয়ে উঠেছে থিয়েটারের শিক্ষক। জীবনের শিক্ষক। আশেপাশের সমস্ত পাঁকের মধ্যে স্পষ্ট কথা বলতে শেখানো নেতৃত্ব। এখন চারপাশে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শোষক হয়ে ওঠা ছদ্ম নেতাদের দেখে অবাক লাগে। অবাক লাগে জাহির করতে শেখা মানুষদের দেখে। অবাক লাগে মতাদর্শ পালটে ফেলা হিলহিলে সাপেদের দেখে। মনে হয়, কেন যে মরতে তোমার কাছে এলাম! জাহির করতে শিখলে কত মাইনে, কত পদ, কত খ্যাতি লুটায়ে আসে পদতলে। চাটিয়া দেয় পদতল! সংখ্যালঘু হয়ে বাঁচতে হতো না। খাদের ধারেও আসতে হতো না।
স্যার বারবার বলে, সেভ ইওর মাইন্ড! কীভাবে বাঁচাব স্যার, খাদের ধারে আছি। বালিঘড়ি দিয়ে হুশহুশ করে গলে যাচ্ছে সমস্ত প্রত্যাশা, সমস্ত আনন্দ, ভালো থাকা। কতকাল ভালো পড়ি না, ভালো বাঁচি না। তবু, যেদিন রিহার্সাল থাকে, সারাদিনটা শেষ করে সন্ধা নামানোর অপেক্ষা করি! ওই ৩ ঘণ্টা জীবন। বাকি ২১ টা ঘণ্টা অভ্যাস, মৃতের শ্বাসযন্ত্রে পাম্প করা। যেদিন উড়ানের আড্ডা থাকে, যেদিন তুমি কিছু পড়াও, যেদিন কিচ্ছু না হয়ে স্রেফ একবাটিতে মুড়ি আর চানাচুর খাওয়া হয় বুঝি, এই কারণেই খাদের ধারে এসেও পড়ছি না। এমন কত খাদের ধার থেকে আরও কত শিক্ষক যে বাঁচিয়েছেন। এই লেখাতে সবার কথা থাকবে না ঠিকই। তবু, পিন্টু স্যার আমাকে অঙ্কভীতির খাদ থেকে তুলে এত দূরে সরিয়ে দিয়েছিল এককালে যে মাস্টার্সে গিয়ে স্ট্যাটিস্টিক্সকে আমার সবচেয়ে নিকট মনে হতো! মৈত্রেয়ী মাসিমার বড় বড় চোখের রাগ, গোপা মাসিমার নরম ইংরেজি ক্লাস! দেবী মাসিমা না থাকলে কি কোনওদিন আমি ভূগোল পড়তাম? তিনি আমাকে ল্যাবের দায়িত্ব না দিলে সত্যিই কি কোনওদিন বুঝতাম আমিও নির্ভরযোগ্য? আর বিশ্ববিদ্যালয়ে? গোপা সামন্ত! জীবন কীভাবে বাঁচতে হয়! আমি গোপাদিকে দেখি অলক্ষ্যে। ঋজু, দৃঢ়, সিরিয়াস, অথচ কী সহজ, সুন্দর! কী লড়াই। অথচ প্রকাশ কই!
আমি জানি না সুমিতদা, ততখানি যোগ্য ছাত্রী আমি হয়েছিলাম কিনা। 'যোগ্য' শব্দটি যে আমার সঙ্গে যায় না ইদানীং হরদম বাড়িতে টের পাই। আমি আবার সেই চুপ থাকা মাধ্যমিকের ছাত্রী হয়ে উঠছি। কথা নেই, মেশা নেই। বাঁচা নেই। সেই লস্ট চাইল্ড! যে একদিন তোমার ব্যাচ থেকে বুঝতে শিখেছিল জীবনের অতিরিক্ত বাঁচা রয়েছে, বাঁচার অতিরিক্ত আদর্শ রয়েছে। তোমার পতাকা বহিবার শকতি আমি চাই কিনা জানি না। শুধু চাই, যোগ্য ছাত্রী হতে না পারলেও যোগ্য কমরেড যেন হয়ে উঠতে পারি। প্রশ্নে, তর্কে, চিন্তায় এবং সত্যি সত্যি বাঁচায়!
ভালো থেকো, আমি আছি ঝগড়া করা আর গাল খাওয়ার জন্য।

Whatsapp
