লাখ টাকার চাকরি ছেড়ে সম্বল বই, সাইকেল লাইব্রেরির হাত ধরে দিনবদলের স্বপ্ন এমবিএ যুবকের
MBA Man Bicycle Library : নিশ্চিত ভবিষ্যৎ, বিদেশ ভ্রমণ। কিন্তু সেসব ছেড়ে, রোদ মাথায় নিয়ে বই কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছেন কেন?
একটা সাধারণ বাইসাইকেল, আর পিঠে একটা ব্যাগ। তাতে করেই এগলি থেকে ওগলি ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক যুবক। একেবারে সাধারণ জামা-কাপড়, ঠিক যেন মধ্যবিত্ত বাড়িটির ছেলে। পিঠের অই ব্যাগটির ভেতরেই রয়েছে হাজার হাজার শব্দের পাহাড়। রয়েছে বিস্তর বই। সেসব নিয়েই ঘুরে বেড়ান ওই যুবক। কিন্তু কেন? না, সেরকম কিছু নয়, ওই সাইকেল, তিনি আর তাঁর ওই ব্যাগ – এসব নিয়েই আস্ত একটা ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। লোকজন আসেন, বই নেন, পড়েন। অথচ ওই সাইকেল চালকের কাহিনি খানিক অন্যরকম হতেই পারত। সঙ্গে ছিল লাখ টাকার চাকরি, নিশ্চিত ভবিষ্যৎ, বিদেশ ভ্রমণ। কিন্তু সেসব ছেড়ে, রোদ মাথায় নিয়ে বই কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছেন কেন?
স্বপ্ন – আসলে বড় বিষম বস্তু। কখনও সেটা পূরণ হয়, কখনও চোখের সামনেই সেসব টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে। অবশ্য একটা সময় অবধি জি মুরগারাজের সেরকম কোনও স্বপ্নই ছিল না। তামিলনাড়ুর কুম্বাকোনামের বাসিন্দা মুরগারাজ অন্যান্যদের মতোই পড়াশোনা করে ভালো একটা চাকরির কথা ভাবত। বাড়িতে গয়নার ব্যবসা, আর্থিক অবস্থা একেবারে খারাপ নয়। মধ্যবিত্ত আর কি! আন্না বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঁচ বছর আগে নিজের এমবিএ ডিগ্রি সম্পূর্ণ করেন মুরগারাজ। ব্যস, তারপরই ঢুকে পড়া চাকরিতে। একটি নামী, মাল্টিন্যাশনাল ব্যাঙ্কে ভালো পোস্টেই চাকরি পেয়ে যান তিনি। লাখ টাকা মাইনে, ভবিষ্যৎও প্রায় নিশ্চিত। সুযোগ এলে বিদেশে যাওয়ারো অফার আসবে।
আরও পড়ুন : ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে কীসের চোরাকুঠুরি? বাংলার গুপ্তধন নিয়ে রয়েছে যে যে জল্পনা
একদিন থেকে দেখতে গেলে, সুখের জীবন। অনেকেই এই জীবন চান। ভালো মাইনে, সংসার আর বিদেশ ভ্রমণ। কিন্তু যত দিন এগোল, জি মুরগারাজ কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে উঠলেন। সবই আছে, টাকা, ভবিষ্যৎ; কিন্তু শান্তি? সেটাই তো নেই। রোজকার সেই এক রুটিন, অফিস, এসির হাওয়া আর বাড়ি। একটা সময় পর হাঁপিয়ে উঠলেন তিনি। ঠিক করলেন, অনেক হয়েছে আর নয়। এবার চাকরিটা ছাড়তে হবে। নয়তো নিঃশ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না। ছেড়ে দিলেন লাখ টাকার চাকরিটা।
কিন্তু এখন? কী করবেন তিনি? চলে গেলেন বাড়িতে। পরিবারের গয়নার ব্যবসাটা যদি সামলানো যায়। কিন্তু মুরগারাজের বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না। ব্যস, সেই আশাো জলে গেল। তাহলে? আর কিছু না পেয়ে, টাকা জোগাড় করে চেন্নাইতে একটি অ্যাড এজেন্সি খুললেন। একটু একটু করে শুরু হল কাজ। আর সেই কাজ করতে করতেই একটা ব্যাপার দেখলেন মুরগারাজ। মানুষ এখন সেভাবে বইপত্র পড়েন না। ব্যস্ত জীবনে সেই ফুরসতও মেলে না, সুযোগও নেই। কিন্তু আখেরে ক্ষতি হচ্ছে আমাদেরই। মানুষই অনেককিছু জানতে পারছেন না, বই পড়ার অভ্যাস চলে গিয়ে ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। লাইব্রেরির দিকেও সেভাবে কেউ পা বাড়ায় না।
এখান থেকেই নতুন একটা স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন জি মুরগারাজ। লাইব্রেরি অবধি যেতে না পারুক, যদি লাইব্রেরিই পৌঁছে যায় ঘরে! সেখান থেকেই ২৮ বছরের এই যুবক শুরু করলেন ‘মোবাইল লাইব্রেরি’। নিজের কিছু বই, আর বন্ধু-বান্ধবদের দেওয়া কিছু, সেসব নিয়েই ব্যাগে পুরলেন। তারপর একটা সাইকেলে চেপে বেরিয়ে পড়লেন। এভাবেই শুরু হল ‘ভাল্লালার লাইব্রেরি’র পথচলা। এমন নামই দিয়েছেন মুরগারাজ। মন্দির, স্কুল, কলেজ, পার্কের বাইরে সাইকেল বা ভাড়ার চারচাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। অবশ্য চারচাকাটি সবসময় বের করেন না, ওই মাসে দু-চারবার। বাকি সময় স্রেফ সাইকেল আর ব্যাগই তাঁর সঙ্গী। সেটা নিয়েই পথ চলতে শুরু করে এই মোবাইল লাইব্রেরি।
আরও পড়ুন : কেউ অ্যাসিড-আক্রান্ত, কেউ রূপান্তরকামী || বইয়ের বদলে মানুষ পড়া যাবে এই লাইব্রেরিতে
বার্ষিক ৩০০ টাকা চাঁদা, বলা ভালো সাবস্ক্রিপশন। এই লাইব্রেরি থেকে বই নিতে গেলে এই টাকাই দিতে হবে প্রতি বছরে। পাশাপাশি যদি নিজের পুরনো বই দিতে চান, তাহলেও স্বাগত। দেখতে দেখতে মুরগারাজের এই লাইব্রেরিতে আজ ৩০ জন সদস্য। বইয়ের সংখ্যা ৩৫৬টি। আরও যাতে এই সংখ্যা বাড়ে, সেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। এই কাজে সাহায্য করার জন্য একজন সহকারীও রেখেছেন তিনি। তাহলে খরচ কী করে আসছে?
তার জন্য এখন চলছে জি মুরগারাজের ওই অ্যাড এজেন্সিটি। বারবার যাতায়াত করতে হয় সেখানে। ওখান থেকেই মূল উপার্জন আসে। লাখ টাকা হয়তো নয়, আর সেজন্যই বিয়েও সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু মুরগারাজ নিজের লক্ষ্যে অবিচল। তিনি নিজের কাজটি করে যাচ্ছেন। উচ্চশিক্ষিত, এমবিএ পাস এই যুবক ঘুরে বেড়ান সাইকেল নিয়ে। লক্ষ্য একটাই, মানুষ আরও জানুক। আরও শিখুক। আরও পড়াশোনা করুক।