এক বৃদ্ধের হাতে জীবিত নাড়াজোলের কাঠের পুতুল শিল্প

Bengal Oldest Craft : বিশ্বনাথ বাবুর কথায় পুতুল সংগ্রাহক কুন্তল কুইল্যা তাঁকে নতুন করে এই পুতুল তৈরি করার অনুপ্রেরণা দিয়ে গিয়েছেন। সেই জন্য আজও এই পুতুল শিল্পটিকে তিনি টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

বঙ্গ জীবনের রঙ্গমঞ্চে রাজনৈতিক হানাহানি, কুৎসা, কেচ্ছা, দুর্নীতির খবরের বাইরেও রয়েছে এক অন্য বাংলা, যা সৃজন দিয়ে ঘেরা। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সেই বাংলা বলে চলে বাঙালির লোকায়ত জীবনের কথা। শিল্পের সহজাত অনুভূতি বাঙালির মধ্যে চির বিদ্যমান। আর তার উপর ভর করেই কখনও পাথরের মধ্যে তো কখনও মাটি ও কাঠ দিয়ে অনিন্দ্য সুন্দর মরমী শিল্পের সৃষ্টি করেছে বাঙালি। তার শৈল্পিক চেতনার বীজ নিহিত রয়েছে সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির মধ্যে। পশ্চিম মেদিনীপুরের ঐতিহাসিক জনপদ নাড়াজোলে সেই চেতনার বীজের দেখা মেলে আজও। ৮২ বছর বয়সে দাঁড়িয়েও নিজের অনুপম তুলির ছোঁয়ায় নিথর কাঠের মধ্যে জাগতিক প্রাণের স্পন্দন সৃষ্টি করে চলেছেন শিল্পী বিশ্বনাথ দে। তাঁর নির্মিত কাঠের পুতুল বাংলার লোকসংস্কৃতির ও ঐতিহ্যের অন্যতম স্তম্ভ।

বর্তমান সময় দাঁড়িয়ে কাঠের তৈরি পুতুলের প্রসঙ্গ উঠলে প্রথমেই পূর্ব বর্ধমানের অগ্রদ্বীপের নতুন গ্রামের প্রসঙ্গ উঠে আসে। কিন্তু এ বঙ্গভূমে এমন কয়েকটি জায়গা রয়েছে যেখানে আজও বহু প্রতিকূলতার মধ্যে কাঠের পুতুল তৈরির অস্তিত্ব টিকে রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো নাড়াজোল। শৈশবে পিতা পঞ্চানন দে-র থেকে কাঠের পুতুল তৈরির শৈলী শেখেন বিশ্বনাথ দে। বংশপরম্পরায় কাঠের পুতুল তৈরির প্রাথমিক পাঠ বাবার কাছ থেকে শিখলেও কিশোর বিশ্বনাথ দে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন পিয়াশালা এবং ক্ষীরপাইয়ের ঘরানার পুতুল নির্মাণ দেখে। শিল্পীর কথায়, আজ থেকে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় আগে অবিভক্ত মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায় রথের মেলা উপলক্ষ্যে বিপুল পরিমাণে কাঠের পুতুল গড়ে তুলত আঞ্চলিক শিল্পীরা। এমনকি সেই সময় শিল্পীদের থেকে পাইকারি বিক্রেতারা কাঠের পুতুল কিনে নিয়ে মেলায় বসতেন। সেই সময় একেকটা পুতুলের দাম ছিল এক থেকে দেড় টাকার মধ্যে। কৈশোর বয়সে বাবার সঙ্গে নাড়াজোলের মেলায় পুতুল নিয়ে বসতেন বিশ্বনাথ দে। সেই সময় আমড়া কাঠ দিয়ে পুতুল তৈরির রীতি ছিল। বাজার চলতি গুঁড়ো রঙকে তেঁতুল বীজের তৈরি আঠায় মিশিয়ে পুতুল দেহ রাঙিয়ে তোলা হতো। বর্তমানে যদিও পুতুল নির্মাণে আকাশমণি কাঠ ব্যবহার করা হয়। পুতুলের শরীর রঙে বাঙ্ময় করার ক্ষেত্রে আধুনিক ফেব্রিক কালার ব্যবহার করা হয়।

বিশ্বনাথ দে-র তৈরি কাঠের পুতুলের উচ্চতা ৯ ইঞ্চি। পুতুলটি আদতে বঙ্গবধূর প্রতীক। উন্নত ললাট। টানা চোখ। সিঁথিতে সিঁদুর। নাকে নথ। গাঢ় হলুদ মুখমণ্ডল। কপালে গোলাকার লাল টিকা। আর সেই টিকাকে ঘিরে ছোট ছোট সাদা রঙের গোলাকার টিকা। আলাদা করে পুতুলের হাত বা পা নেই। পুতুলটির কপালের দিকের অংশটি ত্রিকোণাকৃতি। পুতুলের গোটা শরীর নিজের মনের ভাবনায় অলংকরণ করে গিয়েছেন শিল্পী। এখানে শিল্পীর অনুপম ও ধৈর্যশীল তুলির স্পর্শ আমরা অনুভব করতে পারি। পুতুলের অলংকরণের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে শিল্পীর আলপনা শৈলী।

পুতুলটি গোলাকার নয়। অর্ধবৃত্তাকার। রঙ করার আগে কাঠটিকে খোদাই করে পুতুলের প্রাথমিক গঠন তৈরি করে নেন শিল্পী। তারপর শুরু হয় রঙের খেলা। পুতুলটির শরীরে ঘাগরা শৈলী তুলে ধরার জন্য কাঠের শরীরে বুকের দিকে বাটালি দিয়ে খাজ তৈরি করেন। আবার ঘাগরা শৈলীর প্রয়োজন না পড়লে খাঁজ দেন না। শিল্পীর কথায়, আজকের সময় দাঁড়িয়ে মেলায় এই পুতুলের চাহিদা একেবারেই নেই। তবুও কলকাতা থেকে আগত শিল্প রসিকরা নাড়াজোল ঘুরতে এলে এই পুতুলের খোঁজে তাঁর কাছে আসেন। রথযাত্রা উপলক্ষে এ বছর কাঠের ৯ ইঞ্চি উচ্চতার গোলাকার জগন্নাথদেব, বলভদ্র ও সুভদ্রা নির্মাণ করেছেন বিশ্বনাথ দে। জগন্নাথদেবের মস্তকে অনিন্দ্য সুন্দর মুকুট শিল্পীর মুন্সিয়ানার পরিচয় বহন করে চলেছে। বিশ্বনাথ বাবুর কথায় পুতুল সংগ্রাহক কুন্তল কুইল্যা তাঁকে নতুন করে এই পুতুল তৈরি করার অনুপ্রেরণা দিয়ে গিয়েছেন। সেই জন্য আজও এই পুতুল শিল্পটিকে তিনি টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু শুধু এই কাঠের পুতুল তৈরি করে সংসার চলে না, তাই এর পাশাপাশি মাটির প্রতিমা নির্মাণ করে থাকেন তিনি। উল্লেখ করা যেতে পারে গোটা নাড়াজোলে একমাত্র তিনিই এই কাঠের পুতুল তৈরির শিল্পকে ধরে রেখেছেন। নাড়াজোল পোড়ামাটির মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। সেখানে দাঁড়িয়ে নাড়াজোলের লুপ্তপ্রায় শিল্পধারাকে নিজের হাতে টিকিয়ে রেখেছেন শিল্পী বিশ্বনাথ দে।

More Articles