ট্রাম্প-পুতিন-আম্বানি, ত্রয়ীর মধ্যে মিলটা কোথায়?
India-US relations: ফিনল্যান্ড-ভিত্তিক CREA-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, জামনগর রিফাইনারিতে যুদ্ধের আগে রাশিয়ান অপরিশোধিত তেলের ভাগ ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। যুদ্ধের পর তা লাফিয়ে বাড়ে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভ্লাদিমির পুতিন এবং মুকেশ আম্বানির মধ্যে কি কোনো মিল আছে? আপাতদৃষ্টিতে, এই তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের মধ্যে খুব বেশি মিল থাকার কথা নয়। প্রথমজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি; দ্বিতীয়জন রাশিয়ার সরকারপ্রধান; আর তৃতীয়জন ভারতের তথা বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই ত্রয়ীর মধ্যে সাধারণ সূত্র তেল, বিশেষ করে অপরিশোধিত তেল। এই তিনজনকে একত্রে বেঁধেছে এক অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি। ট্রাম্প প্রশাসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রফতানির উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এর প্রভাব দেশের অর্থনীতির বহু ক্ষেত্রে পড়েছে। বিপন্ন হয়েছে অসংখ্য ছোট উদ্যোগ, কুটিরশিল্প।
৩০ জুলাই ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছিলেন, “যখন সবাই চাইছে রাশিয়া ইউক্রেনে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করুক, তখন ভারত ও চিন রাশিয়া থেকে তেল কিনছে। শুধু তাই নয়, ভারত ও চিন রাশিয়ার জ্বালানির সবচেয়ে বড় ক্রেতা।” সেই থেকে ওয়াশিংটনের শীর্ষ কর্মকর্তারা একের পর এক কঠোর বার্তা দিচ্ছেন। শুল্ক আরোপের তালিকায় রয়েছে কাটা ও পালিশ করা হিরে, গয়না, চিংড়ি ও অন্যান্য সামুদ্রিক পণ্য, পোশাক, কার্পেট এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য। ব্রাজিল ছাড়া অন্য কোনো বড় দেশের ওপর এত উচ্চ শুল্ক চাপানো হয়নি।
মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেস্যান্ট, হোয়াইট হাউসের ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ স্টিফেন মিলার এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো— সবাই ট্রাম্পের সুরে সুর মিলিয়েছেন। নাভারো বিশেষভাবে আক্রমণ করেছেন ভারতকে, বলেছেন ভারত রাশিয়ার 'যুদ্ধযন্ত্রে' ইন্ধন জোগাচ্ছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফিনান্সিয়াল টাইমসে নাভারো লিখেছেন, "ভারত এখন রাশিয়ার তেলের জন্য এক ধরনের বিশ্ব ক্লিয়ারিং হাউসের মতো কাজ করছে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা অপরিশোধিত তেল আমদানি করে তা প্রক্রিয়াজাত করে উচ্চ দামে রফতানি করছে, আর এতে লাভ পাচ্ছে মস্কো।" তিনি ভারতকে রাশিয়ার 'লন্ড্রি' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বেস্যান্ট আম্বানির নাম না করেই বলেছেন, ভারতের কিছু ধনী পরিবার রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী।
আরও পড়ুন- বস্ত্রে ৫০ শতাংশ শুল্ক! ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে মাথায় হাত লাখো কারিগরের
তথ্য বলছে, ভারত তার অপরিশোধিত তেলের প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি করে, যা মোট আমদানির এক-চতুর্থাংশ। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ভারতীয় আমদানির বড় অংশ আসত পশ্চিম এশিয়া (ইরান, ইরাক, কুয়েত এবং সৌদি আরবের মতো দেশ) থেকে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়া আন্তর্জাতিক বাজারদরের অর্ধেক দামে তেল সরবরাহ করতে শুরু করে। ফলে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাশিয়ার তেল ভারতের মোট আমদানির ৩৫-৪৫ শতাংশে পৌঁছায়, যা যুদ্ধের আগে ছিল মাত্র ১-২ শতাংশ। এই আমদানির অর্ধেক এসেছে দুটি বেসরকারি শোধনাগারে— রিলায়েন্সের জামনগর রিফাইনারি কমপ্লেক্স (মুকেশ আম্বানির নেতৃত্বে), ভাদিনার রিফাইনারি (বর্তমানে রুশ মালিকানাধীন নায়ারা এনার্জি)। বাকি অর্ধেক আমদানি করেছে সরকারি খাতের সংস্থাগুলি— ইন্ডিয়ান অয়েল, হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম এবং ভারত পেট্রোলিয়াম। বলা বাহুল্য, অপরিশোধিত তেলের দাম কমার ফলে ভারতীয় গ্রাহকদের তেমন কোনো লাভই হয়নি, বরং সরকার এবং তেল কোম্পানিগুলির কোষাগার সমৃদ্ধ হয়েছে।
ফিনল্যান্ড-ভিত্তিক সংস্থা CREA (Centre for Research on Energy and Clean Air)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, যুদ্ধের আগে জামনগর রিফাইনারিতে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের ভাগ ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। যুদ্ধের পর তা লাফিয়ে বাড়ে। সেই তেল প্রক্রিয়াজাত হয়ে পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাস, বিমান জ্বালানিতে রূপান্তরিত হয়। আশ্চর্যজনকভাবে, এর সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই। নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশগুলোর নিয়ম ভেঙে রাশিয়ায় উৎপাদিত অপরিশোধিত তেল নিয়ে যাওয়া শত শত জাহাজকে ট্র্যাক করে CREA দেখে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ তেল ছিল জাহাজগুলিতে। দেখা গিয়েছে, চিন রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্রেতা; ইউরোপীয় ইউনিয়নও রাশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে চলেছে। অথচ ভারতকেই নিশানা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
আরও পড়ুন- ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ! কীভাবে সংকট কাটাবে ভারত?
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোনো দেশেরই ভণ্ডামির কোনো সীমা নেই। চিন রাশিয়া অপরিশোধিত তেলের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক। কিন্তু, অর্থনৈতিক প্রভাবের কারণে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উপহাস করতে পারে এবং ট্রাম্প এ ব্যাপারে খুব বেশি কিছু করতে পারেন না, কেবল উচ্চস্বরে কথা বলা ছাড়া। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাসের একটি প্রধান আমদানিকারক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নীতি সকলের সামনে স্পষ্ট - তারা লক্ষ লক্ষ ডলার মূল্যের ইউরেনিয়াম এবং বিরল খনিজ আমদানি করে চলেছে।
প্রশ্ন উঠছে, ট্রাম্প কেন মোদিকে এইভাবে অপমান করার সিদ্ধান্ত নিলেন? একসময় মোদি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, “আব কি বার, ট্রাম্প সরকার”, কিন্তু সে বার বাইডেন জিতে গিয়েছিলেন। ট্রাম্প জানেন, মোদিকে চাপ দিয়ে তিনি পার পেয়ে যাবেন। কারণ ভারত এখনও সেই ‘বিশ্বগুরু’ হয়ে ওঠেনি, যেভাবে মোদি দাবি করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী গত ১১ বছরের তুলনায় দুর্বল। ট্রাম্প এই সত্যটিকেই পুরোপুরি কাজে লাগাচ্ছেন।
এই লড়াইয়ে সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ভারতের দরিদ্র জনগণ। কেন্দ্রের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা ভি অনন্ত নাগেশ্বরন জানিয়েছেন, এই বছর দেশের জিডিপি প্রায় ০.৫ শতাংশ কমতে পারে। এবং সাধারণ মানুষের জীবনে তার সরাসরি প্রভাব পড়বে।
(পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা একজন স্বাধীন সাংবাদিক, লেখক, প্রকাশক, শিক্ষক এবং তথ্যচিত্র ও সঙ্গীত ভিডিও নির্মাতা)
এই প্রতিবেদনটি নিউদিল্লি পোস্ট-এ প্রথম প্রকাশ হয়েছিল।

Whatsapp
