এই ছবির জন্য পুড়ে গিয়েছিল বাড়ির পর বাড়ি! অভিশপ্ত 'ক্রাইং বয়'-র কাহিনি ভয় পাওয়াতে বাধ্য
The Crying Boy Cursed Painting : ‘ক্রাইং বয়’ ছবিটি ঘিরে তৈরি হয়েছে এমনই রোমহর্ষক সব কাহিনি। যার অনেকটাই সত্যি! তাহলে কি… সত্যিই অভিশপ্ত এই ছবি?
আপাতদৃষ্টিতে দেখলে, বেশ সুন্দর, সাধারণ একটা ছবি। তেলরং দিয়ে আঁকা একটি ছোট্ট শিশুর মুখ। একটু এলোমেলো চুল, বড় বড় চোখ করে আপনার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে সোজা। কিন্তু সেই দৃষ্টিতে কোনও ভয় বা অন্য কিছু নেই, আছে দুঃখ। করুণ মুখে সেই ছোট্ট শিশুটি যেন ছবির ভেতর থেকেই আপনাকে কিছু বলতে চাইছে। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে কান্না। যেন শত রাজ্যের কষ্ট, ভেঙে পড়া পৃথিবী সেই ছবিটির পাশে এসে বসেছে। সুন্দর, মায়াময়, অথচ খুব সাধারণ এই ছবি। যে কোনও প্রদর্শনীর জায়গায় এমন ছবি দেখা যেতে পারে। কিংবা বাড়ির ড্রয়িংরুমে। সাধারণ হলেও, ছবিটার ভেতর কেমন একটা ঘোর আছে। সবসময় যেন নিজের দিকে টানছে সেই শিশুটি। সেই কান্না যেন মোহাবিষ্ট করে রাখছে আপনাকে।
শিশুর কান্না হয়তো এমনই। কিন্তু গল্পটি এখানেই শেষ নয়। বরং এটা কিঞ্চিৎ গৌরচন্দ্রিকা বলা যায়। আসল ঘটনার এখনও কয়েক অধ্যায় বাকি। ঐতিহাসিকরা বলেন, এই ছবিটি একটা সময় গোটা বিশ্বে ঝড় তুলেছিল। নাম ‘দ্য ক্রাইং বয়’। সামান্য এই ছবি, এই ক্রন্দনরত শিশুর মুখটি নাকি অভিশপ্ত! যাদের বাড়িতেই ঠাই পেয়েছে, তাঁদেরই জীবনে নেমে এসেছে অমঙ্গল। জ্বলে পুড়ে গিয়েছে সমস্ত বাড়ি। কেবল বেঁচে গিয়েছে এই ছবিটি। বিন্দুমাত্র কোনও ক্ষতি হয়নি। হলিউডের কোনও গা ছমছমে, ভৌতিক সিনেমার স্ক্রিপ্ট মনে হচ্ছে? সে হতেই পারে, কিন্তু ‘ক্রাইং বয়’ ছবিটি ঘিরে তৈরি হয়েছে এমনই রোমহর্ষক সব কাহিনি। যার অনেকটাই সত্যি! তাহলে কি… সত্যিই অভিশপ্ত এই ছবি?
১৯৮৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর। ইংল্যান্ডের দৈনিক পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়। রন আর মে হল নামে এক দম্পতির বাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন তাঁরা। বাড়ির সমস্ত আসবাব, সামগ্রী সমস্ত কিছু চোখের নিমেষে ছাইয়ে পরিণত হয়। না, এখানে একটা ভুল হল। সমস্ত জিনিস নয়; কারণ ছাই ঘেঁটে দমকলকর্মীরা একটি ছবি উদ্ধার করেন। একটি ছোট্ট শিশুর ক্রন্দররত ছবি, করুণ মুখে সে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। অদ্ভুত ব্যাপার হল, বাড়ির সমস্ত জিনিস পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও এই ছবিটির গায়ে আগুনের আঁচটুকুও লাগেনি! ব্যস, সেই সময় থেকেই সামনে এল ‘দ্য ব্লেজিং কার্স অফ দ্য ক্রাইং বয় পিকচার’। হল দম্পতির দাবি, এই ছবির জন্যই নাকি তাঁদের এই দুর্দশা! অভিশাপ লেগেছে তাঁদের ওপর!
এখান থেকেই আসল ঘটনার শুরু। এরপরই তৎকালীন দমকল বাহিনীর কর্তা আরেক চমকপ্রদ তথ্য সংবাদমাধ্যমে পেশ করেন। তিনি বলেন, হল দম্পতির বাড়ির অগ্নিকাণ্ড আর এই ছবির ব্যাপারটিই প্রথম ঘটনা নয়। তিনি নাকি এর আগেও এমন ১৫টির বেশি অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী থেকেছেন। অদ্ভুতভাবে, প্রতিটি জায়গায় বাড়িগুলি ছাই হয়ে ধংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সেখানেই বেঁচে গিয়েছে এই ক্রন্দনরত শিশুর ছবিটি। হ্যাঁ, প্রত্যেকের বাড়িতে এই একটি ছবির উপস্থিতিই মিলে গিয়েছিল। সেইসঙ্গে মিলেছিল অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। হ্যাঁ, এই ছবিটিই ‘দ্য ক্রাইং বয়’।
ইংল্যান্ড জুড়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল এই খবর। বিলেতের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাইরেও চলে গেল এই ‘ভৌতিক’ ব্যাপার। তাহলে কি সত্যিই কোনও অভিশাপ লুকিয়ে আছে ছবিটির পেছনে? নয়তো যে বাড়িতেই যাচ্ছে, সেটিই পুড়ে যাচ্ছে! কিন্তু ছবিটির কোনও ক্ষতি হচ্ছে না! খবরের কাগজে পরপর বেরতে থাকে বিশেষ প্রতিবেদন। তার ফল? ১৯৮৫-র নভেম্বরে, হ্যালোউইনের সময় গোটা দেশে ‘আগুন’ জ্বলল। হাতের সামনে ‘ক্রাইং বয়’-এর যতগুলো ছবি ছিল, সব জড়ো করা হল এক জায়গায়। তারপর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। কয়েকশো ছবি এভাবে রাতারাতি পুড়ে খাক হয়ে যায়।
কিন্তু আসল কথাটি তো রয়েই গেল। এই ছবির পেছনে রহস্য কী? কে এঁকেছিলেন এই ‘ক্রাইং বয়’? এই ছেলেটিই বা কে? এ নিয়ে অনেক বিতর্ক, বিশ্লেষণ আর অনুসন্ধান করা হয়েছে। ঐতিহাসিকরাও এই কাজে বারবার মাঠে নেমেছেন। কয়েকটি ছবির নিচে বিশেষ একজনের সই দেখা গিয়েছে, নাম 'গিয়াবনি ব্রাগলিন'। তাহলে কি তিনিই এই অভিশপ্ত ছবির চিত্রশিল্পী? তবে এটি তাঁর আসল নাম না ছদ্মনাম সেটা জানা যায়নি। বিস্তর অনুসন্ধানের পর ছবির পেছনের কাহিনি একটু সামনে আসে। ছবিতে যে বাচ্চাটিকে দেখা যায়, সে আসলে ভবঘুরে। নাম - ডন বোনিলো। একেবারে হতদরিদ্র অবস্থা ছিল তার। আর তারই জীবনের সঙ্গে নাকি জড়িয়ে আছে একের পর এক মর্মান্তিক, রহস্যজনক ঘটনা।
একবার ভালো করে, মন দিয়ে ডন বোনিলোর জীবনের ঘটনাগুলি খেয়াল করবেন। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষের দিকে ইতালির রাস্তায় বাচ্চাটিকে একা একা ঘুরতে দেখেন চিত্রশিল্পী। তার আগে সমস্ত জায়গা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল তাকে। কেন? পাদ্রিদের দাবি, এই বাচ্চাটি নাকি 'পিশাচ'! ডন বোনিলোর মা-বাবার মৃত্যু হয় আগুনে পুড়ে। সেই দৃশ্য নিজের চোখে দেখে ডন। তারপরই অনাথ শিশুটি চলে আসে রাস্তায়। মলিন বেশভূষা, করুণ চোখ, খালি কাঁদছে। চিত্রশিল্পী তাকে নিজের বাড়ি নিয়ে আসেন। আহা, এমন শিশু, এত কম বয়সে মা-বাবাকে হারাল! করুণ মুখখানি শুকিয়ে একটুখানি হয়েগিয়েছে। তাঁর বাড়িতেই খেয়েপরে বড় হতে থাকল ডন বোনিলো।
আর এই ডনই ছিল চিত্রশিল্পীর মডেল। তাঁর করুণ মুখটিকে তেলরংয়ের মাধ্যমে ক্যানভাসে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তিনি। একসময় সেটি পারলেনও। বাজারে আসার পর বিপুল সাড়া ফেলে ছবিটি। অনেকেই কিনে নেন এর কপি। কিন্তু এরপরই নেমে আসে চরম দুর্যোগ। হঠাৎ করে একদিন সেই শিল্পীর স্টুডিওটি আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। মাথায় হাত পড়ে যায় তাঁর। মনে পড়ে পাদ্রিদের কথা, তাহলে ডন বোনিলো, নিস্পাপ শিশুটিই 'অভিশপ্ত'? সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বের করে দেন ছোট্ট বাচ্চাটিকে।
তারপর ডন বোনিলো কোথায় যায়, কী করে, কিচ্ছু জানা যায় না। শুধু এটুকু জানা যায়, ১৯৭৬ সালের আশেপাশে স্পেনে একটি গাড়ি দুর্ঘটনা হয়। সেই দুর্ঘটনায় গাড়িটি জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যায়। জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যায় গাড়ির চালক। ড্রাইভিং লাইসেন্সের অংশবিশেষ থেকে জানা যায়, গাড়ি চালাচ্ছিল যে তরুণ, তাঁর নাম ডন বোনিলো! ব্যস, ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠল এই খবরটি। খেয়াল করে দেখুন, প্রতিটা ক্ষেত্রে একটা জিনিসেই মিল। সবাই আগুনে পুড়েই মারা গিয়েছে, যা ক্ষতি হওয়ার আগুন করেছে। তাহলে কি...!
কথায় বলে, বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু তর্কে বহুদূর। 'দ্য ক্রাইং বয়' নিয়ে তর্ক আজও অব্যাহত। গবেষকদের মত, ওই ছবিগুলিতে এমন পদার্থ দিয়ে বার্নিশ করা হয়েছিল, যা অগ্নিনিরোধক। সেজন্য আগুন ধরেনি। দ্বিতীয়ত, মানুষের খামখেয়ালিপনা বা অন্য কোনও কারণেও আগুন লেগে থাকতে পারে। কাকতালীয়ভাবে, সবার বাড়িতেই এই ছবিটাই ছিল। আর 'ক্রাইং বয়' এত বেশি বিক্রি হয়েছিল যে, অনেকের বাড়িতে থাকাটা কোনও আশ্চর্যের নয়। এভাবেই রহস্য, মিথ আর অলৌকিক ঘটনায় মিলেমিশে আছে একটিমাত্র ছবি।