আলাস্কার জঙ্গলে একা, ৩০ বছর...
কতবার আপনি জীবনে ভেবেছেন, 'অনেক হল এই সংসার সমাজ নিয়মকানুন সভ্যতার ঘেরাটোপ। এবার এই সব কিছুর থেকে মুক্তি নিয়ে চলে যাই প্রকৃতির কোলে'। যেখানে সভ্যতার শব্দ পৌঁছায় না, যেখানে রোজ ভোরবেলা কানের কাছে বেজে ওঠে না অ্যালার্ম ক্লক, যেখানে গাড়ির হর্ন নেই, রাস্তায় চারচাকার জট পেকে নেই, যেখানে ইট সুরকির এই শহরের কোলাহল পৌঁছায় না। যেখানে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে, প্রকৃতির নিস্তব্ধতার আওয়াজ শোনা যায় যেখানে স্পষ্ট, যেখানে আপনি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও মানুষ নেই, যেখানে কুয়াশার মায়াজাল বিস্তৃত হয় দূর থেকে দূরে, আরও দূরে...
ভেবেছেন হয়তো বহুবার। কিন্তু শুধু ভাবাই হয়েছে, করা হয়ে ওঠেনি। বহুবার হয়তো স্বপ্ন দেখেছেন এমন একটা জীবন বাঁচার, কিন্তু স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গিয়েছে। আপনি একা নন, আমরা প্রায় প্রত্যেকে এই স্বপ্ন জীবনে কখনও না কখনও দেখেছি। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ করে দেখিয়েছেন একটি মাত্র লোক। যিনি জনসভ্যতা থেকে সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে আলাস্কার এমন একটি জায়গায় কাটিয়েছিলেন নিজের জীবনের ৩০টা বছর, যেখানে তিনি ছাড়া আশেপাশের শত শত মাইল দুরেও না ছিল মানুষ, না ছিল সভ্যতার পদচিহ্ন। কে তিনি? কী তার গল্প? কীভাবে তিনি একলা কাটালেন ৩০ বছর প্রকৃতির কোলে নিজের সাথে?
১৯৬৮ সালের কোনও এক গ্রীষ্মের দুপুরে আলাস্কার বুকের গভীরে অবস্থিত টুইন লেকের ওপরে নেমে এলো একটি ছোট্ট বুশ প্লেন। প্লেন থেকে নেমে এলেন এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক। তারপর প্লেনের দিকে ঘুরে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালেন প্লেনের ককপিটে থাকা নিজের বন্ধুদের। তাকে নামিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে উড়ে গেলো প্লেন, ছোট থেকে ছোট্ট হতে হতে আস্তে আস্তে প্লেনটা হারিয়ে গেল আলাস্কার বড় বড় পর্বত শৃঙ্গের মাঝে। মাঝবয়সী লোকটাকে যে জায়গায় নামিয়ে প্লেনটা ফেরত চলে গেলো ফের সে জায়গাটার থেকে পাকা রাস্তার দূরত্ব কয়েক শত মাইল, এবং সে জায়গাটা থেকে লোকালয়ের দূরত্ব হয়তো হাজার হাজার মাইল। কোত্থাও কোনও মানুষ নেই, শুধু বন্য জীবন আর প্রকৃতির মাঝে একটা মানুষ থাকতে এলেন অনির্দিষ্টকালের জন্য, সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় এবং সজ্ঞানে। বন্ধুদের প্লেনকে হাত নেড়ে বিদায় জানানোর পর, ভদ্রলোক আলাস্কার মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির বুকের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিলেন, আর ফিসফিসিয়ে বললেন, 'ইটস গুড টু বি ব্যাক'
ভদ্রলোকের নাম রিচার্ড লুইস প্রয়েনেক। জন্ম ৪ঠা মে, ১৯১৬ সালে। ছোটবেলা থেকেই অভাব অনটনে বড় হওয়া রিচার্ড প্রথম জীবনে আমেরিকান নেভিতে একজন কাঠ মিস্ত্রির কাজ করতেন। প্রথম দু'বছর পার্ল হারবারে কাজ করার পর, আমেরিকান নেভি তাকে ট্রান্সফার করে দেয় সান ফ্রান্সিসকো তে একটি জাহাজ তৈরির কাজে। কিন্তু সেখানে গিয়ে রিচার্ড একটি দুরারোগ্যের কবলে পড়েন। প্রায় ৬ মাস নেভি হসপিটালে থাকার পরে তার শরীর আরও দুর্বল হয়ে পড়ে, যার ফলে নেভি থেকে তাকে ১৯৪৫ সালে মেডিক্যাল ডিসচার্জ দেওয়া হয়। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে রিচার্ড বুঝতে পারেন তাকে এবার তার শরীরের ওপর বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। নেভি থেকে মেডিক্যাল ডিসচার্জ পাওয়ার পর রিচার্ড ডিজেল মেকানিকের কাজ শেখেন এবং নিজের কর্মদক্ষতার ফলে বেশ নাম করে নেন। কিন্তু নিজের কাজে নাম কামিয়েও খুশি হতে পারলেন না রিচার্ড, ছোট থেকেই তাকে প্রকৃতি খুব টানতো। এদিকে তার কার্য্যক্ষেত্র তাকে দূরে রাখতো প্রকৃতির বুক থেকে। তাই রিচার্ড এবার অরেগণ, আলাস্কার বুকে একটি জায়গায় কাজে ঢুকলেন। ১৯৫০ সালে আলাস্কার শুয়াক আইল্যান্ডে একটি নাভাল স্টেশনে কাজ পেলেন রিচার্ড। পরের কিছু বছরে বিভিন্ন কার্য্যসূত্রে তিনি ঘুরে বেড়াতে শুরু করলেন আলাস্কার এ'প্রান্ত থেকে ও'প্রান্তে। এবং ভদ্রলোক প্রেমে পড়লেন আলাস্কার অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের। মনে মনে তিনি ঠিক করলেন কাজ থেকে অবসরের পরের জীবনটা তিনি আলাস্কার বুকেই কাটবেন। একা...
১৯৬৮ সালে রিচার্ড যখন আলাস্কার বুকে জীবনের বাকি দিনগুলি কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে প্লেনটা থেকে নামলেন, তখন তিনি ৫১ বছর বয়স্ক একটি মধ্যবয়স পার করা ব্যক্তি। এই বয়সে অধিকাংশ মানুষই বাকিটা জীবন অতিবাহিত করার জন্য অন্য মানুষের কাঁধ খোঁজেন, কিন্তু রিচার্ড বাবু সেই বয়সে কাঁধে কুঠার নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন আলাস্কার গভীর জঙ্গলে। কেটে নিয়ে এলেন গাছের গুঁড়ি, নিজের অদ্ভুত দক্ষতায় সেই কাঠ দিয়ে বানালেন একটি ১২ফুট বাই ১৫ ফুটের লম্বা কেবিন। মাথা গোঁজার ছাদ বানালেন, শিকার করলেন, রান্না করলেন, জঙ্গলি প্রাণীদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় বের করলেন। তৈরি করলেন কাঠের বোট, টুইন লেকের বুকে মাছ ধরলেন। প্রকৃতির দিকে অবাক নয়নে চেয়ে রইলেন, লিখলেন ডায়েরিতে তার অনন্য জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা, একটা ট্রাইপড আর একটা ১৬mm এর ক্যামেরাতে রেকর্ড করে রাখলেন নিজের জীবন যাত্রা আর আলাস্কার বুকের অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, শান্তির মায়াজাল, নৈঃশব্দের শব্দ। বছরের পর বছর প্রকৃতির বুকে সম্পূর্ণ একলা থাকতে থাকতে নিজেকে আবিষ্কার করলেন, নিজের ক্ষমতা অক্ষমতা সম্পর্কে অবগত হলেন। আলাস্কার দাঁত কাঁপানো ঠান্ডা থেকে বাঁচতে তার অদ্ভুত সুন্দর কেবিনে তৈরি করলেন ফায়ার প্লেস। খাবার যাতে নষ্ট না হয় তার জন্য বানালেন মাটির নিচে প্রাকৃতিক ফ্রিজার। এভাবেই রিচার্ড কাটিয়ে দিলেন নিজের জীবনের ৩০ টা বছর প্রকৃতির বুকে, একলা।
১৯৯৯ সালে যখন তাঁর ৮২ বছর বয়স, বয়সের ভারে যখন তাঁর পক্ষে আর আলাস্কার বুকে একলা জীবন কাটানো সম্ভব হল না তখন তিনি ফিরে এলেন ক্যালিফোর্নিয়ায় নিজের ভাই জেক-এর কাছে। আসার আগে নিজের কেবিনটা দান করে দিলেন ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিস আলাস্কাকে। ২০ই এপ্রিল, ২০০৩ সালে হঠাৎ হৃদরোগে চোখ বন্ধ করেন রিচার্ড লুইস প্রয়েনেক। আর খোলেনি সেই চোখ কোনওদিন। তার বানানো কেবিনটা এখনও টুইন লেকের ওপরে সংরক্ষিত করা আছে শিল্পের অনন্য উদাহরণ হিসাবে।
আলাস্কায় থাকাকালীন রিচার্ড নিজের দিনলিপিতে যা লিখে রাখতেন তা ১৯৯৯ সালে বই হিসাবে প্রকাশিত হয়, One Man's Wilderness: An Alaskan Odyssey এবং বইটি জিতে নেয় সে বছর ন্যাশনাল আউটডোর বুক এওয়ার্ড। এ ছাড়াও তার মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে বেশ কিছু ডকুমেন্টারি হয়, যেখানে তার ১৬mm ভিডিও ক্যামেরার ফুটেজগুলো ব্যবহার করা হয়।
তাঁর মৃত্যুর দু'দশক পরেও রিচার্ড লুইস প্রয়েনেক আজও লক্ষ লক্ষ প্রকৃতিপ্রেমীর বুকে জীবিত রয়েছেন। তিনি আজও তাদের অনুপ্রেরণা যারা সারাজীবন স্বপ্ন দেখছে একদিন সব ছেড়েছুড়ে প্রকৃতির বুকে আত্মসমর্পণ করার।