যৌনতা হোক বা পুজো, প্রসাধন অবাক করবে পুরাণ থেকে মুঘল আমলের সুগন্ধির ইতিহাস

History of Perfumes: নূরজাহানের মা, পারসিক আসমাত বেগম জাহাঙ্গীরকে এমন এক আতর বানিয়ে দেন, যা হাতে এক ফোঁটা নিয়ে ঘষলে মনে হতো হাজারটা গোলাপফুল একসঙ্গে ফুটল।

প্রবল গরমে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে তপোবন। শুষ্ক বৃক্ষরাজি থেকে তাপে ক্লিষ্ট পাতা ঝরে পড়ছে। মৃগশিশুরা আশ্রয় নিয়েছে ছায়ায়। কূজন ভুলে স্তব্ধ পাখিরা। তাও মাঝে মাঝে মালিনীর জল মাখা ঠান্ডা হাওয়া কিঞ্চিৎ স্বস্তি দিচ্ছে। কিছুদিন আগে রাক্ষসরা আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিল আশ্রম। মহারাজ দুষ্ম্যন্ত প্রতিহত করেছেন তাদের। যাগযজ্ঞে বিঘ্ন না ঘটায় আশ্রমবাসীরা খুশি, তৃপ্ত। শুধু সুখ নেই শকুন্তলার প্রাণে। তপোবনে মহারাজের আগমন ওলটপালট করে দিয়েছে সব। তাঁকে দেখামাত্র হৃদয় হারিয়েছেন শকুন্তলা। মহারাজেরও সেই দশা। এমনই এক দিনে গরম আর মদনানলে তাপিত শকুন্তলা আশ্রয় নিলেন মালিনীর তটে বেতসলতা কুঞ্জে। দুই সখী অনুসূয়া আর প্রিয়ংবদা তাঁর জন্য তৈরি করে দিল তাপহরক সুগন্ধি। আশ্রমের গাছ থেকে পুষ্প চয়ন করে শকুন্তলার জন্য তৈরি করে দিল ফুলের শয্যা। পদ্মপাতা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল তাঁকে। পদ্মগন্ধে সুরভিত বাতাস ক্লান্তি দূর করল শকুন্তলার সন্ধানে আসা দুষ্ম্যন্তেরও। দুই সখী খসখসের মূল বেটে লেপন করে দিল শকুন্তলার স্তনবৃন্তে। বাহুতে পরিয়ে দিল মৃণালের বালা। মাতা গৌতমী যজ্ঞের সুবাসিত শীতল জল ছিটিয়ে দিলেন তাঁর সারা অঙ্গে। কালিদাস তাঁর ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ গ্রন্থে প্রাকৃতিক সুগন্ধির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবেই। শুধু এই গ্রন্থে নয় ‘মেঘদূত’, ‘কুমারসম্ভব’ এবং ‘রঘুবংশ’ গ্রন্থেও কীভাবে রমণীরা স্নানের পর গায়ে সুগন্ধি দিয়ে ধূপ আর অগুরুর ধোঁয়ায় চুল শুকোতেন তার বর্ণনাও দিয়েছেন কালিদাস। এই ধূপ তৈরি করা হতো মৃগনাভি, কেশর, মধু আর দুধ দিয়ে। এর মনোরম গন্ধে মোহিত হতো বাতাসও।

প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ অথবা আধুনিক যুগ — সুগন্ধির বর্ণনা ছড়িয়ে আছে বেদে, পুরাণে, কাব্যে, সাহিত্যে। পুজো অথবা শৃঙ্গারের উজ্জ্বলতা থেকে মৃত্যুর অন্ধকার, গন্ধের পেলব চাদর আস্তরণের মতো বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রাত্যহিকতায়। সমীক্ষা বলছে, গন্ধ আমাদের বহু বিস্মৃত স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়, মন প্রফুল্ল করে। স্নায়ুর উপর এর প্রভাব অপরিসীম। ফরাসি সাহিত্যিক মারসেল প্রুস্টের নামানুসারে এর নাম প্রুস্ট এফেক্ট। আরও বহু কিছুর পাশাপাশিই গন্ধের এই ক্ষমতা চিকিৎসাবিদ্যায় কাজে লাগে। পাশ্চাত্যের এই ধারণার মতোই আমাদের দেশে রোগ সারাতে আয়ুর্বেদে ব্যবহার করা হয় সুগন্ধ। চরক সংহিতা, শুশ্রুত সংহিতায় এর বহু উদাহরণ আছে। শুধু তাই নয়, মনে করা হয় সুগন্ধ শুভশক্তির দ্যোতক। ঈশ্বরের সামনে এই কারণেই দেওয়া হয় ধূপ, ফুল।

বৈদিক যুগে মানুষের সুরভি সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিল। ঋকবেদের একটি বহুশ্রুত মন্ত্রে বলা হয়েছে , ‘ওম ত্রয়মবকম যযামাহে সুগন্ধিম পুষ্টিবর্ধনাম\ উরবারুকমিভ বন্ধনন মৃত্যোরমুকসিয় মামৃতাত’। ত্রয়মবকম অর্থে রুদ্র যার অন্য রূপ আগুন, সুগন্ধ যার মুখে, যিনি সুবাসিত যজ্ঞধোঁয়ার জন্ম দেন। এই দেবতা পার্থিব সুখশান্তি দেন, তিনি নিয়ে যান অমরত্বের পথে। ঋকবেদে দেবী লক্ষ্মীকেও বলা হয়ছে পদ্মগন্ধা। একইভাবে ঋষি বশিষ্ঠ মেয়েদের বলেছেন পূণ্যগন্ধা। বেদ এবং সংহিতাগুলিতে বারবার এসেছে সুবাসিত কাজলের কথা। শুধু মেয়ে নয় পুরুষদেরও গায়ে দুগ্ধগন্ধি মাখন মেখে, চোখে কাজল দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে গন্ধ যৌন আকর্ষণ বৃদ্ধি করে। সুতরাং পুরুষ এবং নারী উভয়েরই সুগন্ধযুক্ত দ্রব্য ব্যবহার করা উচিত। দেবভোগ্য সুগন্ধির কথাও বলা হয়েছে এ’খানে। একবার যখন অগ্নি দেবতাদের পরিমণ্ডলে প্রবেশ করছেন তখন তিনি গা ঝাড়া দেন। তাঁর মাংস থেকে তৈরি হয় গুগ্গুল, তাঁর পেশি পরিণত হয় সুগন্ধি ঘাসে আর তাঁর হাড় থেকে তৈরি হয় পাইন গাছের কাঠ। কৌশিকী উপনিষদে বলা হয়েছে যারা ব্রহ্মলোকের অধিকারী, অপ্সরারা তাদের স্বাগত করবেন ফুলের মালা, নতুন বস্ত্র অলঙ্কার এবং সুগন্ধি চূর্ণ দিয়ে।

আরও পড়ুন- মার্কো পোলো থেকে মুঘল পছন্দ সবারই! জানেন, কে প্রথম তৈরি করেছিল আইসক্রিম?

রামায়ণে বলা হয়েছে অযোধ্যার রাজপ্রাসাদ ম-ম করত অগুরু, ফুল আর চন্দনের সুবাসে। রাজাদের স্নানাগারে বড় বড় পাত্র ভরা থাকত ফুল আর সুগন্ধি তেল। এখানকার বাসিন্দারা বিভিন্ন সুগন্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করত অনুলেপন এবং অঙ্গরাগ। রাম এবং রাবণ দু'জনেই শরীরে লাল চন্দনবাটা দিতেন। স্নানের পর সীতার শরীর চন্দনচর্চিত করার জন্য বিশেষ দাসী ছিল। বক্ষ বিভাজিকায় সুগন্ধি ফুল পিষে দিত দাসীরা। অলক্ত রাগে পা রাঙিয়ে দিয়ে অঙ্গে অন্যান্য অলঙ্কারের সঙ্গে সঙ্গে ফুলমালা পরিয়ে দেওয়া হতো। ভরত যখন অরণ্যে রামের সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন তাঁর পথ চন্দনের জলে ধৌত করে দেওয়া হয়েছিল। রাবণ যখন কোনও রাতে অশোকবনে সীতা সন্দর্শনে আসতেন তাঁর পথে সুবাসিত দীপ জ্বেলে দেওয়া হতো। দশরথ মারা যাওয়ার পর তাঁর মৃতদেহ রেখে দেওয়া হয়েছিল তৈলদ্রোণীতে। ডিম্বাকৃতি এই পাত্রের মধ্যে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি সুরভিত তেল। এই তেল এমনভাবে তৈরি করা হতো যাতে মৃত্যুর পরও রাজাদের ত্বক হরিদ্রাভ লাগে। যেন তিনি ঘুমিয়ে আছেন, মৃত্যু তাঁকে স্পর্শ করেনি।

মহাভারতের দ্রোণপর্বে যুধিষ্ঠিরের স্নানের বর্ণনায় বলা হয়েছে, তিনি সুগন্ধি জলে রক্তচন্দন বাটা, সুবাসিত তেল দিয়ে স্নান করেন। খাণ্ডব প্রস্থে কৃষ্ণ যে পথ দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন সেই পথ নানা ফুল আর অগুরু দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, মূল্যবান উপহারের সঙ্গে সুগন্ধি দেওয়ার চলও ছিল এইসময়। রাজসূয় যজ্ঞের সময় আরবের প্রতিনিধিরা অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যের সঙ্গে অগুরু উপহার দেন।

বাণভট্ট তাঁর ‘কাদম্বরী’ গ্রন্থেও সুগন্ধি মিশ্রিত জলের কথা বলেছেন। রাজ অন্তঃপুরের একটা দিঘি ভরা থাকত পদ্মে, তাতে মিশ্রিত থাকত গন্ধোদক। রাজা শুদ্রক গন্ধোদক মিশ্রিত জলে নিয়মিত স্নান করতেন। রাজপ্রাসাদের সোনার স্তম্ভ ধৌত করা হতো গন্ধোদক এবং কস্তুরী মিশ্রিত জল দিয়ে। ‘মৃচ্ছকটিক’ গ্রন্থের সুন্দরী বারবণিতা বসন্তসেনা যখন স্নান করে উঠতেন তখন তাঁর গায়ের গন্ধে নেশাগ্রস্ত হতো পুরুষকুল।

‘স্বর্ণগন্ধ পদ্ধতি’ গ্রন্থে বলা হয়েছে কেতকী ফুল, কুষ্ট, এলা আর কেশরের পাউডার জলে মেশালে যে গন্ধ উৎপন্ন হবে তাতে আকৃষ্ট হবে মৌমাছিও। চন্দন, লবঙ্গ আর উশিরের জল খেলে মুখ সুগন্ধি তো হবেই ত্বকও হবে উজ্জ্বল। সিগুর, জটামাসি সর্ষের তেলে মিশিয়ে মাখলে পুরুষের গা থেকে চাঁপা ফুলের গন্ধ বের হবে। ‘পাদুকা ভোগ’-এ বলা হয়েছে রাজার জুতোও হবে সুবাসিত। শ্রীপর্ণী, হরিচন্দন, গিরিমালিক দিয়ে তৈরি হবে রাজার পাদুকা। রানির পাদুকা তৈরি হবে চন্দনকাঠ দিয়ে।

কামসূত্র’-তে বাৎসায়ন চৌষট্টি কলার উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, এগুলি সকল সম্ভ্রান্ত নরনারীর জানা উচিত। এর মধ্যে একটি হলো গন্ধশাস্ত্র। এখানে তিনি বিশদে বলেছেন সুগন্ধির কথা। তাঁর মতে প্রকৃত পুরুষ সেই যে সকালে উঠে সুবাসিত ভেষজ দিয়ে দাঁত মেজে, স্নান করে চুলে সুগন্ধি মেখে তাম্বুল মুখে দিয়ে দিন শুরু করেন। এতে দেওয়া থাকে সুগন্ধি এলাচ, লবঙ্গ, চারচিনি আর সুবাসিত সুপারি। শুধু তাই নয়, যিনি রাজদ্বারে, বিজ্ঞ ব্যক্তি সকাশে এবং অবসরে তাম্বুল চর্বণ করেন না, তিনি যথার্থ সভ্য পুরুষ নন। কামসূত্র অনুযায়ী প্রেমে এবং যৌনতায় সৌন্দর্যের গুরুত্ব অপরিসীম। কাজেই পুরুষ নারী নির্বিশেষে শৃঙ্গারে মনোযোগী হতে হবে। নারীর সুরভিত কেশ পুরুষকে আকর্ষণ করে সহজেই। তাই মেয়েরা কর্পূর, কুমকু্‌ম, অগুরু, চিনির মিশ্রণ মাথায় দেবে নিয়মিত। গুঞ্জা ফুল মধুর সঙ্গে মিশিয়ে মাখলে চুল হবে সুগন্ধি আর ভ্রমরকৃষ্ণ। বাৎসায়ন বলেছেন নাগপুষ্প, উশির, চন্দন, অগুরু শরীরে মেখে পুরুষদের প্রিয়া সন্দর্শনে যাওয়া উচিত। কামসূত্রে বলা হয়েছে, সুখী বিবাহিতরা শয়নগৃহ সবসময় সুবাসিত রাখবে। রতিক্রিয়ার আগে যুগলরা একে অপরকে উপহার দেবে ফুলের মালা, সুগন্ধি। সঙ্গমের সময় জ্বালিয়ে দেবে ধূপ, ফুল ছড়িয়ে রাখবে বিছানায়।

বরাহমিহির তাঁর বৃহৎসংহিতায় জায়ফল, কর্পূর আমের রস আর মধু দিয়ে তৈরি বিভিন্ন মুখসুগন্ধির উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে কীভাবে একাধিক সুগন্ধ তৈরি করা যায় তার উপায়ও বলেছেন। লোধ্র, উশির, পাত্র, প্রিয়াঙ্গু বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে ৮৪টি বকুলফুলের গন্ধ বিশিষ্ট সুবাস পাওয়া যায় বলে দাবি করেছেন। শুধু তাই নয় কটুক, হিঙ্গু, গুড় শতপুষ্প মিশিয়ে আরও ৮৪ রকমের সুগন্ধির হদিশ দিয়েছেন তিনি।

গন্ধদ্রব্য এতটাই মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগে এর নিয়মিত ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। ইন্দোনেশিয়ায় সুগন্ধি কাঠ আগর রপ্তানি করা হতো। প্লিনি এবং পেরিপ্লাস বর্ণনা দিয়েছেন, খ্রিস্টিয় প্রথম থেকে তৃতীয় শতকে ভারত এবং রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে সমুদ্র বাণিজ্য যখন ফুলে ফেঁপে উঠেছে সেইসময় আগর, চন্দনকাঠ, কস্তুরী নিয়মিত রপ্তানি করত ভারত।

১১২৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রাজা সোমেশ্বর গন্ধশাস্ত্রকে এক অতি আবশ্যক শিক্ষণীয় বিষয় বলে উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, গন্ধ যে শুধুমাত্র বিলাসিতার উপকরণ তা নয়, সুগন্ধ ঈশ্বরের কাছে আত্মনিবেদনেরও উপায়। সৈয়দ হুসেন মাহমুদের লেখা ‘নাজাতুল কুলুব’ গ্রন্থটিতে কেশর, গোলাপ,জুঁই, আগরের গন্ধ দিয়ে কীভাবে বিভিন্ন সুগন্ধি তৈরি করা যায় তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মালয়ের সুলতানের লেখা ‘নিয়ামৎনামা-হি নাসিরশাহী’ গ্রন্থে বলা হয়ছে, পাতন প্রক্রিয়ায় গোলাপ, অ্যালোকাঠ আর তিলের তেল দিয়ে কীভাবে সুবাস তৈরি করা হয়। এই সময় তিমি মাছের শরীরজাত সুগন্ধি দ্রব্য অ্যাম্বারগ্রিস এবং মৌমোম দিয়ে পারসিক এবং ভারতীয় প্রথার সংমিশ্রণে সুগন্ধি তৈরি হতো।

মুঘলযুগে সুগন্ধির ধরন পাল্টায় খানিকটা। নতুন ধরনের সুবাস তৈরি শুরু হয়। ইত্তর বা আতরের বহুবিধ ব্যবহার শুরু হয়। মুঘল হারেমে যে নারীরা থাকতেন, দিল্লির অস্বাভাবিক গরমে তাঁদের ত্রাহি অবস্থা হতো। ঘামের দুর্গন্ধ যাতে সম্রাটের প্রমোদে বিঘ্ন না ঘটায়, তার জন্য প্রয়োজন হতো সুগন্ধির। আকবরের সভাসদ আবুল ফজল তাঁর ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে বলেছেন, সেই সময় খুশবুখানা নামে আলাদা একটা বিভাগই ছিল যারা সুগন্ধি নিয়ে কাজ করত। আকবরের ছেলে জাহাঙ্গীরের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন গন্ধের আতর তৈরি হতে থাকে। বিখ্যাত জাহাঙ্গীরি আতর বা ‘রুহ-ই-গুলাব’ তৈরি করেন নূরজাহানের মা, পারসিক আসমাত বেগম। জাহাঙ্গীর তাঁর ডায়রিতে লিখেছেন, একদিন আসমাত বেগম গোলাপ জল তৈরির সময় দেখেন ওপরে খানিকটা ফেনার এক স্তর। সেই স্তর একের পর এক সঞ্চয় করে তিনি এই আতর বানান। এর গন্ধ এমনই ছিল যে হাতে এক ফোঁটা নিয়ে ঘষলে মনে হতো হাজারটা গোলাপফুল একসঙ্গে ফুটল। গন্ধে অভিভূত জাহাঙ্গীর নিজের কণ্ঠ থেকে বহুমূল্য মুক্তোর মালা খুলে উপহার দেন তাঁকে।

লখনউয়ের নবাবরা আতরের কদর করতে জানতেন। গাজি উদ্দিন হায়দার শাহ নামে এক নবাব তাঁর শয়নগৃহের পাশে আতরের জল মিশ্রিত ঝর্ণা বানিয়েছিলেন। লখনউয়ের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের ছিল নৃত্যগীতের শখ। নাচের সময় তিনি প্রচণ্ড ঘামতেন বলে কড়া গন্ধের আতর তৈরির নির্দেশ দেন। মূলত তাঁর জন্যই ৪০ রকম ভেষজ মিশিয়ে হেনা আতর তৈরি হয়। বলা হয়, মির্জা গালিব হেনা আতর এতটাই পছন্দ করতেন যে, প্রিয়জনরা তাঁর কাছে এলে এই আতর দিয়ে তিনি তাঁদের স্বাগত জানাতেন।

আরও পড়ুন- নোট দিয়ে সিগারেট, আতর দিয়ে ঘর মোছা, কলকাতার যে ‘বাবুগিরি’ আজও অবাক করে

হায়দরাবাদের নিজামদের বিশেষ পছন্দ ছিল জুঁই ফুল গন্ধের আতর। নিজাম ফজল-উদ-দৌল্লার আবার পছন্দ ছিল গোলাপ ফুলের আতর। কিন্তু হায়দরাবাদে এতই কম পাওয়া যেত এই আতর যে এর ব্যবহারের মাধ্যমে বোঝা যেত কোনও ব্যক্তি কতটা সম্পদশালী। শুধু তাই নয়, ফলকনামা প্রাসাদে বেগমের স্নানাগারে পাইপের মাধ্যমে আসত আতরগন্ধি বাষ্প।

বিজাপুরের সুলতান দ্বিতীয় ইব্রাহিম আদিল শাহের সময় 'বায়াজ-ই-খুশবুই’ এবং ‘ইতর-ই-নৌরজশাহী’ নামে দু'টি গ্রন্থ রচিত হয়। এই বই দু'টিতে বিভিন্ন আতর তৈরির পদ্ধতির কথা বলা আছে। কিছু আতর যেমন সূর্যের আলোতে শুকোতে হয় কিছু আবার অসূর্যস্পর্শ। আতর তৈরির জন্য সঠিক সময়, নির্দিষ্ট তাপমাত্রা এগুলি জরুরি। শুধু তাই নয়, কোন ঋতুতে কোন আতর দিতে হবে নিয়ম আছ তারও। মৃগনাভি বা কস্তুরী, কেশর, লেবুগন্ধী আতর ব্যবহার করতে হবে শীতকালে। চন্দন আর কর্পূরের আতর ব্যবহার করার সময়ে গ্রীষ্মকাল। নিয়ম আছে আতর ব্যবহারেরও। দুই আঙুলের ডগায় আতর নিয়ে সামান্য ঘষে পোশাকের ওপর বুলিয়ে নিতে হবে আঙুল। হালকা এই স্পর্শেই সুরভিত হবে দেহ।

ব্রিটিশ আমলের গোড়ার দিকে ইংরেজ এবং ভারতীয় উভয়ের কাছেই আতরের চাহিদা ছিল তুঙ্গে। ১৮২২ সালে ‘সমাচার দর্পণ’-এ খবর বেরোয়, বিচারপতি এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট দেশে ফেরার আগে তাঁর ছাত্রদের হাতে তুলে দিয়েছেন আতর এবং পান। কলকাতার বাবুরা আবিরে আতর মিশিয়ে দোল খেলতেন বারবণিতাদের সঙ্গে। দিল্লির চাঁদনি চকের গুলাব সিং জোহরিমল, মুম্বইয়ের ভিন্ডি বাজারের আতর গলি বা কলকাতার নাখোদা মসজিদ সংলগ্ন আতরের দোকানগুলির ব্যবসা চলত রমরমিয়ে। কিন্তু এর কিছু পর থেকেই বিদেশ থেকে অ্যালকাহল ‘বেস’ দিয়ে তৈরি সুগন্ধি আসতে থাকে ভারতীয় বাজারে। ফলে দেশিয় আতরের চাহিদা পড়তে থাকে দ্রুত। ৯০-এর দশকে উদার অর্থনীতির ফলে ফের সংকটের মুখোমুখি হয় সুগন্ধি শিল্প। কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯১ নাগাদ কনৌজে ‘ফ্রাগরানস অ্যান্ড ফ্লেভার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’ তৈরি করে। গুপ্ত যুগ থেকেই কনৌজ আতর তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল। এই নগরে এত সুগন্ধি ফুলের সমারোহ ছিল যে হর্ষবর্ধন এর নাম দিয়েছিলেন কুসুমপুর। মুঘল যুগে আতর তৈরিতে খ্যাতির শীর্ষে ওঠে শহরটি। সেই জন্য বহু প্রাচীন এই শিল্পটিকে বাঁচাতে কনৌজ আদর্শ জায়গা ছিল। পুরনো গন্ধ, ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় এখন আবার চাহিদা বেড়েছে আতরের। নতুন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কখনও বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ , কখনও শিশিরগন্ধি আতর তৈরি করছেন নির্মাতারা। এভাবেই হয়তো শান্তিতে, শোকে, উৎসবে ব্যসনে সুরভির এই পেলব স্পর্শ অমলিন থেকে যাবে।

More Articles