ভালোবাসা প্রিজমের মতো, অন্যজনের অন্তরে আলো ফেলা যায়
Eternal Love: ভালোবাসা ও প্রেমের মধ্যে শুরু হয় একটি যৌন আধিপত্যের সম্পর্ক, যা একই সঙ্গে সামাজিক ও ব্যক্তিগত।
বছর দুয়েক আগের কথা। শ্রাবণমাসের সকাল, ঘোর বর্ষা (মোটামুটিভাবে অগাস্ট মাসের প্রথম হপ্তা)। বক্সার জঙ্গল লাগোয়া এক বনগ্রামে রয়েছি। গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নেপালি, রাভা ও আদিবাসী পরিবার। তাঁদের পরিচয় বনমজদুর। বসে আছি এক নেপালি দম্পতির বাড়ির হাতায়। সামনের রাস্তা পাকদণ্ডী হয়ে চলে গেছে রেললাইনের দিকে। ডানদিকে একটি সোঁতা। মাঠের শেষে চাষের জমি পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে চলে গেছে। বছরভর সেখানে তিরতিরিয়ে জল বয়। বামদিকে ধানক্ষেত জঙ্গলে মিশেছে। জঙ্গল ধাপে ধাপে উঠে গেছে বক্সা পাহাড়ের মাথায়। ধানক্ষেতের মধ্যে দু-একটি টিনের বসতঘর ও ক্ষেতের ফসল আগলানোর জন্য টং ঘর দেখা যায়। কিন্তু, যে সকালের কথা বলছি, সেই সকালে নিসর্গ প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সবুজের আস্তরণ বৃষ্টি ও মেঘের গায়ে লেপ্টে আছে। সময় সকাল ৬টা/৬.৩০টা হবে। জনমনিষ্যি নেই চারধারে। তুমুল বৃষ্টি হয়ে চলেছে। হাওয়া বইছে মাঠ-প্রান্তর-জঙ্গলের ওপর, হু হু করে। গরম নেই, ঠান্ডাও নেই। চারপাশে ভেজাভেজা শিরশিরে ভাব। হাতায় বসে খানিক ঝিমোচ্ছি। চোখ তখনও ঘুমে জড়িয়ে। হঠাৎ, বজ্রপাতে তন্দ্রা কেটে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল আমি যেন কারও অপেক্ষায় বসে আছি। বন-পাহাড়ের সবুজ ও বৃষ্টির ছাই ছাই জলে আবছা হয়ে থাকা পাকদণ্ডী দিয়ে কেউ আসছে। এক্ষুনি এসে পড়বে হাতায়। চারপাশের নিস্তব্ধতা ও নিসঃঙ্গতা ভেঙে ‘সে’ আসবে। ঠিক সেই মুহূর্তে মগজ ও হৃদয় জুড়ে ঝিলিক লেগে গেল। মনে হল, ধরে ফেলেছি একটি গান। যেন নিসর্গ জুড়ে গানটির সর্বাঙ্গ ফুটে উঠছে। মনে হলো, জেনে ফেলেছি সেই গোপন ‘গহন' যার ভেতর থেকে রবীন্দ্রনাথ তৈরি করলেন গানটিকে-
"আজি শ্রাবণঘনগহনমোহে গোপন তব চরণ ফেলে নিশার মতো নীরব ওহে সবার দিঠি এড়ায়ে এলে”
গৌড়-মল্লারের মেজাজ মিশে যাচ্ছে টানা বৃষ্টির শব্দে। জড়-জীব, মূর্ত-বিমূর্তের বিভেদ মুছে যাচ্ছে এক লহমায়। এই ‘পথিকহীন পথে' পথিক আসবে (হয়তো আসবে না)। তার আসার সম্ভাবনায় আকুল হয়ে উঠছি। তার জন্য ঘরের দুয়ার খোলা। আর এই দুয়ার খোলার কারণটি ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা ঘিরে রেখেছে মেঘ-বৃষ্টি, মাঠ-ক্ষেত, আমাকে ও তাঁকে। এই অপেক্ষা শেষ হবে না, শেষ হওয়ার নয়।
ভালোবাসা যদি একটি ফুলগাছ হয় তবে, তার শিকড়ে গাঁথা থাকে রবীন্দ্রনাথের শব্দ ও সুর। যেমন মার্ক্স না থাকলে বামপন্থা ও বামপন্থী রাজনীতির কী হতো জানা নেই, তেমনই, রবীন্দ্রনাথ না থাকলে আমাদের মতো বাঙালির কৈশোরে ভালোবাসার চেহারাটি কীভাবে তৈরি হতো, তাও জানা নেই। ওই মেঘ-বৃষ্টি, বন-পাহাড়ের মতো আবছা, ঘোরলাগা ভালোবাসার নিসর্গে ছায়ানট হয়ে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। বিষয়টি এখানেই সীমাবদ্ধ হলে ভালো হতো কিন্তু তা হয় না।
আরও পড়ুন-সাম্যের চৈতন্য, প্রেমের ম্যানিফেস্টো
ভালোবাসা একটি সামাজিক নির্মাণও বটে। আমরা একটি শ্রেণি-লিঙ্গ-বর্ণ-জাতি-ধর্মে বিভক্ত রাষ্ট্রে বসবাস করি। সেই সব বিভেদ ঢুকে থাকে ভালোবাসার নির্মাণে। পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতর, ভালোবাসার প্রকাশে ও যাপনে থাকে পৌরুষের আধিপত্য। সেখানেই গণ্ডগোল বাঁধে। বাস্তবের সঙ্গে মনের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়। তামাম দুনিয়ায় ভালোবাসার একটি একপদী, প্রাতিষ্ঠানিক সমাজ-স্বীকৃত ছক রয়েছে। সেখানে ভালোবাসার ধারণা মূলত নারী ও পুরুষের মিলন। তা থেকে পরিণয় এবং গার্হস্থ্য। সেই ছকের বাইরে ভালোবাসাকে দেখতে চাওয়া ধৃষ্টতা। আশ্চর্যজনকভাবে, সভ্যতা ও সমাজ কোনওদিনই এই ধৃষ্টতাকে আটকে রাখতে পারেনি।
ভালোবাসা ও প্রেমের মধ্যে শুরু হয় একটি যৌন আধিপত্যের সম্পর্ক, যা একই সঙ্গে সামাজিক ও ব্যক্তিগত। শরীর ও মনের (নারী, প্রান্তিক লিঙ্গ, কখনও পুরুষেরও) ওপর আধিপত্য, নিয়ন্ত্রণ ও অত্যাচার চলতেই থাকে। মজার বিষয়, আধিপত্যের ঘেরাটোপ যত জোরদার হয়, তত বেশি করে ভালোবাসা একটি প্রতিস্পর্ধা হয়ে ওঠে। ‘রক্তকরবী’-র কারাগারে বিশুর কাছে নন্দিনীর ভালোবাসা তেমনই একটি নিষিদ্ধ ইস্তেহার। ‘চণ্ডালিকা’-য় যখন প্রকৃতি, বৌদ্ধভিক্ষুকে পাওয়ার জন্য ছটফট করছে, মা তাকে বোঝাতে চায় যে, ভিক্ষুর প্রতি তার কামনা সমাজ বিরুদ্ধ। প্রকৃতি-র পরিচয় চণ্ডাল। উল্টে প্রকৃতি জানাচ্ছে, এই চাইতে পারা ও ভালোবাসার ভেতর কোনও ধর্মচ্যুতি নেই। সে বলছে —
“তাঁকেই মানি যিনি আমাকে মানেন। যে ধৰ্ম্ম অপমান করে সে ধৰ্ম্ম মিথ্যে। অন্ধ করে মুখ বন্ধ করে সবাই মিলে সেই ধৰ্ম্ম আমাকে মানিয়েছে। কিন্তু সেদিন থেকে এই ধৰ্ম্ম মানা আমার বারণ। কোনো ভয় আর নেই আমার”
গানে গানে চণ্ডালিনী বলে থাকতে,
“যে আমারে চিনতে পারে সেই চেনাতেই চিনি তারে, একই আলো চেনার পথে তার প্রাণে আর আমার প্রাণে”
ভালোবাসা একটি প্রিজমের মতো। যা দিয়ে অন্য আরেকটি মানুষের অন্তরে আলো ফেলা যায়, তাকে চিনে নেওয়া যায়। পদার্থজগতের হিসাব বলে, আলো কোথাও পড়লে তার প্রতিফলন ঘটবেই। আংশিক আলো উল্টোদিকেও আসে। সেই আলোতে পড়ে ফেলা যায় নিজেকে। ভালোবাসার ধর্মে জড়-অজড়, অপর-অন্তর সমস্ত ভেদ মুছে যায়।
প্রকৃতি-র কথা আসলে একটি রাজনৈতিক বয়ান। আজকের ভারতবর্ষে তার প্রাসঙ্গিকতা একটুও টাল খায়নি। একটি মেয়ে ও একটি ছেলে একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করলে (কোনও ক্ষেত্রে বিবাহ বহির্ভূত যৌনসম্পর্কে থাকলে), তা যদি অসবর্ণ বা দু'টি ভিন্ন ধর্মের ভেতর ঘটে, তখনই ‘লাভ জেহাদ’-এর তকমা জুড়ে দেওয়া হয়। জেহাদই বটে; যুদ্ধই তো। সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক ছক ভাঙার জেহাদ। উল্লেখ্য, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, এই জেহাদ শেষপর্যন্ত বৈবাহিক প্রাতিষ্ঠানিকতার ভেতর ঢুকে যায়। সেই আধিপত্যকামী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধাচরণ, বাকি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার অলক্ষ্যে থেকে যায়।
শ্রেণি-ধর্ম-জাতি-বর্ণ-লিঙ্গ বৈষম্যের বিরোধিতা কখনও আলাদা হতে পারে না। প্রতিটি বৈষম্যকে তার নিজ নিজ প্রেক্ষাপটে বোঝা উচিত। কিন্তু, বৈষম্য বিরোধী লড়াই একটাই হয়। বিভিন্ন সময়ে তার বিভিন্ন ধাপ পেরোতে থাকি। ভিতরে ও বাইরে বদলাতে থাকি। মজার বিষয়, লড়াইয়ের মধ্যেই ভালোবাসার প্রতিস্পর্ধী স্রোত চোরাপথে বইতে থাকে। কখনও-সখনও তা বেকায়দায় বেরিয়ে এলে ভালোবাসা নাশকতা হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন-বাঙালির প্রেম ও যৌন জীবন কীভাবে বদলে দিল বিলাতিয়া চুমু?
ভালোবাসার কথা বলতে গেলে মনে করতেই হয়, পাওলো ফ্রেয়রির (ব্রাজিলীয় শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক) কথা,
“ভালোবাসাই প্রকৃত সংহতি”
সমাজে প্রত্যেকটি মানুষের স্থানাঙ্ক লিঙ্গ-জাতি-ধর্ম-বর্ণের নিরিখে পৃথক। বেঁচে থাকার সংগ্রামে প্রত্যেকেই কখনও শোষিত আবার কোথাও সুবিধাভুক্ত। কিন্তু, আধিপত্যকামী, বিভেদকামী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সমস্ত লড়াইয়ে মানুষ একে অপরের সঙ্গে মিলে যান। সে ভালোবাসা আসমুদ্রহিমাচল ছেয়ে থাকে। সেখানে বহু মানুষ, বন্ধু-সাথী, নিসর্গ-প্রকৃতি, সৃষ্টি-অনুভূতি, চেতনা জড়া-মড়ি করে থাকে। কোনওকিছুই, কাউকেই আলাদা করা যায় না।
আজকের দিনে, ভারতবর্ষের মতো দেশে অথবা বলা ভালো, সারা পৃথিবী জুড়ে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও পুঁজির রমরমা। সংখ্যাগুরুর আস্ফালনে কোনও সামাজিক লজ্জাবোধ থাকে না। বরং দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে তা বৈধতা পায়। প্রান্তিক, শোষিত মানুষের, মূল স্রোতের উল্টো দিকে থাকা সমস্ত ‘অপর স্বর’-এর নিঃশ্বাস নেবার মতো জমিটুকু থাকে না। এমন দমবন্ধকর সময়েই, বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধির একটি বক্তব্য ভালোবাসার রাজনীতি বা রাজনৈতিক ভালোবাসাকে আরেকটু বিশদে বুঝতে সাহায্য করে (জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতি বা সার্বিক নির্বাচন রাজনীতির আলোচনা দূরে সরিয়ে রাখতে চাওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে কথাবার্তা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়)। গত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বে রাহুল বলেছিলেন,
“নফরত কি বাজার মে মহব্বত কি দুকান”
শব্দবন্ধটির তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ঘৃণার দুনিয়ায় ভালোবাসার ঘর। এই সময় ও পরিস্থিতিতে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা সমস্ত বিভেদকে কাজে লাগানো হচ্ছে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায়। একের পর এক দাঙ্গা, রাহাজানি, সামরিক যুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাস-ভূগোল-বাস্তুতন্ত্র পাল্টে ফেলছে। এই অবস্থায় ভোট রাজনীতির আঙিনায় প্রত্যক্ষভাবে ভালোবাসার কথা অন্য একটি রাজনৈতিক দর্শনকে তুলে ধরতে পারে, যার ভেতরে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজের ভাবনা নিহিত থাকে।
সমাজ-রাজনীতি-নির্বাচনের কাটাছেঁড়া বাদ দিয়ে আরেকটু ভালোবাসার কথা বলাবলি হোক। প্রথম যৌবনে ভেবেছিলাম ভালোবাসা, প্রেম, যৌনতা — সব একই বিষয়। তাই-ই হয়। তারপর ২০-২২ বছর বয়সে নানা ওঠা-পড়া সামলাতে সামলাতে, ভিতরে-বাইরে জলহাওয়া বদলে যায়। ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে ওঠে ভালোবাসা, প্রেম ও যৌনতার পার্থক্য এবং এই তিনের ভেতরকার চলমানতা বুঝে ফেলা যায়। আপাতত আমরা ভালোবাসা ও প্রেমকে একই পংক্তিতে রাখি। প্রেম শব্দটিকে উর্দুতে বলা হচ্ছে ‘ইশক’। সুফিমতে, ‘ইশক’ হলো ঈশ্বর বা আল্লাহ্-র প্রতি প্রেম। এই ইশকের মধ্যে দিয়ে আসলে এমন একটি আধ্যাত্মিক মিলন চাওয়া হয়, যেখানে যে চাইছে এবং যাকে চাইছে তাদের মিলন ঘটে। এ এক এমন মিলন যেখানে আমরা ‘ফানা’ হই( আমাদের আত্মার মৃত্যু ঘটে)। অর্থাৎ, আমাদের পৃথক আত্মা বা আত্মের নির্মাণ, চাওয়ার মধ্যে দিয়ে, বিনির্মাণের মধ্যে দিয়ে একটি যুগ্ম আত্ম বা আত্মা বা সত্তার নির্মাণ ঘটায়।
কিন্তু, প্রেম শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক বা মানসিক নয়, তা দৈহিকও। “A purely disembodied emotion is a nonentity,” এমন কথা বলেছিলেন উইলিয়াম জেমস, তাঁর বিখ্যাত তত্ত্বে। যেখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে আমাদের শরীর, মনকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ, আমাদের শরীর, মন ও চৈতন্যে ঢুকে পড়ার একটি ইন্সট্রুমেন্ট। এ শুধু কথার কথা নয়, নিছক তত্ত্ব নয়। স্নায়ুবিজ্ঞান প্রমাণ করে দেখিয়েছে, প্রতিটি শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ কীভাবে আমাদের আবেগ-অনুভূতি তৈরি করতে পারে, বদলে দিতে পারে। প্রেম বা ভালোবাসার অনুভূতিকে ছুঁয়ে ফেলতে চাইলে, একমাত্র ইন্সট্রুমেন্ট শরীর। অর্থাৎ, শারীরিক প্রেম। এখানেই যৌনতার সঙ্গে মিশে গেল মন। এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা রয়েছে দেহতত্ত্বে, বাউল-ফকির দর্শনে। দেহতত্ত্বে, নারী হলো পুরুষের সাধনসঙ্গী। সে নারীর সঙ্গ চায়, শরীর চায়। আধিপত্য নেই সেখানে। শুধু প্রেম ও মিলন। সেই সাধনায় ও মিলনে উভয়কেই চাই, কেউ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। সমস্ত শরীর ও মন দিয়ে নারী ও পুরুষ ভালোবাসার গম্ভীরায় অবগাহন করে। তা সত্ত্বেও, এটি মূলত পুরুষের সাধনার পথ। নারীর শরীরে আসা যাওয়ায় সে রতি ধারণ করতে শেখে, তাতেই পাওয়া যাবে সাধনার ফল। নারী সেখানে সঙ্গ দেয়, শরীর দেয়, রাঁধে-বাড়ে, জল তোলে, ঘর মোছে, গান গায়, নতুন প্রজন্মের জন্য গান তুলে রাখে। এখানেই বিস্ময় জাগে! সাধনসঙ্গী নারীকে তো আমরা জানি, কিন্তু তাঁর নিজস্ব সাধনার পথ থাকে কি সেখানে? থাকলে সেই পথ কেমন? তা কি আমরা ততটা জানি, যতটা জানি তাঁর সঙ্গিনী রূপটি?
খাওয়া-পরা সহ প্রাত্যহিক কাজ করতে পারায় কোনও গর্ব থাকে না। বেঁচে থাকার তাগিদেই তা করতে হয় এবং সেসব কাজ গুছিয়ে না করতে পারলেও কোনও লজ্জা নেই। অন্তত থাকা উচিত নয়। এই বিশ্বাস যদি আমরা করে থাকি, তাহলে কি আমরা নারীর একটি স্বকীয় সাধনার পথ খুঁজে দেখতে পারি না? সে পথে সঙ্গ থাক, শরীর থাক, শ্রম ভাগাভাগি করা হোক। ভালোবাসা থাকুক, সংহতিও। এ পথ ব্যতিক্রম হতে পারে — অসম্ভব কিছু নয়। পরখ না করলে সম্ভাবনার ঘনত্ব টের পাওয়া যায় না। অবশ্য এমন নিরীক্ষায় কেটে যেতে পারে একটি পরিপূর্ণ জীবন। প্রেম ও ভালোবাসা — চিরন্তন ভাঙা-গড়ার খেলা।
আরও পড়ুন- ঋতুপর্ণর চিত্রাঙ্গদা: ফেলে আসা প্রথম প্রেমের অবিচল চরণধ্বনি
যদি, একবার মন মজে যায় সেই খেলায়, ‘সেই গভীরের গোপন ভালোবাসায়’ তবে আর রক্ষে নেই। এত কথা, আলোচনা, চর্চা ফুৎকারে উড়ে যায়। তীব্র চাওয়ার কাছে তছনছ হয়ে যায় বাকি যা কিছু। সবটুকু জেনেও অপেক্ষা করে যাওয়া—
“আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।
আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে জন ভাসায়”
ফিরে যাই গোড়ার কথায়। ১৯০৯-এ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ‘আজি শ্রাবণঘনগহনমোহে’ গানটি। গানের একেবারে শেষ অংশে জানা যাচ্ছে, পথিকের অপেক্ষায় তাঁর দুয়ার খোলা। তিনি চাইছেন সেই পথিক যেন স্বপ্নের মতো তাঁকে অবহেলায় ফেলে রেখে চলে না যায়। ঠিক দু' বছর পরে ১৯১১ সালে, দেশ রাগে বাঁধছেন আরও একটি বর্ষার গান ‘উতল-ধারা বাদল ঝরে’। গানের মধ্যে তিনি বলছেন—
“উতল-ধারা বাদল ঝরে, দুয়ার খুলে এলে ঘরে।
চোখে আমার ঝলক লাগে, সকল মনে পুলক জাগে, চাহিতে চাই মুখের বাগে-- নয়ন মেলে কাঁপি ডরে”
তবে কি ‘সে’ এসেছিল কবির কাছে?
পাহাড়-বন-মাঠ পেরিয়ে, যদি ‘সে’ আসে? উত্তর জানা নেই। শুধু জানি, সময়ের টালমাটালে, ভীষণ ঝড়-বাদলে, দীর্ঘ অপেক্ষায় দুয়ার খুলে রাখতে হয়।