কার চোখের চাওয়ার হাওয়ায়

আছে এক অনন্তনক্ষত্রবীথি। সেখানে একটিই কবিতা হাজার বছর ধরে লিখে চলেছেন একজন আদিকবি।

সুফিদর্শনে চোখ মনের আয়না। চোখের সামনে যা আসছে তা দেখে মস্তিষ্ককে জানান দেওয়াই চোখের কাজ, একথা সুফি দার্শনিকরা বিশ্বাস করেননি কখনও। তাদের বিশ্বাস- চোখ একটা দরজা, সেই দরজা খুলে মনের সরোবরে পৌঁছনো যায়। তারা জানেন, চোখের ভাষার জোর মুখের কথার চেয়ে অনেক বেশি। চোখ কথ্য বা লেখ্য ভাষার সমান্তরালে কথা বলে। মুখের কথায় যতদূর যাওয়া যায়, চোখ তার চেয়ে অনেকদূর নিয়ে যাবে। তাই কোনো সুফি সন্তের পদে নয়ন বা আঁখি (হিন্দি/ উর্দুতে নয়না বা আঁখ) শব্দটি এলে, সুফি গাইয়েরা সেই শব্দটিকে অনেকক্ষণ ধরে আদরযত্ন করেন। যখন একা, আলস্যে ভরে থাকি, উস্তাদ ফরিদ আজাদ, উস্তাদ আবু আহমেদের গান শুনি। ওঁরা আমায় নিয়ে যান সুফি আর কাওয়ালির অদীন ভুবনে, যেখানে আকাশ সীমানাবিহীন। পাকিস্তানের এই ভ্রার্তৃদ্বয় আমির খুসরুর বিখ্যাত পদ ছাপ তিলক গেয়েছেন। ঠিক দশ মিনিটের প্লে ব্যাক নয়।  ৫০ মিনিট ধরে গানটির মধ্যে চলাচল করেছেন।

বোধ কবিতায় জীবনানন্দ ব্যবহৃত সেই লাইন- ‘সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়!’ মনে পড়ে এই গাওয়াটা শুনলেই। যারা কাওয়ালি গান তাঁরা একা গাইতে যান না, মূলত দল তৈরি থাকেন। কিন্তু গানটির সঙ্গে তাঁরা এককমাত্রায় একটি সংলাপও গড়ে তোলেন। সেটা গাওয়া শুনলেই বোঝা যায়। এই ছাপতিলক গানটিতে যেমন, 'নয়না' শব্দটিকে নিয়ে আসা হয়, তদগত একক সাধনার ভঙ্গিমায়। মনে হয় যেন দীঘিঅতল চোখে একটু একটু করে সমর্পণ চলছে। একটা সময় এমন আসে যখন যে গাইছে তার চোখ আর যার জন্যে গাইছে তার চোখ যেন এক হয়ে যায়। শ্রোতা নিজেও এই অনুভবে পৌঁছতে পারেন নিবিড় ভাবে শুনলে। সুফিদর্শন এই অভিন্নতার বোধকে ফানা হয়ে যাওয়া বলেছে।

মা-মা-মা-মা-গা-সা-নি-সা-মা-গা-পা-মা-পা-গা-মা-গা- নি-পা-ধা-মা-পা-গা-মা-গা


এই সুরের স্রোতের মধ্য দিয়ে যখন এই গাইয়ে-ভ্রার্তৃদ্বয় নিয়ে যাবেন, আন্তরিক পর্যটনের মধ্যে মনে হবে যেন চোখের চাওয়ায় অবগাহন সমাগত। কেউ শুনলে বুঝবেন এই সুরটি ধরার আগে ঘুরিয়েফিরিয়ে 'নয়না' শব্দটি বলে চোখের ওই গহন ভাবটি তৈরি করে দিয়েছেন ওঁরা। তারপর সেই দীঘিতে দেহতরী ভাসানো। গানটি কিছুতেই পিছু ছাড়ে না, মনে জেগে থাকে ওই নয়ন শব্দটির ব্যবহারিক অভিঘাত। দেখি, এই পদটি গাইতে গাইতেই ওঁরা ছুঁয়ে যান অন্য একটি চেনা পদ-

কাগা সব তন খাইয়ো চুন চুন খাইও মাস
দো নয়না মত খাইয়ো মোহে পিয়া কি মিলন কী আশ

একজন কবি, স্থবির হয়ে বসে আছেন, দীর্ঘসময় অপেক্ষা করছেন। তাঁর শরীরে হয়তো পোকামাকড় বাসা বাঁধছে। এবার তাঁকে কাক-শকুনে ছিঁড়ে খাবে। কবির কোনো অভিযোগ নেই। তিনি এই দেহ নিয়ে বিশেষ আগ্রহী নন। তিনি স্রেফ আর্জি জানাচ্ছেন, হে কাক তুমি আমার যত অস্থি-মেদ সব খেয়ে নাও, খুঁটে খুঁটে মাংস খাও, স্রেফ আমার চোখদুটো উপড়ে নিও না, ওই চোখে তার সঙ্গে মিলনের আশা লেগে আছে এখনও।

এই পঞ্জাবি শ্লোকটি ৯০০ বছরের পুরনো। কাব্যটির জন্মদাতা সুফি কবি বাবা শেখ ফরিদি। তিনি কুতুবুদ্দিন আইবক-এর সমসাময়িক। চেঙ্গিস খান, তৈমুর লঙ-এর মহা-উৎপীড়নে ধ্বস্ত সময়কে কুতুবুদ্দিন কাকী শুশ্রুষায় ভরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরই পথগামী হয়েছিলেন অসংখ্য সুফি কবি। বাবা শেখ ফরিদি তাদেরই একজন। কিন্তু প্রভাবের বা গুরুত্বের বিচারে তিনি সবার চেয়ে আলাদা। তাঁর গানের ব্যপ্তি  বুুুুঝতে সাহায্য করবে এই তথ্য: গুরুগ্রন্থসাহেবে তাঁর ১৩৪টি শ্লোক অন্তর্গত করেন গুরু অর্জুনদেব। এমনকী গুরু নানক-ও আদিগ্রন্থে তার পদ রেখেছিলেন।

আমার প্রশ্ন, এই কাওয়ালি গায়ক ভ্রার্তৃদ্বয় কেন ছাপ তিলক গানটি গাইতে গিয়ে এই গানটিকে আনলেন! আমি জট ছাড়াই একটু একটু করে। আমির খুসরুর গানে আছে, ছাপ তিলক সব ছিনি মো-সে নয়না মিলাকে। অর্থ- আমার যেটুকু যে ছাপ বা ব্যক্তিত্ব ছিল, তিলক বা চিহ্ন ছিল, সেই সর্বস্ব যেন কেউ ছিনিয়ে নিল যেই তোমার চোখে তাকালাম।

এই নয়ন শব্দটি আমির খুসরু বইছেন, একটা পরম্পরা বা সিলসিলার অংশ হিসেবে। তাঁরও আগে বাবা ফরিদি এই চোখটুকুই স্রেফ ভিক্ষে চেয়েছেন, প্রিয়কে দেখবেন বলে। আর খুসরু লিখছেন যেই দেখা হলো, অমনি সর্বস্ব লুঠ হয়ে গেল। সময় একদিকে নিজের মতো এগোচ্ছে, আর গানের কথকতাও আখ্যান তৈরি করছে নিজের ছন্দে। মনে হয় এক মহাসময়ে পরিব্যপ্ত হয়ে এক মহাপ্রেমের শামিয়ানা করছে। এক কবি থেকে অন্য কবি সেই মহাপ্রেমের সামনে নিজস্ব ফুল রেখে যাচ্ছেন। একটিই কবিতা, একেকটি  পঙক্তি একেকজন লিখছেন।

ছাপ তিলক গানটি খুসরু লিখছেন নিজামুদ্দিনকে নিয়ে। এই নিজামুদ্দিন আউলিয়া সরাসরি বাবা ফরিদির শিষ্য। আর খুসরু নিজামুদ্দিনের স্নেহদাস। একটিই শব্দ 'নয়ন', তা বয়ে বেড়াচ্ছে তিনটি প্রজন্ম। তিনজন সুফি আত্মা। এই সিলসিলার কথা প্রত্যক্ষভাবে না বলেও দুটি পদ একসাথে রেখে আদপে ইতিহাসের আর গল্পের দরজাটা খুলে রাখলেন এই কাওয়ালি গায়ক ভাইয়েরা। নিশ্চয়ই তারা জানেন, কেউ না কেউ খুঁজবেই।

আমির খুসরু দিল্লিতে খুব কম বয়সে কবি পরিচিতি পান। মোট ছ'জন সুলতানের সভাকবি ছিলেন তিনি। পয়ত্রিশ বছর বয়সে জালালুদ্দিন খিলজির গ্রন্থাগারের দায়ভার পেয়েছিলেন। বিপুল জ্ঞানচর্চা, বৈভব তাঁর মনের জমকালো অবয়ব গড়েছিল। সেই সমস্ত অহং নাশ হয়ে গেল তিনি যখন অতি দীন ফকির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সংস্পর্শে এলেন। রবীন্দ্রনাথের গানে তাঁর মনটা ব্যখ্যা করা যায়-

গর্ব সব টুটিয়া মূর্ছি পড়ে লুটিয়া,
সকল মম দেহ মন বীণাসম বাজে ॥
তার আক্ষরিক সর্বনাশ হলো।

যে খুসরুর হাতের তালুতে সুলতানরা ভায়োলিনের মতো বাজে, সেই তিনিই নিজামুদ্দিনের দরগায় বারবার ছুটে যেতেন। একবার নিজামুদ্দিন কথা বন্ধ করলেন। প্রিয় ভাইপো জয়নাবের মৃত্যুতে অবসাদ ঘিরে ধরল তাঁকে। প্রিয় শিষ্যরা কেউ কথা বলাতে পারল না। খুসরু তাঁর কাছে যান, পাশে বসে থাকেন। একদিন দরগা থেকে ফেরার পথ ধরেছেন, খুসরু দেখলেন, দূর থেকে হলুদ শাড়ি পরা কয়েকজন নারী নাচতে নাচতে আসছেন। খুসরু তাদের কাছে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেন এত আনন্দ ওদের মনে! কেন নাচছেন! ওঁরা খুসরুকে জানান, বসন্ত এসেছে তাই এই পোশাক পরেছেন, নাচছেন। খুসরু ছুটে গিয়ে নিজামুদ্দিনকে বের করে আনলেন। নিজাম সেই উজ্জ্বল হলুদ পোশাক আর নাচ দেখে হেসে ফেললেন, ভক্তরা আনন্দে আত্মহারা হলো, তখন থেকে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায় বসন্ত উৎসব পালিত হয়।

খুসরু বেশিক্ষণ নিজামুদ্দিনের সঙ্গে  থাকতে পারতেন না। ছিটকে বেরিয়ে আসতেন তাঁর ঘর থেকে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলে নিজামুদ্দিন হেসে বলতেন, সূর্যের আলো যে আয়নায় ধরা, সেই আয়নায় কি কেউ বেশিক্ষণ তাকাতে পারে?

গিয়াসুদ্দিন বলবন খুসরুকে বাংলায় পাঠিয়েছেন রাজসভার কাজে। দিনকয়েক কেটে যাওয়ার পর তাঁর মন খুঁতখুঁত করতে লাগল। তিনি দিল্লি ফিরতে চাইলেন তড়িঘড়ি। ফিরে দেখলেন নিজামুদ্দিন আর নেই, তাঁকে দাফন করা হয়েছে। খুসরু গিয়ে বসলেন তার কবরের কাছে। সেই যে বসলেন, আর উঠলেন না। চোখের জলে ভেসে গেল জগৎসংসার।

খুসরু ওই লোভ চাকচিক্য হিংসার পৃথিবীতে ফিরতে চান না, বিলীন হয়ে যেতে চান নিজামের শরীরে, যে নিজাম তার সর্বস্ব নিয়ে নিয়েছে, সব রাজৈশ্বর্য জলাঞ্জলি গিয়েছে যার পায়ে। দিন যায়, রাত যায়, খুসরুর শরীরে রোদ-জল-ঝড়ের ঝাপটা লাগে। খুসরু ওই কবরের সামনে থেকে নড়েন না। গায়ে পোকামাকড় ওঠে, কাক-শকুন এসে বসে। খুসরু নড়েন না। বাবা ফরিদির কাব্য খুসরুর জীবনেই রূপায়িত হয়। খুসরু যেন বলেন,

কাগা সব তন খাইয়ো চুন চুন খাইও মাস
দো নয়না মত খাইয়ো মোহে পিয়া কি মিলন কী আশ

পুরোপুরি ধ্বংস হতে ছ’মাস সময় নেয় শরীর, নিজামের কবরেই শরীরটা নুইয়ে পড়ে। খুসরুর মন যেন যাওয়ার আগে বলে যায়, তুমি ছিলে তাই ছিলাম। যেখানে তুমি নেই সেখানে আমিও থাকব না। তুমি যেখানে যেভাবে আছো, আমিও সেখানে পৌঁছব, প্রিয়র সঙ্গে মিলন হবে জনমে-মরণে। নিজামের পাশেই দাফন করা হয় তাঁকে।

চোখের তারায় অপেক্ষা, সংলাপ, মৃত্যু — এই সুফি দর্শন কি ফুরিয়ে গেল মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই! ব্রজভাষার কবি খুসরুর পথ খুঁজতে খুৃঁজতে আমি এসে দাঁড়িয়েছি ব্রজবুলির শেষ সম্রাটের সামনে। নিজের মাতৃভাষায় তিনি লিখছেন-

প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস–

তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।।

এ সংসারের নিত্য খেলায় প্রতিদিনের প্রাণের মেলায়

বাটে ঘাটে হাজার লোকের হাস্য-পরিহাস–

মাঝখানে তার তোমার চোখে আমার সর্বনাশ।।

কবিতাটি পড়ছি, চোখে ভাসছে খুসরুর জীবন। মনের শান্ত দীঘিতে দোলা দিচ্ছে একের পর এক গান। অনিবার্য ভাবেই মনে পড়ছে-

কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুমচয়নে।

    সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দুখানি নয়নে॥

একজন কবি কাককে বলছেন, শরীর ছিঁড়ে খেয়ে নাও, চোখ দু'খানি রাখো, তা দিয়েই প্রিয়কে দেখব। একজন কবি সেই প্রিয়কে বলছেন, তোমার চোখ আমার সর্বস্ব ছিনিয়ে নিল। আর একজন কবি বলছেন, তোমার চোখেই আমার সর্ব- নাশ। আমার সব পথের শেষ। মাঝে শুয়ে আছে এক হাজার বছর।

মনে হয় বাবা শেখ ফরিদি, আমির খুসরু, রবীন্দ্রনাথ এরা কেউই আসলে নেই। আছে এক অনন্তনক্ষত্রবীথি। সেখানে একটিই কবিতা হাজার বছর ধরে লিখে চলেছেন একজন আদিকবি।

More Articles