প্রথম মোবাইলে কথা বলেন জ্যোতি বসু! স্বপ্ন ছিল, কলকাতা হবে 'নেটওয়ার্ক সিটি'
Jyoti Basu: সেই সময় আউটগোয়িং এবং ইনকামিং উভয়ের জন্য প্রাথমিক রেট ছিল ৮.৪ টাকা প্রতি মিনিট।
এখন সব শ্রেণির মানুষের হাতেই মোবাইল। মোবাইল ফোন ছাড়া আমরা অচল। অথচ কয়েক দশক আগেও মানুষের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল ল্যান্ডলাইন। তাও প্রত্যেকের বাড়িতে নয়, এলাকার বেশ বিত্তশালী পরিবারেই থাকত নিজস্ব ল্যান্ডলাইন। আর সাধারণ মানুষের ভরসা ছিল এসটিডি বুথ। আমাদের জীবনযাত্রার খোলনলচে বদলে দিল মোবাইল পরিষেবা।
১৯৯৫ সালের ৩১ জুলাই দিনটা ভারতের ইতিহাসে গুরত্বপূর্ণ। ওই দিন ভারতের মোবাইল সংযোগের উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। ফোনের ওপারে ছিলেন ভারতের টেলিকম মন্ত্রী সুখরাম। মোবাইল পরিষেবার জোগান দিয়েছিল 'মোদি টেলস্ট্রা' নামক সংস্থা। নোকিয়া মোবাইলে কথা হয়েছিল দু'জনের। কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং মুহূর্তের মধ্যে জুড়ে গিয়েছিল দিল্লির সঞ্চার ভবনের সঙ্গে। কিছুক্ষণের জন্য সৌজন্যমূলক কথাবার্তা চলে দুই নেতার মধ্যে।
চারদিকে আলোড়ন পড়ে যায় নতুন এই পরিষেবা নিয়ে। যদিও তোড়জোড় শুরু হয়েছিল ১৯৯৪ সাল থেকেই। মজার বিষয় হলো, সেই সময় আউটগোয়িং এবং ইনকামিং উভয়ের জন্য প্রাথমিক রেট ছিল ৮.৪ টাকা প্রতি মিনিট। সর্বোচ্চ মোবাইল ফোন ট্রাফিক আওয়ারে এই খরচ ১৬.৮ টাকায় পৌঁছত। আজ সেই মূল্য জলের দরে এসে ঠেকেছে। নোকিয়া মোবাইলগুলির প্রত্যেকটির দাম তখন পড়েছিল ৪০ হাজার টাকা। ২৭ বছর পরে মুদ্রাস্ফীতি যোগ করলে আজ সেই মূল্য প্রায় দুই লাখেরও বেশি। তবে নোকিয়ার কোন মোবাইল ফোন ব্যবহার করা হয়েছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। সেই সময় মোট আটটি সংস্থাকে বরাত দেওয়া হয়েছিল সেলফোন যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য। জ্যোতি বসুরও স্বপ্ন ছিল, কলকাতাকে মোবাইল নেটওয়ার্ক সিটি হিসেবে গড়ে তোলার।
আরও পড়ুন: অসুখী সময়ে তাঁকেই মনে পড়ে, কেন আজও ব্যতিক্রম মানে জ্যোতি বসু
প্রাক্তন টেলিকম মন্ত্রী সুখরাম তাঁর ৯৩তম জন্মদিনে সে ঐতিহাসিক মুহূর্তের কথা স্মরণ করে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন যে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে জাপান সফরের সময় তিনি তাঁর গাড়ির চালকের পকেটে মোবাইল ফোন প্রথম লক্ষ্য করেন। সুখরাম সেই সময় থেকেই ভাবতে থাকেন, জাপানে যদি এই প্রযুক্তি থাকতে পারে তবে ভারতে কেন নয়? তবে তার মতে ভারতে মোবাইল পরিষেবা চালুর কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর। প্রধানমন্ত্রী নিজেও চাইতেন, মোবাইল এবং ইন্টারনেট পরিষেবা ভারতীয়দের জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠুক। সুখরাম নিজেও রিলায়েন্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ধীরুভাই আম্বানির সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করেন এই সম্পর্কে। ধীরুভাইয়ের মতে, মোবাইল টেলিফোন ইন্ডাস্ট্রি ভবিষ্যতে লাভজনক ব্যবসাগুলির অন্যতম হয়ে উঠবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আম্বানিদের রিলায়েন্স জিও বর্তমানে ভারতের বৃহত্তম মোবাইল টেলিকম অপারেটর। পাশাপাশি তাদের ইন্টারনেট পরিষেবাও দেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ।
তবে জন্মদিনের দিন সুখরাম হাসতে হাসতে বলেন, "আমার কোনও ধারণা ছিল না যে, মোবাইল ফোনে ক্যামেরা কীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।" সেসময় ভারতে উদার অর্থনীতি চালু হয়নি, তাই দেশের মোবাইল পরিষেবা চালু করতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল সুখরাম-সহ রাজীব গান্ধী সরকারকে। নয়ের দশকের শেষে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা সুখরাম এক মিটিংয়ে শ্রোতাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, একদিন সবার হাতে হাতে মোবাইল থাকবে। দর্শকদের অনেকের কাছেই সেদিন এই কথা সন্দেহের মনে হলেও আজ যে এটাই সত্যি, তা মানতে অস্বীকার করবেন না কেউই।
ভারতের সব স্তরেই মোবাইল অনুপ্রবেশের ফলাফল সুস্পষ্ট। যা অতিমারী-পরবর্তী দুনিয়ায় শিখরে পৌঁছেছে। পরিসংখ্যা একই কথা বলছে। টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অফ ইন্ডিয়া বা ট্রাই-এর দেওয়া তথ্য বলছে, ২০১৯ ডিসেম্বরে দেশে মোট মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ৪৫ কোটি মানুষ। অতিমারীর পরে সেই সংখ্যা বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। ডেলয়েট কোম্পানির রিপোর্ট বলছে, ২০২৬ সালের মধ্যে ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ ভারতে মোবাইল ব্যবহার করবেন। চিনের পর ভারতেই সবথেকে বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী রয়েছেন পৃথিবীতে। শুধু তাই নয়, ভারতে ইন্টারনেট গ্রাহকদের ৯৬.৮ শতাংশই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যে এভাবে মোবাইল ফোন ভারতের মানুষের জীবনধারাকে বদলে দেবে, তা বোধহয় সুখরামও সেদিন কল্পনা করতে পারেননি।