দ্রৌপদী উৎসব! অর্জুন পত্নী যেভাবে দেবী হয়ে উঠলেন দক্ষিণে

Draupadi as a goddess in South India: ব্যাঙ্গালুরুতে আটশো বছরের প্রাচীন ধর্মরায়া স্বামী মন্দিরে 'করগা' উৎসব পালিত হয়। এই উৎসবের সব আচার-অনুষ্ঠান দ্রৌপদীকে কেন্দ্র করে হয়। 'কর' মানে হাত এবং 'গা' মানে যা করা হয়।

রামায়ণের বিপরীতে মহাভারতের খুব কম চরিত্রকেই পুজা করা হয়। মহাভারতের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র দ্রৌপদীকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের প্রচলন বিশেষ জনপ্রিয়। দ্রৌপদীর জন্ম রাজা দ্রুপদের একটি যজ্ঞ থেকে। তাই তিনি ধর্ম, শৌর্য ও শক্তির প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হন। হিন্দু ধর্মে দ্রৌপদীকে পঞ্চকন্যা হিসাবে প্রশংসা করা হয়েছে— নারী সতীত্বের প্রতীক হিসাবে। কিছু সম্প্রদায় তাঁকে সেইভাবেই পূজা করে। দ্রৌপদীর শক্তি, সাহসিকতা ও ভক্তির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। দ্রৌপদী অর্থনীতিতে প্রশিক্ষিত ছিলেন। সাম্রাজ্যের কোষাগারের দায়িত্ব নিতেন। সম্রাজ্ঞী হিসাবে তাঁর কর্তব্যের কথা কৃষ্ণের স্ত্রী সত্যভামার সঙ্গে নির্বাসনকালীন কথোপকথনে উল্লিখিত আছে। তাঁর রাজনৈতিক পরিকল্পনা ছিল দৃঢ়, যার মধ্যে ছিল কৌরবদের প্রতিশোধ নেওয়া।

দক্ষিণ ভারতের অনেক স্থানে দ্রৌপদী দেবীরূপে পুজিত হন। তামিলনাড়ু, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশে দ্রৌপদীর প্রায় আটশোটি মন্দির রয়েছে। বহু স্থানে দ্রৌপদীকে কেন্দ্র করে মহাসমারোহে বার্ষিক উৎসব পালিত হয়। 'দ্রৌপদী আম্মা'র উৎসব এতটাই জনপ্রিয় যে, এই উৎসব মানব ঐক্যের প্রতীকরূপে লক্ষিত হয়। তামিলনাড়ুর 'থিমিথি' উৎসবটি এ ক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তামিলনাড়ুর নাগপট্টিনম জেলার কোন্ডাল গ্রামে 'দ্রৌপদী আম্মা' কুলদেবীরূপে পূজিতা হন। এই উৎসবকে বলা হয় ফায়ার ওয়াকিং ফেস্টিভ্যাল(Fire Walking Festival)। এই উৎসবে ভক্তরা জ্বলন্ত কয়লার উপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটেন দ্রৌপদীর আশীর্বাদলাভের জন্য। মহাকাব্যের নায়িকা কীভাবে কুলদেবী হয়ে উঠেছেন— এই বিষয়টি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার যেসব স্থানে তামিল জনবসতি আছে, সেই সব স্থানেও 'থিমিথি' উৎসব পালিত হয় এবং অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। নারী, পুরুষ এমনকি শিশুরাও এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়।

আরও পড়ুন- দ্রৌপদী থেকে নির্ভয়া, ‘সবক’ শেখাতেই ধর্ষণ আজও

ব্যাঙ্গালুরুতে আটশো বছরের প্রাচীন ধর্মরায়া স্বামী মন্দিরে 'করগা' উৎসব পালিত হয়। এই উৎসবের সব আচার-অনুষ্ঠান দ্রৌপদীকে কেন্দ্র করে হয়। 'কর' মানে হাত এবং 'গা' মানে যা করা হয়। 'করগা' একটি জলপূর্ণ পাত্রকে নির্দেশ করে। এই জলপূর্ণ পাত্র অর্থাৎ 'করগা' বহনকারীকে এই উৎসবে দ্রৌপদীর অবতার বলে ধরা হয়। প্রথা অনুযায়ী কর্নাটকের থিগলা সম্প্রদায় শক্তিস্বরূপা দ্রৌপদীর প্রতি আচার অনুষ্ঠান ও উৎসব পালন করে আসছে। এই উৎসব বহু প্রাচীন, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ইতিহাস অনুযায়ী, সতেরশো শতাব্দীতে মহীশূরের মহারাজ কিছু পণ্ডিতকে সভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন 'করগা' উৎসবকে আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠানরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে। ওই অঞ্চলে কথিত আছে যে, দ্রৌপদী তিমিরাসুরকে বধ করার জন্য কিছু সৈন্য সৃষ্টি করেছিলেন স্বর্গারোহণের সময়। ওই সৈন্যরা দ্রৌপদীকে পুনর্বার পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের অনুরোধ জানান। দ্রৌপদী প্রতিশ্রুতি দেন যে, প্রতিবছর হিন্দু ক্যালেন্ডারের প্রথম মাসের পূর্ণিমার দিন তিনি তিন দিনের জন্য ফিরে আসবেন ওই অঞ্চলে। উৎসবে বীরকুমারদের মাথায় পাত্র বহন করে নিয়ে যাওয়ার প্রথা প্রচলিত। তাই তিন ফুট উঁচু, সুসজ্জিত, জলপূর্ণ পাত্র 'করগা' বহনকারী রূপে থিগলা সম্প্রদায় থেকে এমন একজন আচার্যকে নির্বাচিত করা হয়, যাঁকে এগারো দিন ধরে তপস্যার নিয়ম মানতে হয় এবং তারপর মহিলাদের পোশাক ও মঙ্গলসূত্র পরতে হয়। এর আগে তাঁকে ছয় মাস নানা বিধি-নিষেধের মধ্যে থাকতে হয়। রীতি অনুসারে, 'করগা' বহনকারী এই পাত্র মাথায় নিয়ে সন্ধ্যা থেকে সারারাত শহরের নির্দিষ্ট পথে হেঁটে যান। কেউ কেউ বলেন নারীশক্তি জাগ্রত করার জন্যই এই উৎসবের সূচনা। যুধিষ্ঠির কৌরবসভায় দ্রৌপদীর অপমানের জন্য দায়ী, তাই যুধিষ্ঠিরের অপমানসূচক এই উৎসব দ্রৌপদীর শক্তিরূপের মাহাত্ম্য প্রকাশ করে। নৃত্যশিল্পীরা শোভাযাত্রার পরে বিভিন্ন অ্যাক্রোবেটিক কীর্তি পরিবেশন করেন, যার সঙ্গে থাকে 'থাভি', 'নাদস্বরম', 'মুনি', 'উদুক্কা', 'পাম্বা'র মতো একাধিক বাদ্যযন্ত্র। কর্ণাটকের সমস্ত গ্রাম-শহরে "করগা" উদযাপন হয়, তবে বেঙ্গালুরুর করগা সবচেয়ে জনপ্রিয়, যা হাজার হাজার পর্যটককে আকর্ষণ করে।

আরও পড়ুন- দ্রৌপদী একা নয়! জানেন, এক নারীর বহুস্বামীর প্রথা কীভাবে এল বিশ্বে?

এছাড়া অন্ধ্রপ্রদেশের চিত্তুর জেলার পুট্টুরে দ্রৌপদীকে পূজা করা হয় শক্তির দেবীরূপে। জুলাই-অগাস্টে আঠারো দিন ধরে দ্রৌপদী-ধর্মরাজালু স্বামী মন্দিরে দ্রৌপদী উৎসব পালিত হয়, যার শেষ তিন দিন 'আলুগু উৎসব' নামে পরিচিত। আলুগু উৎসবের সন্ধ্যাবেলা তামিলনাড়ু-অন্ধ্র সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো থেকে বহু ভক্ত সমাগম ঘটে।

এই উৎসবের প্রেক্ষাপটে গল্পটি হল— স্থানীয় মানুষজন যখন এক অজানা রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তখন গ্রামের বয়স্করা এক সাধকের কথায় পুরনো প্রাচীরের দেওয়ালে দেবী দ্রৌপদীর একটি মূর্তি খুঁজে পান এবং একটি ছোট মন্দির নির্মাণ করে প্রার্থনা শুরু করেন। ধীরে ধীরে গ্রাম থেকে রোগ দূর হয়। এরপর পুট্টুরের কেন্দ্রস্থলে দ্রৌপদীর বড় মন্দির নির্মিত হয়।

আড়াইশো বছরের পুরনো এই উৎসবে ছয় ফুট উঁচু ধারালো রূপোর তরোয়াল মন্দিরের মেঝেতে স্থাপন করা হয়। দ্রৌপদী এই অনুষ্ঠানে তরোয়ালরূপে শক্তির অবতার হিসাবে পুজিত হন। ভক্তরা শুক্রবার এই অনুষ্ঠান পালন করেন। শুক্র থেকে রবিবার পর্যন্ত দ্রৌপদীর দেবীমূর্তি নিয়ে বড় রথে শোভাযাত্রা হয়, যা 'রথোৎসবম' নামে পরিচিত। এইভাবে হিন্দু সংস্কৃতিতে দ্রৌপদীর বিশেষ অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা লক্ষিত হয়।

More Articles