শাপ: সুনেত্রা সাধুর গল্প
The Dark Realities of Modern India : ছবিতে একটা গাড়ি ঘিরে বিরোধী দুই দল বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। যেসব সাংবাদিক নিউজ চ্যানেলে কাজ করে তারা জানে একটা খবরের মতো খবর রক্তের গতিবেগ ঠিক কতখানি বাড়িয়ে দেয়।
তারপর সেই রাজা পাথর হয়ে গেল। ওই নিষিদ্ধ রূপের তেজ সহ্য করা কি সোজা কথা? সন্ন্যাসী গল্প থামিয়ে সিড়িঙ্গে চ্যালাটার হাত থেকে কলকে নিয়ে টান দিল। বাতাসে সাদাটে ধোঁয়া উড়ছে। তিথি সন্ন্যাসীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল, এত স্পষ্ট বাংলা বলা সন্ন্যাসী সে আগে কখনো দেখেনি। নকল নাকি! গায়ে ধর্ম চাপিয়ে লুকিয়ে আছে! কী করেছে? খুন? ধর্ষণ? ডাকাতি? তিথি বোধহয় একটু বেশিই ভাবছে। ক্রাইম রিপোর্টার হওয়ার বড় জ্বালা। ছক ভাঙা মানুষ মাত্রই সন্দেহজনক মনে হয়। সন্ন্যাসীর অবশ্য হেলদোল নেই। মৌজ করে গাঁজায় টান দিচ্ছে। তিথি নাক টেনে গন্ধ নিল। তামাক আর আপেল মেশানো চেনা কলেজ ঠেকের গন্ধ। “চ্যালাটা বলে উঠল “রাজা পাথর হল? নাকি পুরোহিত?”
সন্ন্যাসী খর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সত্য যুগ হলে চ্যালা এতক্ষণে ভস্ম হয়ে যেত। মৌতাত ভেঙে কড়া গলায় একটা মূর্তি দেখিয়ে বলল “একে দেখে তোর পুরোহিত মনে হয়? পুরোহিতের ঘোড়া থাকে? মাথায় পাগড়ি থাকে? এ হল কোচ রাজা নারায়ণ। লোভ। বুঝলি লোভ সাধনা ছাড়া ঈশ্বর লাভের আকাঙ্খাও এক ধরণে্র লোভ।
তিথি মূর্তিটার দিকে চোখ ফেরাল। কামাখ্যা মন্দিরের পাথুরে চাতালের একপাশে ঘোড়ার উপর বসে আছে এক খর্বকায় রাজ পুরুষ। ঘোড়াটিও মানানসই রকমের ছোট, খেলনা যেন। সিঁদুর লেপা সেই রাজার চোখ মন্দিরের দিকে। সেখানে ছোট্ট সুরঙ্গের মতো একটি জানলা। ওপাশে নিরেট আঁধার।
“রাজা মাত্রই অহঙ্কারী, পুরোহিত কেন্দুকলাই অনেকবার নিষেধ করেছিল, শোনেননি। পুরোহিতের ঈশ্বর প্রাপ্তি হবে রাজার হবে না তা কখনো হয়। রাজা জেদ ধরলেন, নৃত্যরত দেবীকে দেখবেন। প্রতিদিন সন্ধ্যা আরতির সময় মা কামাখ্যা আবির্ভূত হতেন। বাদ্য যন্ত্রের তালে তালে মন্দিরের গর্ভগৃহে নৃত্য করতেন। পুরোহিত উপলব্ধি করতে পারতেন, কানে আসত নুপুরের নিক্কন। একদিন রাজা জানলায় চোখ রাখলেন, ওই নিষিদ্ধ রূপের তেজ সহ্য করা কি সোজা কথা! অভিশপ্ত রাজা আজও পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পুরোহিতের মৃত্যু হয়েছে, আর কোচ রাজবংশের কেউ আজও নীলাচল পর্বতের ছায়া মাড়ায় না। গল্পটা শেষ করে সন্ন্যাসী তিথির দিকে প্রত্যাশা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তিথি একটা একশো টাকার নোট রেখে উঠে দাঁড়িয়েছিল, সন্ন্যাসী বলে উঠল “রজঃস্বলা দেবীর রক্তবস্ত্র আছে। মাদুলিতে ধারণ করিস, কোনো বিপদ ছুঁতে পারবে না। পাঁচশো এক টাকা দে…”
তিথি আবার বসে পড়ল। বুকটা ধক ধক করছে। শরীর খারাপ লাগছে। রোগটা নতুন এবং তিথির পেশার সঙ্গে বেমানান। সেটা তিথি বোঝে, সেরে উঠতে চাইছে। বিকেল বেলার সেই বাদানুবাদ আবার মাথায় এল, “ঈশ্বরের কোনো প্রাইভেসি থাকতে নেই? শত শত ভক্ত আসবে, যোনি ছুঁয়ে পূণ্যলাভ করবে! ঈশ্বরের ইচ্ছে অনিচ্ছা থাকবে না? সবটাই ব্যবসা?” কথাগুলো তিথি কাউকে বোঝাতে পারছে না। এই নিয়ে পিসেমশাইয়ের সঙ্গে তুমুল তর্ক হয়েছে। পিসেমশাই অতি ধার্মিক মানুষ। তিনিও গলা তুলে তর্ক করেছেন। “যদি লিঙ্গ পুজোয় তোমার আপত্তি না থাকে তাহলে যোনিপুজোয় থাকবে কেন? এ আসলে সৃষ্টির আরাধনা। অম্বুবাচীর কয়দিন হলকর্ষণ নিষিদ্ধ! প্রকৃতি মাতা তখন রজস্বলাঃ হন। তারপর সারা বছর গর্ভে ধারণ করেন সোনালী ফসল। অভুক্ত মানুষ বাঁচে…”
“মাতৃ আরাধনা, তাই না? শুনেও সুখ। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিমবঙ্গের সেইসব ফসলের ক্ষেতে কত ধর্ষণ হয় তোমার জানা আছে? যোনিপুজো! যাও তোমরা দর্শন করে এসো আমি বাইরে বসছি।” সরে এসেছিল তিথি।
ওর কাকীমা আক্ষেপের সুরেই বলেছিল “নিউজ চ্যানেলে কাজ করতে করতে ঝগড়া করাটা স্বভাবে দাঁড়িয়েছে।” তিথির মা নেই, ওর বাবা চুপ করেই ছিল। যেমন সব সময় থাকে।
আরও পড়ুন- বুবি ও তেঁতুলভূতের গল্প : অমৃতা ভট্টাচার্য
তিথির পরিবার এখন সর্পিল কাচের ঘরে হাজার হাজার ভক্তের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে দর্শনের অপেক্ষা করছে। একটু পরেই তারা সরু খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে কামাখ্যা মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করবে। তারপর পান্ডা তাদের হাতটি ধরে জলে ভরা একটি যোনি আকৃতির এক প্রস্তর খন্ড স্পর্শ করিয়ে দেবে। ভাবতেই তিথির কেমন যেন ভয় করল, নাকি কুন্ঠা? লজ্জা? যেন সেটা মা কামাখ্যার নয় ওর নিজেরই… সে কি নিজেকে দেবী ভাবতে শুরু করেছে? ক্ষমতাশালী দেবীকে সে সাধারণ মেয়ের অসহায়ত্ব দিয়ে মাপতে চাইছে? তিথির বোধহয় পাপ হচ্ছে, ভয়ঙ্কর পাপ। সে হলফ করে বলতে পারে এই যে হাজার হাজার ভক্ত তাদের মধ্যে কেউ তিথির মতো করে ভাবছে না, মন্দির থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে চাইছে না। শুধু তিথির কেন এমন হচ্ছে! অস্থির লাগছে। ব্যাগে প্যানিক অ্যাটাকের ট্যাবলেট ছিল, জিভের তলায় রাখল। সন্ন্যাসীকে পিছনে ফেলে সে বাজারের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। পুজোর সামগ্রী, পিতলের বাসন, পাথরে দেবদেবী, খেলনা, দেদার বিকোচ্ছে। তেষ্টা পেয়েছিল, একটা খাবার দোকান থেকে জল কিনতে গেল। দোকানে অনেক খদ্দের। এক মাঝবয়সী অবাঙালী ভদ্রমহিলা পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, তিথিকে দেখে জিজ্ঞাসা করল “দর্শন হো গয়া?”
তিথি এমন করে হাসল যার অর্থ হ্যাঁ বা না দুটোই হতে পারে। মন্দিরে ঢোকার আগে তিথির জেঠতুতো দিদি বলেছিল “কামাখ্যা দর্শন সবার হয় না। ঈশ্বরের কৃপা লাগে। কপাল লাগে। মন্দিরের দরজায় দাঁড়িয়েও তুই ফিরে যাচ্ছিস।”
তিথি পালটা জিজ্ঞাসা করেছিল “কার কপাল? তোর নাকি ঈশ্বরের? যা দর্শন দিয়ে কামাখ্যা দেবীকে ধন্য করে আয়।”
তিথির কথায় দিদি দুঃখ পেয়ে বলেছিল “ছেলেপুলে নিয়ে সংসার করি, কল্যাণ-অকল্যাণের ভয় আমার আছে। তোর মতো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে উড়ে বেড়াতে পারি না। ধর্মস্থানে এসেছি ঠাকুর দর্শন করব না এত অহঙ্কার আমার নেই।”
“অহঙ্কার নয় এ আমার পিতৃতন্ত্রের প্রতি জেহাদ। তুই কী ভাবে আরাধনা করবি সেটাও এদের ইচ্ছের উপর নির্ভর করে।” তিথি কথাগুলো বলতে চেয়েও পারেনি, নীরবে সরে এসেছিল। “কুড়িটাকা দিন।” দোকানির গলা শুনে তিথির চমক ভাঙল। জলের দাম মিটিয়ে ফিরছিল। পাশে দাঁড়ানো মহিলাটি বোধহয় আরো কিছু বলত ঠিক সেই সময় একটা ফোন এল। বোধিসত্ত্ব, তিথির সহকর্মী, বন্ধু, সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার।
“আমাকে একটু শান্তি দিবি না বোধি? তিনবছর পর দশটা দিন ছুটি নিয়েছি। প্লিজ এখন আর কাজ দিস না। পারলে এক বস্তা শান্তি দে।” তিথির বড় ক্লান্ত লাগছে…
“সরি রে, শান্তির ভাঁড়ার শূন্য, দিতে পারলাম না। মেল চেক কর, আজ রাতের ফ্লাইটে তুই গুয়াহাটি থেকে ফিরছিস। টিকিট পাঠানো হয়েছে।”
“মানে টা কী! আজই রিজাইন করব। আমি স্লেভ নাকি? অ্যাপ্রুভ করা ছুটিও ক্যানসেল হবে? অনেক প্ল্যান করে অরুণচলের ট্রিপটা শেষ পর্যন্ত হয়েছে, পুরো পরিবার সঙ্গে আছে তাদেরকে কী বলব? আর বাবা? আমি ফিরে গেলে ওরাই বা আমার বয়স্ক বাবার দায়িত্ব নেবে কেন? চ্যানেলে আর কোনো রিপোর্টার নেই?”
“কাম ডাউন। শান্ত হ তিথি। কোথাও একটু বস। আছিস কোথায়?”
“কামাখ্যা মন্দিরে। বল শুনছি।”
“একটা ইন্সিডেন্ট হয়েছে। কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালে, মেয়েটা ডাক্তার। আজ সকালে ইমার্জেন্সির চার তলার হলঘরে মেয়েটাকে পাওয়া যায়। ওর মা দাবি করেছেন, অর্ধনগ্ন’ অবস্থায় মেয়ের দেহ মিলেছে। ধর্ষণের অভিযোগ উঠছে। পুলিশ বলছে সুইসাইড। এখন বিরোধী দলগুলো মৃতদেহ নিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। তুই কি গ্রুপের মেসেজও চেক করিসনি?”
“নাহ, নেট অফ করে রেখে দিয়েছি। দু’একটা কল ছিল ধরিনি।”
“আমার কলটা রিসিভ করলি কেন?”
তুই এই খবর দিবি জানলে করতাম না। আমার কি কোথাও এতটুকু শান্তি নেই? আজ কেন জানি খুব মন কেমন করছে। বাড়ির লোকের সঙ্গে অকারণে ঝগড়া করলাম। এখন আবার এই খবর। মেয়েটাকে একেবারে মেরেই ফেলল?”
“ইয়েস, আত্মহত্যা বলে চালাতে চাইছে কিন্তু তা নয়। মন বলছে এই কেস বহুদুর গড়াবে। প্লিজ তুই ফিরে আয়। আই কান্ট হ্যান্ডেল ইট অ্যালোন। চিফ একটু পরেই কল করবে। তোকে চাইছে।”
“চাইছে মানে চ্যানেলে বসে মেয়েটার ইজ্জত নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে হবে এই তো? ক’জন মিলে ধর্ষণ করল, কতক্ষণ ধরে, কোথায় কোথায় কটা আঁচড় আছে, কতটা রক্তপাত হল সেই খবর রসিয়ে রসিয়ে বেচতে হবে। সেটাই স্পষ্ট করে বল না…”
“সেটা কি তুই জানিস না? এর আগে কখনো রসিয়ে রসিয়ে ধর্ষণের খবর বিক্রি করিসনি? জানিস না এটাই আমাদের কাজ? নতুন মনে হচ্ছে? আর ইটস নট আ নরম্যাল রেপ কেস, আমার ধারণা এর পিছনে প্রচুর কোরাপশন আছে, গাট ফিলিং বলছে রাজনীতির রূপরেখাটা এই কদিনে তুমুল ভাবে বদলে যাবে। ইটস টাইম তিথি।”
“ঠিক ঠিক। চ্যানেলের সু’সময়। কিন্তু নর্মাল রেপ বলতে তুই ঠিক কি বোঝাতে চাইলি? ধর্ষণের পর বেঁচে থাকলে নর্মাল, তাই তো? এমন আর কি! একটু ফুর্তি করতে সাধ হয়েছিল, করেছে। ছেলেরা অমন করে। মরে তো যায়নি। তোর কি মনে হয় একটা ধর্ষিতা মেয়ে শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছে মানেই বেঁচে আছে? সবটাই খুব নর্ম্যাল?”
“তোর কি হয়েছে তিথি? এমন করে কথা বলছিস কেন? আমাকে চিনিস না? আমি কী বলতে চাই বুঝিস না? মনে করে দেখ, পার্কস্ট্রীট ধর্ষণের খবর বেচেই কিন্তু চ্যানেলের চাকরিটা পাকা করেছিলি। ফিরতে হবে না। এনজয় ইয়োর হলিডে।” রেগে গিয়ে ফোনটা কেটে দিল বোধিসত্ত্ব। তিথি দোকানের চেয়ারে বসে পড়েছে। নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছে না। ওর দু’গাল বেয়ে জল ঝরছে, ঠোঁট কাঁপছে। ভাবছে আর একটা ‘যোনিপুজো’ হয়ে গেল। সেই ভদ্রমহিলা এতক্ষণ তিথির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। গলায় সহানুভূতি জড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল “কোই মর গয়া কেয়া?”
তিথি আর মেজাজ ধরে রাখতে পারল না। বেশ চেঁচিয়েই বলল “হ্যাঁ মরে গেছে, আমি আপনি আর যত মেয়ে আছে সব্বাই মরে গেছে। যারা ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে সব্বাই জিন্দা লাশ।”… বলেই হনহন করে গাড়ির দিকে হাঁটা লাগালো।
মহিলা হাঁ করে তিথির চলে যাওয়া দেখল, তারপর অস্ফুটে বল , “শায়দ পাগল হোগা ।”
ঢালু রাস্তার বেশ খানিকটা নীচে পার্কিং, গাড়িটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। চেনা ড্রাইভার তিথিকে দেখে এগিয়ে এল। ও জানালো হোটেলে যাবে, আজই কলকাতায় ফিরছে। ড্রাইভার গাড়ি ঠিক করে দিল। গাড়িটা অপেক্ষা করবে তারপর তিথিকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে। সন্ধ্যা নেমেছে। দুপাশে অজস্র দোকানপাট, আলো জ্বলে উঠছে। যেন উৎসব। অনেক দূরে কে বা কারা এক মায়ের কোল খালি করে দিল। মেয়েটার বাড়ি আজ আঁধারে ঢাকা। আর কখনো আলোর মতো আলো জ্বলবে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিথি ফোনটা বার করে প্রথমে টিকিট চেক করল তারপর বোধিসত্ত্বর নাম্বার ডায়াল করল, বেজে যাচ্ছে। একেবারে শেষ রিং-য়ে বোধির গলা পাওয়া গেল। নিউজরুমে ঢুকছি, যা বলার জলদি বল।”
“ফিরছি। তোর ফ্ল্যাটে উঠব। বাড়ির চাবি পিসিমণির বাড়িতে, রাতে ওদের আর বিরক্ত করব না। তোর অসুবিধা থাকলে বল, হোটেলে চলে যাব।”
“এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করিস, আসব। ফোনটা কেটে দিল বোধিসত্ত্ব। বেশি রাগ, মনে মনে গজ গজ করল তিথি। বাবাকে ফোন করল, এতক্ষণে দর্শন হয়ে গেছে, মন্দির তো সাড়ে পাঁচটায় বন্ধ হয়ে যায়। আশেপাশের মন্দিরও বোধহয় দেখা হয়ে গেছে।
তিথির বাবার কন্ঠস্বরে উদ্বেগ, “তুই কোথায় তিথি? যেখানে বসবি বলেছিলি সেখানে তো খুঁজে পেলাম না। এক্ষুণি ফোন করতে যাচ্ছিলাম। বড় চিন্তায় ফেলিস।”
“আমাকে কলকাতায় ফিরতে হবে বাবা। কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালে একটা ইন্সিডেন্ট হয়েছে। নিউজ দেখো। ফেরাটা জরুরী। তোমরা কি হোটেলে ফিরছ?”
“আসছি।” বলে ফোনটা কেটে দিল তিথির বাবা। ওর ফেরার খবরটা এতক্ষণে সোরগোল ফেলে দিয়েছে। হয়তো সবাই ধরেই নিয়েছে কথাকাটাকাটির জন্য তিথি রাগ করে চলে যাচ্ছে। উফফ, জীবনটা কেন এত কঠিন কে জানে…
হোটেলে ফিরে তৈরি হল তিথি। টুকটাক যা ছড়িয়ে ছিল গুছিয়ে প্যাকিং সারল। তারপর হোটেলের লবিতে পরিবারের অপেক্ষায় বসে রইল। ফ্লাইট পৌনে দশটায়। গুয়াহাটি শহরে প্রবল যানজট হয়। একটু আগেই বেরোতে হবে। লবিতে বসেই সেলফোনে চ্যানেলের লাইভ দেখছিল, বোধিসত্ত্ব খুব উত্তেজিত হয়ে খবর পরিবেশন করছে। ছবিতে একটা গাড়ি ঘিরে বিরোধী দুই দল বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। যেসব সাংবাদিক নিউজ চ্যানেলে কাজ করে তারা জানে একটা খবরের মতো খবর রক্তের গতিবেগ ঠিক কতখানি বাড়িয়ে দেয়। তিথি উত্তেজনাটা শরীর দিয়ে অনুভব করতে পারছে। ওর মগজটা কাজ করতে শুরু করেছে। খবর চাই, খবর। ঠিক কোন কোন সোর্সকে এই মুহূর্তে কল করতে হবে ছকে নিচ্ছে। চিফের সঙ্গেও কথা হল। কয়েকটা জরুরী ফোন সারল। তিথি ক্রমশ একটু একটু করে কাজের গর্ভে ডুবে যেতে থাকল।
ফোনটা রাখতেই তিথি দেখল পরিবারে সবাই ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। কারো মুখে বিরক্তি, কারো দুশ্চিন্তা। তিথি ঠিক করল সারাদিনের খারাপলাগা আর পুষে রাখবে না। জেঠতুতো দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলল কিছু মনে করিস না। যদি তোর মতো একটা জীবন পেতাম তাহলে একটু শান্তিতে থাকতে পারতাম। পিসেমশাই মাথায় হাত রেখেছিল, বলল “সাবধানে যাস। খবরটা শুনলাম।”
কাকীমা দু'খানা বিস্কুটের প্যাকেট হাতে দিয়ে বলল “খাওয়ার কথা তো মাথায় থাকে না, এটা অন্তত ব্যাগে রাখ। চিন্তা করিস না, দাদার কোনো অসুবিধা হবে না।” বাবাকে দেখে তিথির গলায় বাষ্প জমছিল। বাবার জন্য দশটা দিন সে তুলে রেখেছিল সেটুকুও দিতে পারল না। বেরিয়ে এল। পিছনে পড়ে রইল বহু কাঙ্খিত বমডিলার মনাস্ট্রি, বুমলার নিঃসঙ্গ পাহাড় আর জিয়াভরালি নদী…
(২)
এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতে বেরোতে মাঝরাত হয়ে গেল। বোধিসত্ত্ব অপেক্ষা করছিল, এখন গাড়িটা রাতের শহরের বুক চিরে ছুটে চলেছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা। তিথি বা বোধি তখনো জানে না আর চারটে দিন পরেই রাতের রাজপথে থই থই করবে মানুষ, বাতাসে ভাসবে প্রতিবাদের স্লোগান। বুম হাতে তিথি শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়াবে। রক্তে জেগে উঠবে অদ্ভুত উত্তেজনা। সবার ভিতরে বাস করা সুপ্ত দেবী জেগে উঠতে চাইবে। বলবে অশুভের বিনাশ চাই, আজই…
কিন্তু ভবিষ্যত কেই বা দেখতে পায়? তিথিরাও পায়নি। বোধি কপালে দুটো ভাঁজ ফেলে গাড়ি চালাচ্ছিল আর তিথির মনে হচ্ছিল সে অকারণ বোধিকে ব্যস্ত করল।
“এখনো রেগে আছিস?”
“ধুর, পাগল নাকি!” আলগা হাসল বোধি। “আজ একটা দিনে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেল রে। নিউজ আপডেট দেখ। মেয়েটার মা বাবা থানায় অভিযোগ করেছেন। তার একটু পরেই পুলিশই বলছে যৌন নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। পুলিশ এতরকম কথা বলতে চাইছে কেন? কাকে কাকে বাঁচাতে চাইছে?”
“যাদের বাঁচাতে চাইছে তাদের কথা আমরা চ্যানেলে বসে বলতে পারব? সে ক্ষমতা আমাদের আছে বোধি?”
“তাই বলে চ্যানেল নিরপেক্ষ হবে না?”
বোধির কথায় হা হা শব্দে হেসে উঠল তিথি। “তুই কি নেশা করেছিস বোধি? নাকি সোনার পাথরবাটির হদিশ পেলি?” বাকী রাস্তা কেজো কথায় কাটল। অনেক রাতে খাওয়া সেরে ওরা দুজনে বারান্দায় বলেছিল। হাতে সিগারেট। অনেকটা উঁচু ফ্ল্যাট বলেই বোধহয় তুমুল হাওয়া দিচ্ছিল। সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছিল এলোমেলো।
“কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা বলেও আর কিছু রইল না। ব্যস্ত হসপিটালে একটা ডাক্তারের উপর নির্যাতন হয়ে গেল কেউ খবর পেল না? নিরাপত্তা শব্দটা কি অভিধান থেকে মুছে যাবে।”
বোধির কথা তিথি আলগা হেসে বলল,“এসব চুপচাপ দেখতে হয়, মুখ খুলতে নেই। কত পরিবারে মেয়েরা অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়, কটা খবর বাইরে আসে? আমার দূরসম্পর্কের এক মামা সুযোগ পেলেই আমার জামার ভিতর হাত ভরে দিত। সে কথা কাউকে বলতে পেরেছি? এসব দেখে পুরুষের প্রতি বিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলেছি।”
“আমাকেও বিশ্বাস করিস না?”
বোধির প্রশ্ন শুনে দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল তিথি। চোখের কোণে জল জমছে। কাঁপা গলায় বলল একমাত্র তোকেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। বলেই নিজেকে সামলে নিল। “চল উঠে পড়ি। ঘুমোতে হবে, সকাল আটটায় মিটিং।”
“ব্রেকফাস্টে কী খাবি? ব্রেড আছে, ওটস, কর্নফ্লেক্স?”
“তুই তো পাক্কা গিন্নীর মতো কথা বলছিস বোধি! ইশ যদি তোর মতো একটু সংসারী হতে পারতাম তাহলে বাবা একটু চিন্তা মুক্ত হত।” দুজনে চোখে চোখ রেখে হাসে, তারপর একটা সাজানো সংসারের আকাঙ্ক্ষা সঙ্গে নিয়ে দুটো ঘরে ঘুমোতে যায়। তিথি ভাবে নিরাপত্তা শব্দটা এখনো মরে যায়নি, একে যে করে হোক বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মেয়েরা একটু আলোর মুখ দেখবে না? তখনো ওদের দুজনের কেউই জানে না যে মেয়েদের অন্ধকারে ডুবিয়ে দেবে বলে সেই সরকারি হাসপাতালের হলঘর থেকে কত প্রমাণ বেবাক লোপাট হয়ে যাচ্ছে…
আরও পড়ুন- মফস্সলের শানু-সন্ধ্যা এবং এক গিটারবাজিয়ের গল্প
এর পরের কয়েকটা দিন তিথি আর বোধিসত্ত্বর মতো সাংবাদিকেরা নাওয়া-খাওয়ার সময় পায়নি। বিভিন্ন চ্যানেলে ভাসছে হাজার খবর। ধর্ষণের অভিযোগে এক সন্দেহজনক ব্যক্তিকে গ্রেফতার হয়েছে। ধর্ষিতা মেয়েটি একটা নাম পেয়েছে, দেবী দূর্গার নাম। প্রত্যেকটা মেয়ের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা দেবী একটু একটু করে জেগে উঠছে। আজ মধ্যরাতে রাস্তায় নেমে তারা প্রতিবাদ জানাবে। রাত দখল করবে। সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড়। নিউজ রুম ছেড়ে তিথিও আজ রাস্তায় নামবে। এই অভিনব প্রতিবাদকে সে সাজিয়ে রাখবে চ্যানেলের স্ক্রিনে। ওদিকে চ্যানেল রুমে পক্ষ-বিপক্ষের বক্তারা বসে আছেন। বোধি একের পর এক প্রশ্ন রাখছে। উত্তেজনার পারদ চরমে। রাস্তায় নেমে তিথি দেখল এত রাতেও শহরটা জেগে আছে। বিচার চেয়ে পথে নেমেছে আট থেকে আশি। তিথির গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। বুকটা ধক ধক করছে। একটা লাইন বার বার মাথায় আসছে, “নাহি জানে কেউ রক্তে তোর নাচে আজি সমুদ্রের ঢেউ…”
স্বাধীনতার মধ্যরাতে বাংলায় লেখা হচ্ছে প্রতিবাদের এক নতুন ইতিহাস। ও বুম হাতে মেয়েদের প্রশ্ন করছে, তারা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে উত্তর দিচ্ছে। গাইছে, আঁকছে, কবিতা পাঠ করছে, বক্তব্য রাখছে… মেয়েদের বুকের ভিতরে এত আগুন জমে আছে? তিথির দিদিও ফোনে আক্ষেপ করে বলেছিল “তোর সঙ্গে ফিরে গেলেই হত, প্রতিবাদটুকুও জানাতে পারলাম না। মোমবাতি কিনেছি, সেটাই না হয় জ্বালাব। কখনো তো মুখ ফুটে ভুলকে ভুল বলতে পারিনি।” শুনে তিথির চোখে জল এসেছিল। এইবার বোধহয় দিন বদল হবেই।
কিন্তু দেবীরা যখন জেগে ওঠে তখন শয়তানেরা ঘুমিয়ে থাকে এমন নয়। সবাই যখন মিছিলে ব্যস্ত একদল হুলিগানস পুলিশের চোখের সামনে হসপিটালটাকে তছনছ করে দিল। ধর্ণায় বসে থাকা ডাক্তাররা অসহায় চোখে দেখল। খবর আসতেই নিউজ ভ্যান নিয়ে সেখানে ছুটল তিথি। কোটি টাকার সম্পত্তি শেষ হয়ে গেছে। দামী ওষুধ ইঞ্জেকশন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। একদল লোক সেইসব লুটেপুটে নিচ্ছে। সবাই হতবাক। হসপিটাল স্টাফরা ভয়ে জড়সড়। তিথি একে একে সব কভার করছিল। সব প্রমাণ লোপাটের ছল? ওর আবার শরীর খারাপ করছে, হাত কাঁপছে। সব শেষে তিথি গিয়ে পৌঁছেছে সেই হলঘরে। ওই দূরে মেয়েটা ওখানেই শুয়ে ছিল। অন্যদিনের মতো সেদিনও পাড়াশোনা করছিল। দুচোখে সফল হবার স্বপ্ন। তিথি সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ওর মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে। চোখের সামনে গোটা হাসপাতালটাকে বাহান্নতম সতীপীঠ হয়ে যেতে দেখছে। ঘন্টা বাজছে, ধূপের বদলে বাতাসে লোভের গন্ধ ভাসছে। এইখানেই বোধহয় সতীর ‘মন’ পড়েছে, বাহান্নতম অঙ্গ। তিথি দুটো হাত তুলে কপালে ছোঁয়ালো। যারা ঘরে আসছে যাচ্ছে তারা কি ভক্ত? পুজো দিতে এসেছে? নাকি পান্ডা? দালাল? তিথির মতো যারা তারা সবাই সতীপীঠের ব্যবসায়ী, মালা আর মিষ্টি বেচে চ্যানেল ভরছে। আর গায়ে অধর্ম চাপিয়ে ইউনিফর্ম পরে যারা ঘুরছে তারা বোধহয় ভেকধারী সন্ন্যাসী? কে যেন তিথির কানে কানে বলল দেবীর রক্তে ভেজা চাদর আছে। মাদুলী করে পরিস। কোনো বিপদ ছুঁতে পারবে না। পাঁচশো এক টাকা দে…
তিথি টলতে টলতে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল। উদ্বিগ্ন সহকর্মীরা পিছনে পিছনে আসছে। বোধিসত্ত্বকে ফোন করছে। ওকে বসিয়ে চোখে মুখে জল ছেটানো হচ্ছে। তিথি ঝাপসা চোখে মূর্তিটা খুঁজে চলেছে। এত কিছু ঘটে গেল অথচ রাজা এখনো পাথর হল না? আজ হয়নি, আগামীতে হবেই। তিথি অভিশাপের সেই বৃত্তটা সম্পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষায় থাকবে…

Whatsapp
