নিজের বইয়ের 'অন্ত্যেষ্টি সৎকার' করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ
Rabindranath Tagore: আর কত কাল রবীন্দ্রনাথ কেবল ওই বঙ্গদর্শন-সাধনা-ভারতী-বালক-সপ্তাহ-হিতবাদীর সম্পাদক হয়ে থাকবেন?
"রবীন্দ্রনাথ কখনও ভালো সম্পাদক হতে পারতেন না। ভালো লেখকেরা কখনও ভালো সম্পাদক হন না।" শান্তিনিকেতনে এক আড্ডায় মূলত ইংরেজি ভাষার এক বিখ্যাত সম্পাদকের এই মত শুনে প্রথমটা একটু খটকা লেগেছিল।
বাংলায় সম্পাদক বলতে পত্রিকা-সম্পাদক এবং গ্রন্থ-সম্পাদক দুই-ই বোঝায়। ওই বিখ্যাত ইংরেজি সম্পাদক বইয়েরই সম্পাদক। আর তাঁর মতটাও, অনুমান করি, গ্রন্থ-সম্পাদক সম্পর্কেই। কথাটা এক অর্থে ঠিক। আর সে কথাটাকে একটু তলিয়ে দেখতে গেলে যে সম্পাদক আমাদের মন জুড়ে বসবেন তিনি রবীন্দ্রনাথের বইয়ের সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ।
আর সেই সম্পাদক, বাঙালি লেখকের স্ব-ভাব-গড্ডলিকা থেকে বেরিয়ে এক অ-পূর্ব একা। যে একা অনেক সময়ই নিজের পুরনো বইয়ের প্রতি মমতাহীন। সে নির্মমতা এতটাই যে, নিজেরই লেখা য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র বইটির এমনকী 'অন্ত্যেষ্টি সৎকার'-ও চেয়েছেন তিনি। ১৯২১-এ যখন রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রকাশের পরিকল্পনা চলছে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের দায়িত্বে, তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখছেন, "য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র কি রক্ষণীয়? ওর কি অন্ত্যেষ্টি সৎকার হয় নি?"
এতটা ধিক্কার কেন? সেটা বোঝা যাবে য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র একটু পড়লে, রচনাবলী থেকে নয়, আলাদা বইটি পড়লে, "ইটালির মেয়েদের বড়ো সুন্দর দেখতে। অনেকটা আমাদের দেশের মেয়ের ভাব আছে। সুন্দর রঙ, কালো কালো চুল, কালো ভুরু, কালো চোখ, আর মুখের গড়ন অতি চমৎকার। আমরা রাস্তায় ঘাটে কেবল ছোটোলোকদের মেয়েদের দেখেছি মাত্র, কিন্তু তাদেরই এমন ভালো দেখতে যে কী বলব!"
"এ দেশের ছোটোলোকদের দেখলে মনে হয় না তাদের কিছুমাত্র মনুষ্যত্ব আছে—তারা যেন পশু থেকে এক ধাপ উঁচু। তাদের মুখ দেখলে—নিদেন তাদের মধ্যে এক-এক জনের মুখ দেখলে আমার কেমন গা শিউরে ওঠে৷ তাদের মুখ দেখে আর কেউ ‘human face divine’ বলতে পারে না, পশুত্বভাবব্যঞ্জক তাদের সেই লাল-লাল মুখ দেখলে কেমন ঘৃণা হয়। আর, তারা যে ময়লা তা আর কী বলব। এই সে দিন একটা পুলিসের মোকদ্দমা দেখেছিলেম—একটা ছোটোলোকের ছেলে মজা দেখবার জন্যে একটা ঘোড়ার জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিল! এমন পশুত্ব কখনো শুনেছ?"
পরিণত বয়সে, তাঁর নিজেরই লেখা এই কথাগুলো আর তার পিছনের মনটাকে ঘৃণা করবেন রবীন্দ্রনাথ। কিশোরীমোহন সাঁতরাকে চিঠিতে লিখবেন,
"য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র তোমরা ছাপতে চেয়েছ আমি তাতে সম্মতি দিয়েছি। কিন্তু ওর মধ্যে ভূরি ভূরি যে সকল অকথ্য কুকথ্য অসত্য আছে যার জন্যে জীবনান্তকাল পর্যন্ত আমার লজ্জার কারণ থাকবে—সে সব না ছাঁটলে আমার আত্মাবমাননার অবধি থাকবে না।"
আরও পড়ুন-দেশের নামে উগ্রতার দ্বন্দ্ব দিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজেও
রচনাবলী বা পাশ্চাত্য ভ্রমণ বই থেকে ওই চিঠিগুলো একেবারে বাদ দেবেন বা সম্পাদনা করে নেবেন। কিন্তু ১৮৮১-তে প্রথম যখন য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র প্রকাশিত হচ্ছে তখনও ভূমিকায় সতর্ক করে দিতে চাইবেন, "বন্ধুদের দ্বারা অনুরুদ্ধ হইয়া এই পত্রগুলি প্রকাশ করিলাম। প্রকাশ করিতে আপত্তি ছিল—কারণ, কয়েকটি ছাড়া বাকি পত্রগুলি ভারতীর উদ্দেশে লিখিত হয় নাই, সুতরাং সে সমুদয়ে যথেষ্ট সাবধানের সহিত মত প্রকাশ করা যায় নাই; বিদেশীয় সমাজ প্রথম দেখিয়াই যাহা মনে হইয়াছে তাহাই ব্যক্ত করা গিয়াছে।"
নিজেকেই নিজে বারবার সম্পাদিত করে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। রক্তকরবীর খসড়াগুলি, তাঁর অজস্র কবিতার পাঠান্তর, এক বইয়ের নানা রূপ, পত্রিকাপাঠ আর গ্রন্থপাঠের বিভিন্নতা—সবে মিলে সেই আত্ম-সংস্কার এতটাই যে সে-সব নিয়েই দিব্য একটা ভেরিয়োরাম ডিসকোর্স তৈরি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আবার যখন বাংলা কাব্যপরিচয় সম্পাদনা করছেন তিনি তখন তার প্রস্তুতিপর্বে তাঁর ব্যক্তিগত ভালো লাগা তো কাজ করছেই, সেই সঙ্গে কাজ করছে অন্য কিছু বিবেচনাও, যা সম্পাদকের নিরপেক্ষতার একেবারে উল্টো দিকে। কিশোরীমোহন সাঁতরাকেই লিখছেন,
"সুরেশ চক্রবর্তী এবং হেমেন্দ্রকুমার রায়ের নাম ভুলেছিলেম। হেমেন্দ্রকুমারের কিছু পেলে খুসি হই কেন না আমার প্রতি সে শ্রদ্ধাবান। নরেন্দ্র দেবের কি কিছু দেবার মতো আছে? থাকে যদি তো দেওয়া ভালো। গিরিজা বসু কি বাদ পড়েছে? “লজ্জাবতী লতা” লজ্জাকর। নির্ভীক চিত্তে ত্যাগ করাই শ্রেয়—সেই সঙ্গে নবীন সেন। যদি বৃত্রাসুর এবং নবীন সেনের কোনো বড়ো কাব্যের কোনো অংশ চলনসই হয় তবে পরিশিষ্টে দিতে পারো। কবিকঙ্কনের বারোমাস্যাও সেই সঙ্গে। মৈমনসিংহ গীতিকারও তো টুকরো তোলা হয়েছে। আদিরস বাঁচাতে হলে সমগ্র তোলা যায় কি?"
"কাব্যসঙ্কলনের কাজ কতদূর এগোলো? একজন নবীন কবির নাম মনে পড়েচে, সুরেশ বাড়ুজ্জে, ঘোরতর আদিরসিক। কিন্তু কিছুকাল হোলো কাগজে তার অন্যরসের কবিতাও পড়েছি। যদি পছন্দসই জিনিষ হাতে পড়ে তবে চালিয়ে দিয়ো।"
এও আর এক সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ, নিজের ব্যক্তি 'আমি' যাঁকে ছেয়ে দিচ্ছে মাঝে মাঝেই। তাঁকে ঘিরে সকলই বিমল, সকলই শোভনের যে উৎসব বাঙালির বচ্ছরকার পঁচিশে বৈশাখে তার মাঝেও এবার এই ধাঁধার মতো জটিল স্ব-সম্পাদককে নিয়েও চর্চা হোক। আর কত কাল তিনি কেবল ওই বঙ্গদর্শন-সাধনা-ভারতী-বালক-সপ্তাহ-হিতবাদীর সম্পাদক হয়ে থাকবেন?