বাংলাদেশে আশ্রয়শিবিরে যে জীবন বাঁচেন রোহিঙ্গা রিফিউজিরা

Rohingya refugees : ইউনিসেফ-এর সহায়তায় কিছুটা পড়াশোনার সুযোগ থাকলেও এখন তহবিলের অভাবে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য একের পর এক শিক্ষাকেন্দ্রগুলি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রবেশের ৮ বছর পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশের ওয়াকিবহাল মহলের অনেকেই এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে প্রবেশ করতে দেওয়া ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন। তবে কোনো দেশের নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফলে সৃষ্ট শরণার্থী বা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বলাই বাহুল্য, রোহিঙ্গা সমস্যাটি সমসাময়িক অন্যান্য শরণার্থী সমস্যা থেকে ভিন্ন। আর এই বিষয়ে যে ভারত, চিন ও রাশিয়া নীরব ভূমিকা পালন করেছে তা নতুন করে বলতে হয় না।

বাংলাদেশ প্রথম থেকেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জায়গা দিয়েছে। মায়ানমারের রাখাইনে সামরিক অভিযান শুরুর পর ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা দেশটিতে ঢুকতে শুরু করে। এখন সেই সংখ্যা লক্ষ লক্ষ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ টি আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৪ লক্ষের বেশি। এর মধ্যে ১ লক্ষ ২৪ হাজার এসেছেন গত ১৮ মাসে। যদিও সম্প্রতি ১১টি দেশ যৌথ বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ উঠেছেই। যেমন, তারা সব সময়ই চেষ্টা করছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ক্যাম্পের মধ্যেই আবদ্ধ রাখতে। এখন রোহিঙ্গারাও ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছে ক্যাম্পে তাঁদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, এই সমস্যার সমাধান চাইছেন তাঁরা।

বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে রোহিঙ্গাদের 'শরণার্থী'র স্বীকৃতি দেয়নি কখনই। এতে অনেক অধিকার থেকেই বঞ্চিত থাকতে হয় তাঁদের। যদিও বাংলাদেশ সরকার তাঁদের মৌলিক চাহিদা পূরণে জোর দিচ্ছে, কিন্তু তবুও কিছু সমস্যা থেকেই গেছে। মর্যাদাপূর্ণ এবং নিরাপদ জীবন তো নেই, সামান্য প্রয়োজন মেটাতেও হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা। শুধু তাই নয়, স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগও নেই তাঁদের, ফলে কোনো চাহিদাই পূরণ করা হয় না।

আরও পড়ুন- রোহিঙ্গা শিশুর কান্নাও ‘অবৈধ’?

শিশুরা বড় হচ্ছে নানা রকম সংকটের মধ্যে দিয়ে। প্রতিবছর রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে প্রায় ৩০ হাজার শিশুর জন্ম হয়। তাঁরা প্রত্যেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই বড় হচ্ছে। ইউনিসেফ-এর সহায়তায় কিছুটা পড়াশোনার সুযোগ থাকলেও এখন তহবিলের অভাবে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য একের পর এক শিক্ষাকেন্দ্রগুলি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে ইউনিসেফ বলেছে, অর্থের সংস্থান হলে দ্রুত শিক্ষাকেন্দ্রগুলি আবারও চালু করা হবে। তবে আদৌ তা হবে কিনা সেই নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অন্যদিকে আবার কিছু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। ধীরে ধীরে ওই সন্ত্রাসী দলগুলি রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই সক্রিয় হচ্ছে। এর ফলে সাধারণ রোহিঙ্গাদেরও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ক্রমেই হত্যা, চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসা, জঙ্গি কার্যকলাপ বেড়ে চলেছে। এর অন্যতম কারণ ত্রাণের পরিমাণ কমে আসা। প্রতিবছর ন্যূনতম ৬০০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। কিন্তু ত্রাণের পরিমাণ অনেকটাই কমেছে, আট বছরে ত্রাণ সহায়তা প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।

আল জাজিরার-র কক্সবাজারের প্রতিনিধি টনি চেং বাংলাদেশের একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ২০২৫ সাল থেকে রেশন কমিয়ে ১২ থেকে ৮ ডলার করা হয়। এখন তা ৬ ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা সহায়তা বাড়িয়েছে ঠিকই, তবে এই অর্থ সহায়তা কেবল সেপ্টেম্বর পর্যন্তই দেওয়া হবে।

উল্লেখ্য, বহু চেষ্টা করেও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফেরানো যায়নি। দু-বার প্রত্যাবর্তনের কথা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যেহেতু প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া সফল হয়নি এবং রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিরোধীতা দেশের অন্দরে ছিলই, তাই বাংলাদেশের কয়েক হাজার রোহিঙ্গা পরিবারকে নোয়াখালির হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরে (বঙ্গোপসাগরের এক দ্বীপ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু এই স্থানান্তর জোরপূর্বক ছিল নাকি স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যেতে রাজি হয়েছিলেন, সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।

মায়ানমার সেনাবাহিনী হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করেছিল। তাঁদের গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনেকেই পালাতে গিয়েও গুলি খেয়ে মারা যান। উইলিয়াম ড্যানিয়েলস ন্যাশনাল জিওগ্রাফি-তে তাঁর সামনে থেকে দেখা মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের জীবন নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছেন। সদ্য মায়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের শিবিরে গিয়েছিলেন তিনি। দেখেন শরণার্থীরা বাঁশ এবং ত্রিপল দিয়ে নিজেরাই নিজেদের থাকার তাবু বানাচ্ছিলেন। সবাই অসুস্থ না হয় আহত। ড্যানিয়েলস বলেছেন, তিনি এমন ১০,০০০ জনকে দেখেছিলেন যাঁরা সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারেন না। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মায়ানমারে সংগঠিত অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা হয়েছে। আইসিসির শুরু করা এই তদন্ত এখনও বিচার-পূর্ব অবস্থা বা প্রি-ট্রায়াল পর্যায়ে রয়েছে।

আরও পড়ুন- বাংলাদেশে ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী! বাড়ি ফিরতে পারবেন?

উইলিয়াম ড্যানিয়েলস আরও বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে শতকরা ৬৭ শতাংশই ছিল মহিলা। তাঁদের মধ্যে ১৩ শতাংশ গর্ভবতী বা স্তন্যপান করানো মহিলা। এমনও অনেকেই ছিলেন যাঁরা নিজের চোখের সামনে পরিবারের প্রিয়জনদের হত্যা দেখেছেন। সামরিক বাহিনীগুলিতে পঙ্গু হয়ে শত শত রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে এসে উঠেছিলেন বলেও জানান তিনি। এখন এই শিবিরগুলিতে পর্যাপ্ত আশ্রয়, পানীয় জল, স্যানিটেশনের অভাব দেখা দিচ্ছে। ভাত ছাড়া প্রায় কিছুই খাবার জোটে না তাঁদের।

তবে সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে তিনটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। প্রথমটি হয় ২৫ অগাস্ট বাংলাদেশের কক্সবাজারে। অন্য দুই সম্মেলনের একটি হবে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। অন্যটি হবে ৬ ডিসেম্বর কাতারে। এই দিন বাংলাদেশের কক্সবাজারের সম্মেলনে পশ্চিমা বিশ্বের ১১টি দেশ বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সাত দফা প্রস্তাব তুলে ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও কার্যকর ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

একধিকবার আন্তর্জাতিক উদ্যোগে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশে ফেরানোর কথা হয়েছে। আট বছর তাঁরা দেশ ছাড়া। ২৫ অগাস্ট ফের তাঁরা নিরাপদে মায়ানমারে ফেরার দাবি তুলেছিলেন। আমেরিকার সংবাদপত্র ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ লিখেছিল, কক্সবাজারের কুটুপালং শরণার্থী শিবিরের সামনে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জমায়েত করে প্রতিবাদ করেন। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। তবু আরও বিস্তর আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। প্রশ্ন থাকছেই, কবে নিজ ভূমিতে সম্মানের সঙ্গে ফিরতে পারবেন রোহিঙ্গারা?

(লেখকের মতামত ব্যক্তিগত)

More Articles