পাথরের সিংহবাহিনী দেবী সুবীক্ষা! রইল বোলপুর নামের ইতিহাস

History of Birbhum's Subiksha Puja: খন সুপুর ছিল নৌবন্দর। এই গ্রামে বর্গীরা ও তাদের অশ্বারোহী বাহিনী ভয়ানক লুঠ চালায়। ধ্বংসযজ্ঞে মন্দিরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

MT

শরৎকালে দেবী দুর্গার আগমনে সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ও অন্ধকার দূর হয়। সংকটের হাত থেকে তিনি সমস্ত জীবকুলকে রক্ষা করেন। পুজোর মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের নানা লোকজ সংস্কৃতি উপস্থাপিত হয়। দেবী চণ্ডী দুর্গা বা মা ভবানীর একটি রূপ। তিনি মহাশক্তি ও উগ্র রূপে পূজিত। চণ্ডী গ্রাম্য লোকজ সংস্কৃতির দেবী। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখা চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে চণ্ডী-মাহাত্ম্য প্রচার পেয়েছে। নীহাররঞ্জন রায় বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থে শাক্তধর্ম সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছেন অতীতে কলা গাছ ও গোধিকা মূর্তিকে চণ্ডী রূপে পুজো করা হতো।  শিলাখন্ড, মূর্তি, গাছ প্রতীকে বাংলায় বহু রকমের চণ্ডীর আরাধনা হয়। বাঁকুড়া, বীরভূম, হাওড়া ও হুগলিতে এই পুজোর প্রচলন বেশি। বীরভূমের সুপুরে স্থানীয় দেবী সুবীক্ষা স্বয়ং দেবী চণ্ডী। তাকে নিয়ে আজও বহু ইতিহাস চাপা পড়ে আছে।

দেবী চণ্ডী বধ করেন অসুররাজ শুম্ভ নিশুম্ভকে। চণ্ডীর অপর রূপ কৌশিকী। দেবী কৌশিকীর কপাল থেকে চামুণ্ডার আবির্ভাব। আইকোনগ্রাফি অনুসারে কালীর চেয়েও প্রাচীন চামুণ্ডা। তিনি চণ্ড ও মুণ্ড দুই অসুরকে বধ করেন তাই চামুণ্ডা নাম। অধ্যাপক শ্রী সুকুমার সেনের মতে শ্রীশ্রী চণ্ডীতে চণ্ডীকার আবির্ভাবের সময় দেবী শিবা বা শেয়াল বেষ্টিত ছিলেন। তাই তাঁর আরেক নাম শিবদূতী। সুপুরের গ্রাম্য লৌকিক দেবী সুবীক্ষা। গ্রামবাসী ভক্তি বিশ্বাসে দেবীর কাছে চায় অভয় ও আশ্রয়। তিনি বাংলায় খাদ্য ও শস্যের দেবী হিসেবেও পরিচিত। সুপুরে দেবী সুবীক্ষার থানে এসে ভক্তরা প্রার্থনা করেন। ভক্তরা আস্থা ও বিশ্বাসে মন্দিরের পাশে গাছের নিচে শঙ্খ রেখে যান। বহু প্রাচীন এই দেবী আজও পূজিত হয়ে আসছে।

জোড়া শিব মন্দির, সুপুর

সুপুরে সুবীক্ষার থান গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে। প্রাচীন দেবী মন্দির ঘিরে উঠেছে এক বিশাল গাছ। মন্দিরের গায়েই শিকড় স্থাপন করেছে। গাছপালাপূর্ণ শান্ত পরিবেশ। মাঝে মাঝে দিনের বেলাতেও বেশ অলৌকিক কিছুর উপস্থিতি অনুভূতি হয়। চারদিকে পরিখা বা গড়ের মত প্রশস্ত পুকুর। দেবীর থানটি উঁচু টিলার ওপর। আশেপাশে মাটি খুঁড়লে প্রাচীন ইঁটের টুকরো ও স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। বেশ কিছু টেরাকোটার শিব মন্দির গ্রামে রয়েছে। সুবীক্ষা মূর্তি মহিষমর্দিনী। অনেকের ধারণা দেবী মূর্তির সঙ্গে বৌদ্ধসংস্কৃতির ছাপ রয়েছে। কাছেই সুরথেশ্বর শিব মন্দিরে মূর্তির অংশবিশেষ রাখা থাকে। দেবীর ভাঙা বিগ্রহের সঙ্গে জড়িত আশ্চর্য কাহিনী। সুপুরের ঐ থানে পুজোর সময় সুরথেশ্বর মন্দির থেকে মূর্তিটিকে নিয়ে আসা হয়। এরপর চলে দেবীর উদ্দেশ্যে বিশেষ পুজোপাঠ।

আরও পড়ুন- জঙ্গলেই প্রথম পুজো করেন রাজা সুরথ! কেমন ছিল প্রথম দুর্গাপুজো?

দেবীতীর্থ সুপুরে সুবীক্ষার প্রাচীন মূর্তিটি বর্গী আক্রমণ হলে ভাঙা পড়ে। এই সংঘাতের জন্যে দেবীর সম্পূর্ণ চেহারা আর পাওয়া যায় না। 'বর্গী এলো দেশে', আজও সুপুরের বহু নিদর্শন বাইরের শত্রুদের নিয়ে নানা ঘটনার সাক্ষ্য বহন করছে। তখন সুপুর ছিল নৌবন্দর। এই গ্রামে বর্গীরা ও তাদের অশ্বারোহী বাহিনী ভয়ানক লুঠ চালায়। ধ্বংসযজ্ঞে মন্দিরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাচীনকালে সুপুরের নাম ছিল স্বপুর। জনশ্রুতি যে, রাজা সুরথের রাজ্য ছিল এই সুপুর। তিনি সুবীক্ষার পুজো করতেন। গবেষক বিনয় ঘোষের মতে, রাজা দেবীকে সন্তুষ্ট করতে পুজোয় লক্ষ পাঁঠাবলি দেন। এই জন্যেই প্রথমে নাম হয় বলিপুর ও তারপর সেখান থেকে বোলপুর। এমন কাহিনী গ্রামে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত।

রহস্যে ঘেরা দেবীর থানে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে গাছ

বিশেষ রীতি মেনে পুজোর সময় মাতৃ আরাধনা শুরু হয়। সকলে মানে, এই পুজো জাগ্রত। দূর থেকে দূরে ঢাকের আওয়াজ ইঙ্গিত দেয় মাতৃকা শক্তির উপস্থিতি। গ্রামে মানুষ দেবীর কাছে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য প্রার্থনা করে। বিশ্বাস যে গ্রামের উপর যেকোনো অশুভ শক্তি থেকে তিনি রক্ষা করবেন। পুজোর কদিন গ্রাম দেবীকে নিয়ে মানুষ মেতে ওঠেন। পুজোর কটা দিন অনেকেই গ্রামে ফিরে আসেন মায়ের টানে। পুজো ঘিরে একসূত্রে গাঁথে গোটা গ্রাম।

More Articles