দুনিয়া কাঁপানো দশ বিমান দুর্ঘটনা! যে বিভীষিকা তাড়া করে আজও
Biggest Aviation Tragedies : তদন্তে জানা যায়, ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণের ত্রুটির কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এরপর ডিসি-১০ বিমানের নকশা পরিবর্তন করা হয় এবং রক্ষণাবেক্ষণের নিয়ম কঠোর করা হয়।
ভারতের সবচেয়ে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা ঘটে গেল বৃহস্পতিবার৷ আহমেদাবাদের সরদার বল্লভভাই প্যাটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে লন্ডনের গ্যাটউইক বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হওয়া এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ান এআই-১৭১, (একটি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার) টেকঅফের কয়েক মিনিটের মধ্যেই মেঘানীনগর এলাকায় ভেঙে পড়ে। এই বিমানে ২৩০ জন যাত্রী এবং ১২ জন ক্রু সদস্য ছিলেন, মোট ২৪২ জন। দুর্ঘটনায় মাত্র একজন যাত্রী বেঁচে যান। ভারতীয় বংশোদ্ভূত সেই ব্রিটিশ নাগরিকের নাম বিশ্বাসকুমার রমেশ। তিনি ১১এ-তে আসনে বসেছিলেন। জরুরি প্রস্থানের কাছাকাছি থাকায় বেঁচে যান। দুর্ঘটনায় ২৪১ জন যাত্রী এবং ক্রু সদস্যসহ বেশ কয়েকজন ব্যক্তি নিহত হন। আহমেদাবাদের বিজে মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে বিমানটি আছড়ে পড়লে চারজন মেডিকেল ছাত্র এবং একজন ডাক্তারের স্ত্রী নিহত হন। প্রায় ৫০ জন ছাত্র আহত হন, যাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা গুরুতর।
তবে এই ঘটনাই প্রথম নয়। বিশ্বজুড়ে বারবার ঘটেছে ভয়াল সব বিমান দুর্ঘটনা। তারই কিছু নজির রাখা রইল এই প্রতিবেদনে।
টেনেরিফ বিমান দুর্ঘটনা, স্পেন (১৯৭৭)
১৯৭৭ সালের ২৭ মার্চ, স্পেনের টেনেরিফ দ্বীপের লস রোডিওস বিমানবন্দরে দুটি বোয়িং ৭৪৭ বিমান—কে এল এম ফ্লাইট ৪৮০৫ এবং প্যান আমেরিকান ফ্লাইট ১৭৩৬—রানওয়েতে মুখোমুখি সংঘর্ষে ধ্বংস হয়। এটি বিমান চলাচলের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা বলে বিবেচিত। ঘন কুয়াশার কারণে সেদিন দৃশ্যমানতা কম ছিল। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগের অভাবে কে এল এম বিমানটি টেকঅফের সময় প্যান আমেরিকান বিমান ধাক্কা খায়। এই দুর্ঘটনায় ৫৮৩ জন নিহত হন। মধ্যে কে এল এম-এর যাত্রী এবং বেশিরভাগ ক্রু এবং প্যান আমেরিকানের ৩৩৫ জন যাত্রী নিহত হন। মাত্র ৬১ জন বেঁচে ছিলেন, তারা সবাই প্যান আমেরিকান বিমানের যাত্রী ছিলেন। এই দুর্ঘটনার পর বিমান চলাচলের নিরাপত্তা নিয়মে বড় পরিবর্তন আনা হয়, যেমন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের জন্য আন্তর্জাতিক ভাষা তৈরি করা এবং ক্রু রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট প্রশিক্ষণ।
জাপান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ১২৩, জাপান (১৯৮৫)
১৯৮৫ সালের ১২ আগস্ট, জাপান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ১২৩, একটি বোয়িং ৭৪৭, টোকিও থেকে ওসাকার উদ্দেশে যাওয়ার সময় মাউন্ট তাকামাগাহারার কাছে ভেঙে পড়ে। বিমানের পিছনের প্রেসার বাল্কহেড ভেঙে যাওয়ার কারণে হাইড্রোলিক সিস্টেম বিকল হয়ে যায়। য পাইলট এ অবস্থায় বিমান নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ৫২০ জন যাত্রী এবং ক্রু নিহত হন, মাত্র ৪ জন বেঁচে ছিলেন। তদন্তে জানা যায়, বোয়িং-এর মেরামতে গাফিলতির কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এরপর বিমান রক্ষণাবেক্ষণের নিয়ম আরও কঠোর করা হয়।
৪. চরখি দাদরি মধ্য-আকাশে সংঘর্ষ, ভারত (১৯৯৬)
১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর, ভারতের হরিয়ানার চরখি দাদরির কাছে সৌদি আরেবিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৭৬৩ (বোয়িং ৭৪৭) এবং কাজাখস্তান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ১৯০৭ (ইলিউশিন আইএল-৭৬) মাঝ-আকাশে সংঘর্ষে ভেঙে পড়ে। এই দুর্ঘটনায় ৩৪৯ জন নিহত হন। কাজাখ পাইলটের ভুল উচ্চতায় ওড়ার কারণে এবং এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সমন্বয়ের অভাবের ফলে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এটি ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক বিমান দুর্ঘটনা। এরপর ভারতে ট্রাফিক কলিশন এভয়েডেন্স সিস্টেম (টিসিএএস) বাধ্যতামূলক করা হয়।
তুর্কিশ এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ৯৮১, ফ্রান্স (১৯৭৪)
১৯৭৪ সালের ৩ মার্চ, তুর্কিশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৯৮১, একটি ম্যাকডোনেল ডগলাস ডিসি-১০, প্যারিস থেকে লন্ডনের উদ্দেশে যাওয়ার সময় ফ্রান্সের এরমেননভিলে বনে ভেঙে পড়ে । বিমানের কার্গো দরজার ত্রুটির কারণে উড়ানের সময় দরজা খুলে যায়, ডিকম্প্রেশন জনিত কারণে বিমান নিয়ন্ত্রণ হারায়। ৩৪৬ জন যাত্রী এবং ক্রু নিহত হন। এই দুর্ঘটনার পর কার্গো দরজার নকশায় পরিবর্তন আনা হয় এবং বিমান নির্মাণে আরও কঠোর পরীক্ষার নিয়ম চালু হয়।
এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২, আটলান্টিক মহাসাগর (১৯৮৫)
১৯৮৫ সালের ২৩ জুন, এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ১৮২, একটি বোয়িং ৭৪৭, মন্ট্রিয়ল থেকে লন্ডনের উদ্দেশে যাওয়ার সময় আটলান্টিক মহাসাগরের উপর বিস্ফোরণের মুখে পড়ে। এটি একটি সন্ত্রাসী হামলা ছিল, যেখানে বিমানে বোমা রাখা হয়েছিল। ৩২৯ জন যাত্রী এবং ক্রু নিহত হন। এই ঘটনা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বিশেষ করে লাগেজ পরীক্ষার নিয়ম, আরও কঠোর করার কারণ হয়।
আমেরিকান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ১৯১, যুক্তরাষ্ট্র (১৯৭৯)
১৯৭৯ সালের ২৫ মে, আমেরিকান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ১৯১, একটি ম্যাকডোনেল ডগলাস ডিসি-১০, শিকাগোর ও’হেয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে টেকঅফের সময় ভেঙে পড়ে। বাম ইঞ্জিনটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যার ফলে হাইড্রোলিক সিস্টেম এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বিকল হয়। ২৭১ জন যাত্রী এবং ক্রু এবং মাটিতে থাকা ২ জন নিহত হন। তদন্তে জানা যায়, ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণের ত্রুটির কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এরপর ডিসি-১০ বিমানের নকশা পরিবর্তন করা হয় এবং রক্ষণাবেক্ষণের নিয়ম কঠোর করা হয়।
মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ১৭, ইউক্রেন (২০১৪)
২০১৪ সালের ১৭ জুলাই, মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ১৭, একটি বোয়িং ৭৭৭, আমস্টারডাম থেকে কুয়ালালামপুরের উদ্দেশে যাওয়ার সময় ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে গুলি করে নামানো হয়। এটি একটি সন্ত্রাস হামলা ছিল। রাশিয়া-সমর্থিত বিদ্রোহীরা বিমানটি নামাতে সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল ব্যবহার করে। ২৯৮ জন যাত্রী এবং ক্রু নিহত হন। এই ঘটনা যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার উপর দিয়ে বিমান চলাচলের ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং আন্তর্জাতিক বিমান রুটের নিরাপত্তা নিয়মে পরিবর্তন আনে।
কোরিয়ান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ০০৭, সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯৮৩)
১৯৮৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর, কোরিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ০০৭, একটি বোয়িং ৭৪৭, নিউ ইয়র্ক থেকে সিউলের উদ্দেশে যাওয়ার সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের আকাশসীমায় প্রবেশ করে এবং সোভিয়েত বাহিনী গুলি করে ওই বিমান নামায়। ২৬৯ জন যাত্রী এবং ক্রু নিহত হন। তদন্তে জানা যায়, নেভিগেশন ত্রুটির কারণে বিমানটি ভুল রুটে প্রবেশ করেছিল। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে বেসামরিক বিমানের জন্য জিপিএস-ভিত্তিক নেভিগেশন সিস্টেমের ব্যবহার বাড়ানোর কথা ভাবা হয়।
ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ৩০২, ইথিওপিয়া (২০১৯)
২০১৯ সালের ১০ মার্চ, ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৩০২, একটি বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স ৮, আদ্দিস আবাবা থেকে নাইরোবির উদ্দেশে যাওয়ার সময় টেকঅফের কয়েক মিনিট পর ভেঙে পড়ে। ১৫৭ জন যাত্রী এবং ক্রু নিহত হন। তদন্তে জানা যায়, বিমানের ম্যানুভারিং ক্যারেক্টারিস্টিক্স অগমেন্টেশন সিস্টেমে (এমসিএএস) ত্রুটির কারণে পাইলটরা নিয়ন্ত্রণ হারান। এই দুর্ঘটনার পর বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স বিমান বিশ্বব্যাপী গ্রাউন্ডেড হয় এবং বোয়িং-এর নকশা ও নিরাপত্তা প্রক্রিয়ার উপর নতুন করে পরীক্ষা শুরু হয়।