জলের উপর ভাসমান আস্ত জাতীয় উদ্যান রয়েছে ভারতেই! কীভাবে পৌঁছবেন আশ্চর্য এই ঠিকানায়
Loktak Lake : উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুরের এই ন্যাশানাল পার্কটি লোকটাক হ্রদেরই একাংশ
কখনও শুনেছেন একটা আস্ত জাতীয় উদ্যান জলের উপর ভেসে রয়েছে? সেই জলের উপরেই আবার চরে বেড়াচ্ছে বন্যপ্রাণী! এটি বিশ্বের একমাত্র ভাসমান জাতীয় উদ্যান। আর এই আশ্চর্য জায়গাটি দেখতে আপনাকে পৃথিবীর সুদূর কোনো প্রান্তেও যেতে হবে না। এই জাতীয় উদ্যানটি রয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুরেই। এই ন্যাশানাল পার্কটি লোকটাক হ্রদেরই একাংশ।
পৃথিবীর একমাত্র ভাসমান জাতীয় উদ্যান, কাইবুল লামজাওতে আপনাকে স্বাগত। পৃথিবীর একমাত্র ভাসমান জাতীয় উদ্যানের পাশাপাশি, এটি সাংগাই হরিণের একমাত্র প্রাকৃতিক বাসভূমিও বটে। তবে সাংগাই ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের বন্যপ্রাণী, পাখি, এবং গাছপালার সমাহার দেখা যায় কাইবুল লামজাও ন্যাশানাল পার্কের বুকে।
প্রায় চল্লিশ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত কাইবুল লামজাও ন্যাশানাল পার্কের দূরত্ব ইম্ফল থেকে প্রায় আটচল্লিশ কিলোমিটার। এই ন্যাশানাল পার্ক কাইবুল লামজাও সংরক্ষণ অঞ্চলের অন্তর্গত। এবং এই সংরক্ষণ অঞ্চলেরই আওতায় পড়ছে একশো চল্লিশ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে থাকা লোকটাক হ্রদ এবং তেতাল্লিশ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে থাকা পামলেন পাট।
দিগন্ত বিস্তৃত ভাসমান উদ্যানে বৃক্ষ বা গুল্ম নেই। উদ্যান ভরে রয়েছে কাশফুলের মতো লম্বা "নুরা খুদোলেই"(Nura Khudonglei)। নভেম্বরের পাহাড়ী বিকেল - কুয়াশা আকাশ থেকে নেমে প্রায় চুম্বন করবে "নুরা খুদোলেই"- এর কপালে। মাইতেই সম্প্রদায়ের বনকর্মী নৌকা বাইতে বাইতে বলতে থাকেন "নুরা খুদোলেই" কথার অর্থ। কোনও বিবাহযোগ্যা নারীকে প্রেম প্রস্তাব দেওয়ার সময়ে উপহার দেওয়া যায় এমন ফুল - তাকে বলে "নুরা খুদোলেই"।
আরও পড়ুন - গুয়াহাটির জঙ্গলে ভূতের নাচ! সরাইঘাটের যুদ্ধে যেভাবে মুঘলদের হারিয়েছিল অহমরা
নৌকা এগিয়ে চলে সংকীর্ণ জলপথ জুড়ে। দুদিকে "ফুমদি", যার অর্থ ভাসমান বাগান। মাটি, জৈব পদার্থ, অর্ধেক পচা গাছ-পালা, ঘাষের অংশ দিয়ে তৈরি হয় ফুমদি। কয়েক সেন্টিমিটার থেকে দুই মিটার পর্যন্ত ফুমদির পুরুত্ব। মজার বিষয় হল, ফুমদির মাত্র কুড়ি শতাংশ অংশ জলের উপর ভেসে থাকলেও, বাকি আশি শতাংশ রয়েছে জলতলের নীচে। ফুমদির প্লবতা অত্যন্ত বেশি হওয়ায় কিছু অংশ জলতলের উপরে ভেসে থাকে।
সেই ভাসমান উদ্যানেই মাথা তুলে রয়েছে গাছপালা। সেখানে বিভিন্ন ধরণের পাখি, পতঙ্গের বাস। ফুমদির তলদেশে ভেসে বেড়াচ্ছে মাছও। বাঙালির মতো মাছে-ভাতে না হলেও, মণিপুরের অধিবাসীদের খাদ্যাভাসে মাছ আর ভাত অবিচ্ছেদ্য অংশ।মৎসজীবীদের একটা বিরাট অংশ নির্ভর করে লোকটাক হ্রদের উপর। এই ভাসমান উদ্যান সেই হ্রদেরই একটি অংশ।
জাতীয় উদ্যানের যে অংশটি ভাসমান নয়, অর্থাৎ পাহাড়ী যে অংশটি, তার একটি অংশ ধরে পাকা রাস্তা উঠে গেছে টিলার মাথায়। সেখানে তৈরি হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। যতদূরে চোখ যায়, দিগন্ত অবধি সাদা "নুরা খুদোলেই" সাজিয়ে রেখেছে "ঘেসো" জাতীয় উদ্যানকে। উদ্যানের প্রান্তে মাথা তুলে রয়েছে ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড়, সূর্যাস্তের হলদেটে আলোয় সবুজ পাহাড় নীলচে হয়ে উঠেছে। ওয়াচ টাওয়ারের মাথায় চড়ে "কাইবুল লামজাও"-এর সৌন্দর্য উপভোগই শুধু করা যায় না, দেখা যায় সাংগাই হরিণও। তবে লম্বা ঘাসের মধ্যে তাকে খুঁজে বের করা দু:সাধ্য। অভিজ্ঞ চোখ ছাড়া সেই লাজুক প্রাণীর দেখা বড় একটা পাওয়া যায় না। তবে বনকর্মী ও বিশেষ অতিথিদের জন্যে রয়েছে দূরবীন। যদিও তা জনসাধারণের জন্য উপলব্ধ নয়।
প্রশিক্ষিত বনকর্মী সেই দূরবীন দিয়ে নিজেই দেখিয়ে দেন একটি মাদী সাংহাই। মাদী সাংহাইয়ের শিং থাকে না। পুরুষ সাংহাইয়ের সিং তার শরীরে যেন আলাদা সৌন্দর্য বাড়ায়। প্রাণীকূলে পুরুষ প্রাণী বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করে স্ত্রী প্রাণীটির নজর কাড়ার। পুরুষ সিংহের কেশর, ময়ূরের পুচ্ছ, এবং পুরুষ সাংহাইয়ের শিং থাকা তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এদিকে কিছুদিন আগেই শেষ হয়েছে সাংহাই উৎসব। শিংওয়ালা পুরুষ সাংহাইয়ের ছবিতে চারিদিক ছয়লাপ। সে সব যেন পুরুষ সাংহাই দেখার উৎসাহকে আরও উস্কে দেয়। দিন কয়েক আগে দক্ষিণ ভারতের জঙ্গল আর ধানখেতে একাকী বা দলবদ্ধ ময়ূর দেখলেও, উত্তর-পূর্বে এসে পুরুষ সাংহাই দেখার সৌভাগ্য হয় না।
এবার লোকটাক হ্রদের ভিউ পয়েন্টে পৌঁছনোর পালা। তখন প্রায় সূর্যাস্ত। ভিউপয়েন্টেও রয়েছে ক্যাফে, রেস্তোরাঁ। সেখানে বসে উপভোগ করা যায় সূর্যাস্তের দৃশ্য। লোকটাক হ্রদের যে অংশটি জাতীয় উদ্যানের অংশ নয়, সেখানে গড়ে উঠেছে ক্যাফে এবং হোমস্টে। হ্রদে রয়েছে বোটিংয়ের ব্যবস্থাও। শালুক ফোটার মরসুমে লোকটাক ভরে ওঠে রাণী রঙের শালুকে। মণিপুরের হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে উপাসনা বা শ্রদ্ধার্ঘ্যের জন্যে শালুক ফুল বিশেষ ভাবে ব্যবহার হয়।
আরও পড়ুন - নদী-জঙ্গল-পাহাড় পেরিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছচ্ছেন ওষুধ! কে এই প্রভাসিনী?
লোকটাক হ্রদের বুকেও এদিকে ওদিকে জেগে উঠেছে সবুজ, বৃত্তাকার ফুমদি। যেন কেউ পরিকল্পনা-মাফিক এঁকে দিয়ে গিয়েছে একটি সবুজ বৃত্ত, যার মধ্যিখানে জল। কলকাতা থেকে ইম্ফল যাওয়ার সময়ে বিমান থেকে মনে হচ্ছিলো, যেন কতগুলি সবুজ, গোলাকার বুদবুদ ভেসে রয়েছে।
ইম্ফলে রেলপথ তৈরি হয়নি। ইম্ফল সরাসরি পৌঁছতে গেলে বিমানপথই ভরসা। রাস্তাঘাটও বিশেষ ভালো নয়। বিমানবন্দরের সামনের জাতীয় সড়কটিতে মেরেকেটে পনেরো কিলোমিটার অবধি মসৃণভাবে গাড়ি চালানো যায়। লোকটাক বা তার সংলগ্ন কাইবুল লামজাও ন্যাশানাল পার্কে পৌঁছতে গেলে ভাড়া গাড়ি-ই শ্রেয়। ইম্ফল থেকে সকাল আটটায় মোইরাংয়ের উদ্দ্যেশ্যে শেষ বাসটি রওনা হয়। মোইরাং থেকে বেশ খানিকটা পায়ে হেঁটে পৌঁছনো যায় জাতীয় উদ্দ্যানের প্রবেশ তোরনে। মাথাপিছু প্রবেশ মূল্য কুড়ি টাকা। গাড়ি থাকলে একশো টাকা বেশি লাগবে।
প্রবেশের সময় মনে রাখবেন, এটি একটি জাতীয় উদ্যান এবং সংরক্ষিত অঞ্চল। প্লাস্টিকের ব্যবহার, তামাক সেবন ও মদ্য পান এখানে নিষিদ্ধ। পিকনিক বা জোরে গান চালানোর যায়গাও এটি নয়। একসময় ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত এই ভাসমান জাতীয় উদ্যানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আপনি অবশ্যই বেড়িয়ে আসুন। তবে যেখানে বেড়াতে যাচ্ছেন সেখানকার প্রকৃতি-পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়াও আপনার কাছে কাম্য।
এই ভাসমান জাতীয় উদ্যান এবং লোকটাক হ্রদ এর আগে ইথাই ব্যারেজের বানভাসী জলে ক্ষতিগ্রস্ত রয়েছে। খুব কষ্টে আবারও ফুমদিগুলিকে আবার জাগিয়ে তুলেছিলেন বনকর্মী ও স্থানীয়রা। এবং এখনও এই অঞ্চল পুরোপুরি সেই আঘাত থেকে সেরে ওঠেনি। এর উপর উৎসাহী পর্যটকের দায়িত্বহীনতার ভার জাতীয় উদ্যানটি আর বইতে পারবে না।