কাপেই নয় শুধু, তুফান উঠুক চিন্তায়ও- আলোআঁধারির কফিহাউজ
ছোটবেলায় বারবার শোনা রূপকথার গল্পে রাজকন্যার প্রাণভ্রমরা থাকত ঝিনুকে লুকনো। সেই ঝিনুকই রাজকন্যার মরণবাঁচন নির্ধারণ করত। কল্লোলিনী কলকাতারও এমন জিয়নকাঠি ছিল। কলকাতা যে জেগে আছে, কলকাতা যে রাগে ফুঁসছে তা বোঝা যেত ঝিনুক ছুঁলেই। দিনবদলের স্বপ্ন বুকে ঘোরা উদ্ধত যুবা, ফুটপাত শাসন করা স্বৈরাচারী কবি, ছোট করে ছাঁটা চুল সদ্য বিএ পাশ করা মেয়ে কালে কালে যিনি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তক হবেন, এমন অজুত নামের তালিকাকে গর্ভে ধারণ করেছিল এই শহরের পুরনো কফিখানাগুলিকে। কলেজ স্ট্রিট কফিহাউজ, যাদবপুর কফি হাউজ, চৌরঙ্গি কফি হাউজ, শহরটাকে তিনদিক দিয়ে ঘেরা এই আড্ডাঘরগুলিই ছিল বাঙালির অবিরাম চিন্তাস্রোতের আঁতুড়। সকাল বিকেল সেখানে এসে জুটতেন যাঁরা, তাঁদের নিয়ে চালু অজস্র মিথ আজ কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। শহর জুড়ে নিভু নিভু আলোর স্মার্ট ওয়াইফাই ক্যাফের জেল্লার পাশে বার্ধক্যের বারাণসীতে পৌঁছনো বিশ্বায়ন-পূর্বের এই তিনটি কফিঘর যেন ঈষৎ ম্লান, আড্ডার সেই মৌতাতও আর নেই। তবে সময়ের ক্যালাইডোস্কোপে চোখ রেখে আজও দিব্যি চলে যাওয়া যায় সেই সব পুরনো আড্ডায়। ওই তো টেবিলে টেবিলে জমছে তর্কের কূট, ওই তো খাপখোলা তরবারির মতো যুবক যুবতীরা জড়ো হচ্ছে কফি কাপকে সামনে রেখে।
চল্লিশের দশকের কলকাত্তাইয়া বুদ্ধিজীবীরা প্রাথমিক ভাবে মজেছিলেন চায়ে। খাঁটি আড্ডার আঁতুড় হয়ে উঠেছিল বসন্ত কেবিন, ফেভারিট কেবিন, সাঙ্গুভ্যালি, অমৃতায়ন। প্রথম প্রথম কফি হাউজকে ততটা নম্বর দিতেন না ডবল হাফ চা খোর তাবৎ বাঙালি ইন্টেলেকচুয়াল। তাঁদেরই কেউ কেউ এ ঠেক সে ঠেক ছেড়ে শেষমেশ পাকাপাকি আড্ডাঘর হিসেবে তারা বেছে নিয়েছিলে চৌরঙ্গি কফি হাউজকে। রাধাপ্রসাদ গুপ্তর কলমে ধরা আছে সেই প্রথম কফিখানা দর্শনের স্মৃতি। আমাদের যুবাকালের আড্ডা: ঝাঁকিদর্শন নিবন্ধে তিনি লিখছেন, “এখনকার ছেলেমেয়েদের কোনও কিছুই দেখে বিশেষ অবাক হতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। কিন্তু আমি সেই 'বুড়ো' বয়সেও কফি হাউজের বিরাট শহর, ঝকঝকে তকতকে চেহারা, টুপি আর উর্দি পরা তকমা আঁটা বয়, টেবিলে টেবিলে সুসজ্জিত খদ্দের দেখে আমি বেশ হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম।” তাঁর দেখানো পথেই ধীরে ধীরে এলেন তাঁর বন্ধুরা যথা, সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, মৃণাল সেনরা। আসতেন সব আড্ডার মধ্যমণি কমলকুমার মজুমদার। বিজ্ঞাপন জগতের চাকুরে সত্যজিৎ রায় তখনই ছবির নেশায় বুঁদ। অবসরে বন্ধুদের সঙ্গে বসে এই চৌরঙ্গির কফিখানায় চলে শব্দছক খেলা।
কমলকুমার মজুমদারকেও তখন কেউ চেনে না। 'জল' নামের একটি ছোট গল্প লিখেছেন সবে। আড্ডাধারীদের করিশ্মায় মুগ্ধ হয়ে কিনা জানা নেই, তবে ছবির সেটে হরিসাধন দাশগুপ্ত, সত্যজিৎ রায়, রামানন্দ সেনগুপ্তের মতো বাঙালি থাকায় চৌরঙ্গির কফি হাউজ চিনে নিতে অসুবিধে হয়নি ‘রিভার’ ছবিটি শুট করতে আসা ফরাসি ফিল্মমেকার জাঁ রেনোয়া। ভাঙা ফরাসিতে কমলকুমার তাঁকে বাংলার মানচিত্র বোঝাচ্ছেন, রিখিয়া চেনাচ্ছেন, সব মিলে হইহই কাণ্ড। বাংলা ছবির কালো ঘোড়ারা অশ্বমেধ যজ্ঞের প্রস্তুত নিচ্ছেন যে কফিঘরে, সেখানেই নিয়ম করে বসতেন সমর সেন। কফি খেতে খেতেই তিনি লিখছেন, বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিকের বেয়ারা অপেক্ষমান। হাতে হাতে চালান হবে পরের দিনের কাগজের জন্যে আগুনে সম্পাদীকয়। এই দৃশ্যের সাক্ষী আরেক ফ্রন্টিয়ার সম্পাদক তিমির বসুও। প্রথম দর্শনের স্মৃতি জানতে চাওয়ায় তিনিই বললেন, “জেলে যাওয়ার আগে উনি স্টেটসম্যানে চাকরি করতেন। লিখতেন কফি হাউজে বসে। আমার বন্ধু অন্রুধ সিং আমাকে তাঁর সন্ধান দেন। একটা টেবিলে একা বসতেন। সব ছোটখাটো লেখার খবর তাঁর কাছে থাকত।”
চল্লিশের মৌচাক যদি সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ কফিহাউজ হয়, পঞ্চাশকে বশ করেছে তবে কলেজস্ট্রিট কফিহাউজ। দু্'বেলা আ়ড্ডার এত বড় আখড়া শহরে আর কোথায়! ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবীরা ঠিক যেভাবে নিজেদের সংগঠিত করেছিল মমার্তের ছোট ছোট বারে, ঠিক যে ভাবে ফরাসি নতুন ছবির ঢেউ উঠেছিল পাঁচজন যুবকের নিয়মিত কফিখানার আলাপে, পঞ্চাশের লেখক, কবি,চিন্তককে ঠিক তেমন আশ্রয় দিয়েছিল এই কফিহাউজ। জ্ঞানপ্রবাহ আর রসের আড্ডায় সারাক্ষণ গমগম করছে বিরাট দোতালা হলঘরটা। আগেই লিখেছি, চৌরঙ্গীর কফিখানায় পা পড়েছিল ফরাসি সাহেব রেনোয়ার, ঠিক তেমনই নাকি বিখ্যাত ফিল্ম ক্রিটিক জর্জ শাদুলকে নিয়ে কলেজ স্ট্রিট কফি হাইজে নিয়ে এসেছিলেন ঋত্বিক ঘটক, বারীন সাহা। কফি হাউজ থেকে সোজা খালাসিটটোলা।
কফি হাউজই কৃত্তিবাস পত্রিকার আঁতুড়ঘর। বিনয় মজুমদার টেবিলে বসে গভীর চিন্তায় বুঁদ হয়ে রয়েছেন, পদ্যের তরবারি আর মদ্যের দমকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় মোহিত করে রেখেছেন আশেপাশের টেবিল এসব ছিল এই ঠেকের চেনা দৃশ্য। কবি রণজিৎ দাশ সেই দৃশ্যের বর্ণনায় লিখছেন, ''কফি হাউজে কাউকে পাত্তা দেওয়ার রীতি ছিল না। শক্তি ছিলেন ব্যতিক্রম। শক্তি এলে গোটা কফি হাউজ জুড়ে শিহরণ বয়ে যেত।" ফুলের বনে সোনার জহুরির দেখা মিলবেই। কফি হাউজের পঞ্চাশ দশকীয় আড্ডার গল্পও কমলকুমার মজুমদারকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। ঘুরে ঘুরে টেবিলে টেবিলে ঘুরে ঝোড়ো কথাবার্তা চালাতেন তিনি। মজার ছলে তাঁকে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত বলেছেন, ‘ফরাসী খাদ দেওয়া খাঁটি বাঙালি’। গল্পেরা শাখা মেলে, পুরনো পারস্যের ক্যাফেতে দাস্তানগো যেমন, তেমন কাহিনিওয়ালাদের দেখা পাই, আর প্ৰশ্ন জাগে. অর্থ নেই, বিত্ত নেই, কীসের টানে প্রতি সন্ধ্যায় জুড়ে যেত এত মানুষ নিয়ম করে? কোন অন্ধ আকর্ষণে একই ঘরের ভিতর তরজায় মাতে কলকাতা কাঁপানো বুদ্ধিজীবীরা! কোন আঠা জীবনসংগ্রামের দিনেও বেঁধে রাখে বন্ধুদের ? প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ হাসলেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। বললেন, "কফিহাউজটা আসলে সস্তা ছিল। আরেকটা বিষয়, যাবতীয় দারিদ্র্য সংগ্রাম নিয়ে আমরা একসঙ্গে থাকতে ভালবাসতাম, টেবিলে টেবিলে ঘুরে ভাগাভাগি করে কফি সিগারেট খেতাম। কফিহাউজই আমাদের বেঁধে রেখেছিল।"
কফি হাউজ আক্ষরিক ঘড়বাড়ি ছিল এই মানুষগুলির কাছে। দেশভাগের ক্ষত বুকে বয়ে বেড়ানো বিষণ্ন করুণ এই যুবকদের অস্তিত্ব সংকটের দিনে নিরাময় হয়েছিল এই বিরাট বাড়ি। একসময় কফি বোর্ড কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজ তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে লিখিত আকারে সিদ্ধান্ত তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়রা। শুধু কৃত্তিবাসই নয়, কত ছোট ছোট কাগজ তৈরি হয়েছে এই কফিহাউজে! পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, অরণি বসু, অমিতাভ গুপ্তর মতো বাংলা কবিতার কত কবির সম্পাদিত কাগজের যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি যে এই তাঁবুতে তা গুণে বলা যাবে না। সেই পরম্পরা আজও চলছে।শুধু এপার বাংলার সাহিত্যিকই নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় তামাম বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ধারণ করেছে এই কফিখানা। আল মাহামুদ, আহমেদ ছফারা চিন্তাক্লিষ্ট মুখে চুমুক দিয়েছেন কফির কাপে, এমন দৃশ্যের সাক্ষী মানুষজন আজও কলকাতা শহরে রয়েছেন। তবে ইতিহাসের ধারাভাষ্য লিখতে বসে সাহিত্যজীবীদের কথা বললে সত্যের অপলাপ হবে।
সত্তরের ঝোড়ো দিন গুলিতে কফি হাউজে লুকিয়ে চুরিয়ে এসেছেন সরোজ দত্ত, সুশীতল রায়চৌধুরীরা। পুলিশের চোখে ধুলো দিতে সামনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে পিছন দিয়ে নেমে গিয়েছে কত নকশাল ছেলে। এমন বহু ঘটনার ঘটনার সাক্ষী পাঁচ দশক এই দালানের ভিতরে কাটানো কফি হাউজের বেয়ারা আফজল হোসেন। কিছু কথা শুনেছেন, স্বচক্ষে দেখেছেনও বহু কিছু। তিনি বললেন, “বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও এখানে আসতেন আগে। আমি দু'বার দেখেছি তাঁকে। সদলবলে দেখা যেত মান্নাদাকে। একজন কবি একবার গল্প শুনতে অসুবিধে হচ্ছে বলে ফ্যানে কাঁচের গ্লাস ছুঁড়ে মারলেন। সব চুপ। শুরু হলো গল্প পড়া। আসলে কফি নয়, সবাই এই আড্ডার জায়গাটাকে ভালবাসতো। এখনও বাসে, তাই এত লোক দেখছেন।”
আফজল ভাইয়ের গল্পের সেই ব্যক্তি সে অর্থে কোনও কবি লেখক নন, সুবর্ণরেখার প্রকাশক ইন্দ্রনাথ মজুমদার। এমন প্রকাশক কি আর পাওয়া যাবে শহর ঢুঁড়ে!
কালের নিয়মের এসব দিন এখন সিপিয়া রঙা। কফি হাউজের অবিনাশী টিআরপি ছিল, অবিরল আড্ডা। কেউ তুলে দেবে় না, পকেট গড়ের মাঠ, তবু বন্ধু আছে, কফি জুটে যাবে। এখনও কেউ কেউ যায় সেই অমোঘ টানেই। তবে বিশ্বায়নের দাপটে গোটা শহরটাই বদলে গিয়েছে, নিজস্ব চরিত্র চলে গিয়েছে প্রতিটি পাড়ার। ধার দেনা দেওয়া মুদিখানা বদলে গিয়েছে শপিংমলে, হাতে হাতে ক্রেডিট কার্ড। নিজস্ব বাড়ি হাতে গোনা। একই রকম দেখতে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকেন পরস্পরের অচেনা মানুষ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আড্ডার চরিত্রও। আড্ডারা এখন অনেক বেশি ইমেজ সচেতন। কফিহাউজ তাই আজ যেন বিগতযৌবনা। মানুষ বৃত্ত ছোট করে, কাজের আড্ডায় একে অপরকে খুঁজে নিচ্ছে স্মার্ট ক্যাফের পরিসরে।
শহরের আনাচে কানাচে রোজ রোজ মাশরুমের মতো গজিয়ে ওঠা ক্যাফেগুলিতে একটা বিষয় কমন। ফ্রি ওয়াই ফাই জোন। প্রতিদিন একই বন্ধুর সঙ্গে একই ঠেকে গোটা সন্ধে ক্ষয় করার দিনও বোধহয় নেই। এমনকি বদলেছে আড্ডার পরিভাষাও। জেন ওয়াই আগের মতো আড্ডাধারী নয়। তাঁরা হ্যাং আউট করে, চিল করে। কফি হাউজের টোস্ট আর কফির একঘেয়েমি পেরিয়ে শহরের এই ক্যাফেগুলিতে রয়েছে একশো নতুন খাবার, সপ্তাহান্তে নতুন চমক। আর শুধু কলকাতা কেন, পৃথিবীর সব ছোট বড় শহরের ছবিটাই তো একরকম।
তবু কফিহাউজে হঠাৎ পা দিয়ে ফেলে, থমকে দাঁড়াই। ইচ্ছে করে ইতিহাসকে কিছুক্ষণ ছুঁয়ে থাকি। কত লোকই তো আজও আসে-যায়, থাকে। ওই তো কোণের টেবিলে আড্ডা বসিয়েছে নবীন-প্রবীণ। চোরাগোপ্তা নেশাচালান আজও চলছে। কফিহাউজ মরে না, আজও কোনও কোনও বন্ধুর বুকের ভিতর জ্বলে ধিমে আঁচের আগুন, কফিহাউজে দেখা হলেই বারুদচালান...।