বছরে মারেন ৭০০০ ইঁদুর! কাটা লেজের বিনিময়ে জিতেছেন জাতীয় পুরস্কার! কে এই ইঁদুর আনোয়ার?

The rat catcher of Bangladesh: বছরে প্রায় ৫ থেকে ৭ হাজার ইঁদুর ধরেন আনোয়ার। আর সেই ইঁদুর ধরে মারার পরে তাদের লেজ কেটে কেটে রাখেন তিনি।

মাঠে মাঠে তাগড়াই মেঠো ইঁদুর ধরে বেড়ান। লেজ ধরে হিড়হিড় করে ইঁদুরদের টেনে বের করে আনেন গর্ত থেকে। লোকে ভালোবেসে ডাকে ইঁদুর আনোয়ার বলে। না ডাকার অবশ্য কারণও নেই। ৩০ বছর ধরে ইঁদুর পাকড়াও করেন মহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, লোকে যাকে চেনে ইঁদুর আনোয়ার বলেই। ইঁদুরই বদলে দিয়েছে সংসার, ইঁদুরই বদলে দিয়েছে সংসারের হালও। ইঁদুর ধরেই পুরস্কারও পেয়েছেন আনোয়ার। নিজের দল গড়েছেন। দলবল নিয়ে বাংলাদেশের মাঠেঘাটে ইঁদুর ধরেন তিনি।

তাঁর আর ইঁদুরের এই কাহিনি জানতে গেলে ছোটবেলার আনোয়ারকে জানতে হবে। মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াতেন কিশোর আনোয়ার। আর্থিক অবস্থা ভালো না, মাঠে গরু নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হতো। মাঠে গরুদের ছেড়ে দিয়ে ধান কুড়োতেন তাঁরা। সেই ধান দিয়েই বাড়িতে তৈরি হতো মুড়ি মোয়া। কিশোর আনোয়ারের সেই ছিল বিশাল আনন্দের জায়গা। ক্ষেতের কুড়ানো ধান দিয়ে তৈরি মোয়ার স্বাদই ছিল শৈশবের সেরা স্মৃতি। আর চাষের ক্ষেত মানেই ইঁদুরের বাস। সেই ইঁদুরের গর্ত থেকে একবার অনেকখানি ধান পেয়েছিলেন আনোয়ার। মাঠে গর্ত দেখেই বুঝেছিলেন এখানে ইঁদুরের বাস। আর ইঁদুররা ধান জমিয়ে রাখে গর্তে। যেমন ভাবা তেমন কাজ, কোদাল নিয়ে গিয়ে সেই গর্ত খুঁড়ে ইঁদুর ধরেন, ইঁদুরের জমানো ধানও সংগ্রহ করেন। সেই ধান দিয়ে প্রায় ৩/৪ দিন বাড়িতে মোয়া বানিয়ে খেয়েছিলেন তাঁরা।

আরও পড়ুন- বারাণসী থেকে এক ক্রুজেই বাংলাদেশ, যে ভ্রমণপথে তাকিয়ে সারাবিশ্ব

ব্যাস, নেশা চেপে যায় আনোয়ারের। ইঁদুর দেখলেই ধরেন, ধান বের করে আনেন। ঠিক বুঝে যান কোন গর্তে ইঁদুরের বাস, কোথা মিলবে ধান! তাঁর বাড়ির পাশেই থাকতেন এক কৃষি আধিকারিক। তিনি একবার জিজ্ঞেস করেন, আনোয়ার এই যে এত ইঁদুর ধরেন, ধরার পরে কী করেন? আনোয়ার তাঁকে জানান, ইঁদুর তো কোনও কাজে আসে না। তাই মেরে ফেলেন। ওই কৃষি আধিকারিক তাঁকে বারণ করেন। তিনি জানান, মেরে না ফেলে দিতে। বরং ইঁদুর মেরে তাদের লেজগুলো কেটে এনে ওই আধিকারিককে জমা দিতে। এই লেজের বদলে গম দেওয়া হবে আনোয়ারকে। বাংলাদেশের সরকারের নিয়ম অনুযায়ী ইঁদুর মারলে তাঁকে শস্য দেওয়া হবে। এক একটা ইঁদুরের ল্যাজে আধ কেজি করে গম! আনোয়ার সেই থেকে প্রতি এক সপ্তাহ পর পর ইঁদুরের লেজ কৃষি দফতরে গিয়ে জমা করে আসতেন। ছয় মাস বা এক বছরের শেষে এক মণ বা আধ মণ করে গম দিত সরকার, বাজেট অনুযায়ী। কিছুকাল অবশ্য গমের বদলে চালও দেওয়া হয়েছে। তারপর একদিন এই নিয়ম সরকার বন্ধই করে দেয়। এখন কৃষকদের কাছ থেকে টাকার বিনিময়েই ইঁদুর ধরে দেন আনোয়ার। অনেক কৃষক আবার টাকার বদলে কিলোখানেক চালও দিয়ে থাকেন আনোয়ারকে। ৩০ বছর ধরে ইঁদুর ধরার নেশাই আনোয়ারের পেশা হয়ে উঠেছে। ভালোবেসে এখনও ইঁদুর ধরেন তিনি।

আরও পড়ুন- বিশ্বে আর কোনও প্রাণীই ভালোবাসে না, একমাত্র কেন মানুষের পছন্দ ঝাল খাবার?

বছরে প্রায় ৫ থেকে ৭ হাজার ইঁদুর ধরেন আনোয়ার। আর সেই ইঁদুর ধরে মারার পরে তাদের লেজ কেটে কেটে রাখেন তিনি। বছরে যত লেজ জমা হয়, ওই মোটামুটি হাজার সাতেক ইঁদুরের লেজ জমা দেন কৃষি দফতরে। বদলে জোটে পুরস্কার। জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযানের আওতায় শংসাপত্রও পেয়েছেন তিনি, পেয়েছেন একাধিক স্মারক। ইঁদুর দমনে তাঁর ভূমিকার জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন আনোয়ার। বর্তমানে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর ও আশেপাশের উপজেলায় ইঁদুর মারেন আনোয়ার।

বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে ৬৭.৫ মেট্রিক টন আমন ধান নষ্ট করেছে ইঁদুর, ৪৩ মেট্রিক টন আলুর ক্ষতি হয়েছে, ৩ মেট্রিক টন গমের ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে এক বছরে এই ক্ষতির পরিমাণ ২,৯০,০০০ টাকা। বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০০০ কোটি টাকার শস্য, ফলমূল ও আসবাব ইঁদুরের কারণে নষ্ট হয়। সময়ে এই সব ইঁদুর না ধরা গেলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন চাষিরা। ফলে ডাক পড়ে আনোয়ারের। এসেই হাতেনাতে ধরে ফেলেন অপরাধী ইঁদুরদের। আনোয়ার এখন জমি দেখেই বুঝে যান কোথায় লুকিয়ে রয়েছে আসামী ইঁদুর। মাটির গন্ধ শুঁকেই বলে দেন গর্ত আসলে ইঁদুরের নাকি সাপের। ইঁদুরের মল মূত্র দেখেও বুঝে যান কোথায় বাসা বেঁধেছে। ইঁদুর ধরার জন্য নিজস্ব এক ফাঁদের ব্যবস্থাও করেছেন আনোয়ার। ইঁদুর ধরতে নিজের দলও গড়েছেন আনোয়ার। জানিয়েছেন, ৫৭ জন শিষ্য আছে তাঁর। বয়স হয়েছে, কবে আছেন, কবে নেই। কিন্তু নিজের এই ইঁদুর মারার কৌশল যেন হারিয়ে না যায় তাই দলের প্রত্যেককে শিখিয়ে দিয়েছেন কাজ। বাকিটা জীবন ইঁদুরের উপর গবেষণা করেই কাটাতে চান বাংলাদেশের ইঁদুর আনোয়ার।

 

তথ্যঋণ- বিবিসি বাংলাদেশ

More Articles