এ ভাষা বোঝে না সকলে, কেন রহস্যে মোড়া হিজড়েদের উল্টিভাষা?
Hijra Language Ulti Bhasha: হিজড়েদের এই গোপন ভাষাটি ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মুসলিম হিজড়েদের মধ্যে হিজড়া ফারসি এবং হিন্দু হিজড়েদের মধ্যে 'গুপ্তি ভাষা' বা 'উল্টি ভাষা' নামে পরিচিত।
ভাষা এমন কথা বলে, যা সকলে বোঝে। উঁচা, নীচা, ছোট বড়- সমান? এখানেই প্রশ্ন থেকে যায়। ভাষার কৌলীন্যে ‘ছোটলোকের’ ভাষা কি সকলকে সমমর্যাদা দেয়? সমস্ত শ্রেণির, সমস্ত বর্ণের ভাষা কি সেই মানুষদের সমান অধিকার, সমান গর্ব দেয়, বা সমান গ্রহণযোগ্যতা? প্রতি পরিবারে, প্রতি মানুষে মানুষে ভাষা পৃথক হয়ে যায়। অর্থাৎ কথাবার্তার লাখো দরজা, প্রতিটিই একক। কোনও ভাষা অত্যন্ত চড়া, কোনটা ততটাই নিঝুম। কোনও ভাষা জাহির করার, কোনওটা আবার নিজেকে আড়ালে রাখার, কোনও ভাষা সংগ্রামের, কোনওটা আত্মগোপনের। যে ভাষা লুকিয়ে থাকার, যে ভাষা আসলে সকলের কাছ থেকে গোপন রাখার, সেই ভাষার মধ্যে অন্যতম আলোচ্য ভাষা 'উল্টিভাষা'। যে ভাষাতে নিজেদের নানা গোপন কথাবার্তা সারেন হিজড়েরা। কেন নিজেদের ভাষাকে এমন আড়াল করার প্রয়োজন পড়ল? কেন নিজস্ব ভাষা ততটা স্বাধীন ও অবাধ হয়ে উঠল না রূপান্তরকামী মানুষদের?
সামান্য ইতিহাস চর্চা না করে এগনো অর্বাচীনতার কাজ। ভারতে হিজড়েদের অবস্থান কেমন ছিল তা জানতে ১৫ শতকে ঘুরে আসতে হবে, মানে মুঘল যুগে। বেগম আর সুলতানদের রক্ষাকর্তা হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন হিজড়েরা। মুঘল দরবারে এমন অনেক উপদেষ্টা ছিলেন যারা হিজড়ে। মনে করা হতো, এই হিজড়েদের বিশেষ এক অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে, যে কারণে হিজড়েদের আশীর্বাদ বিয়ে বা শিশুর জন্মের মতো শুভ অনুষ্ঠানে একেবারে অনিবার্য হয়ে উঠল। রাজকীয় পোশাক, ঘোড়াচালনা, অস্ত্রচালনা- সবটা মিলে আজকাল চারপাশে, ট্রাফিক সিগনালে, ট্রেনে যে হিজড়েদের দেখা যায় তাঁদের সঙ্গে কোনওভাবেই মেলানো যায় না মুঘল আমলের 'ট্রান্সজেন্ডার'দের। ভারতের দুই মহাকাব্য, রামায়ণ এবং মহাভারতেও হিজড়েদের কথা বলা আছে।
হিন্দুধর্মের প্রথম সারির দেবতা শিব, অর্ধনারীশ্বর হয়েছেন, অর্থাৎ একই অঙ্গে পুরুষ ও নারী। বিষ্ণু এবং লক্ষ্মী একত্রিত হয়ে বৈকুণ্ঠ-কমলাজা নামে পরিচিত হয়েছেন। অর্জুনের পুত্র আরাবনকে বিয়ে করার জন্য কৃষ্ণও মোহিনী হয়ে উঠেছেন। সুতরাং পুরাণ থেকে শুরু করে মুঘল দরবার অবধি, হিজড়েদের অবস্থান ছিল ভিন্ন যা একেবারেই বর্তমান ঘৃণা ও অবমাননার দৃষ্টির সঙ্গে যায় না। ব্রিটিশরা ভারতে আসার পর থেকে ক্রমেই সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করে এই মানুষরা। শিশুর জন্মের সময় মহিলা বা পুরুষ হিসাবে নিবন্ধন শুরু হয়, আর হিজড়েদের কোনওভাবেই কেবল মহিলা বা কেবল পুরুষ হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করাই যায় না।
আরও পড়ুন- রূপান্তরকামীদের আরাধ্য মোরগবাহন বহুচরা দেবী, অচেনার তালিকায় এক রহস্যময় সংযোজন
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হিজড়েরা পুরুষ হিসেবে বা আন্তঃলিঙ্গের সন্তান হিসেবে জন্ম নেন। অর্থাৎ শারীরিক এমন কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যা জৈবিক নিয়মে প্রচলিত নারী ও পুরুষদের থেকে আলাদা। ক্রমে বড় হতে হতে বাহ্যিক পুরুষ হিজড়েরা নারীদের মতো বেড়ে ওঠেন, চিন্তনে, আচরণে, পোশাকে ক্রমেই নারীর জীবন পেতে চান তাঁরা। এমনটা অত্যন্ত স্বাভাবিক, অথচ ভিনদেশি ব্রিটিশদের কাছে এসব 'নোংরামো' রক্ষণশীলতায় আটকায়। ব্রিটিশরা হিজড়ে সম্প্রদায়কে ক্রমেই একঘরে করতে থাকে, বৃহত্তর সমাজ থেকে ঠেলতে থাকে অন্ধকারে। ব্রিটিশরা একটি বিশেষ আইন (Criminal Tribes Act of 1871) তৈরি করে, যাতে হিজড়েদের কোনও কারণ ছাড়াই জেলে পোরা যায় এবং অপরাধমূলক কাজে প্রমাণ ছাড়াই অভিযুক্ত করা যায়। এই ধরপাকড় থেকে বাঁচতে সেই প্রথম ভারতে আত্মগোপন করে বসবাস করতে শুরু করেন হিজড়েরা। ব্রিটিশদের থেকে বাঁচতে এমন একটি ভাষার প্রয়োজন হলো যা কেবলমাত্র হিজড়েরাই বুঝতে পারবেন, এমন একটি ভাষা যা জেল, অত্যাচার এবং হিংসা থেকে এই গোষ্ঠীকে বাঁচাতে পারে।
হিজড়েদের এই গোপন ভাষাটি ভারতীয় উপমহাদেশের (ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ) মুসলিম হিজড়েদের মধ্যে হিজড়া ফারসি এবং হিন্দু হিজড়েদের মধ্যে 'গুপ্তি ভাষা' বা 'উল্টি ভাষা' নামে পরিচিত। এই ভাষাতে কেবল হিজড়েরাই কথা বলেন। পশ্চিমের নানা দেশেও ট্রান্স সম্প্রদায়ের মানুষের বিশেষ গোপন ভাষা ছিল। সেগুলি এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে কারণ সেই সম্প্রদায়ের মানুষের এই ভাষার প্রয়োজনই পড়ছে না। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায় সাংকেতিক ভাষায় কথা বলার দরকারও পড়ছে না। হিজড়া ফার্সি এবং আরবি ভাষার মধ্যে কিন্তু কোনও সংযোগ নেই। মুঘল যুগে হিজড়া ফার্সি ভাষার বিকাশ, তখন ফার্সি ভাষায় কথা বলা হত। তাই এটি হিজড়া ফার্সি নামেই পরিচিত হয়। হিজড়েরা হিজড়ে সম্প্রদায়ের অংশ হয়ে ওঠার পরেই একমাত্র গুরুর কাছ থেকে এই নতুন ভাষা শেখেন এবং সেই গুরুর শিষ্য হয়ে ওঠেন।
আরও পড়ুন- সমাজ থেকে সরকার, মুখ ফিরিয়ে নেয় সবাই! ‘হিজড়ে’-দের পুজোয় তবু সকলের নিমন্ত্রণ
গুরু এবং সম্প্রদায়ের অন্যান্য প্রবীণদের অনুকরণ করে, শুনে শুনে এই ভাষা শিখে যান তাঁরা। এই ভাষা এতটা গোপন রয়ে গেছে তার অন্যতম কারণ, এই ভাষায় কথা বলা মানুষ কম এবং যে উৎস থেকে হিজড়েরা এই ভাষা শেখে তা সম্প্রদায়ের মধ্যেই থেকে যায়। কিন্তু এই গোপন ভাষা জানা মানেই হিজড়েদের স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি হওয়া। যা বাহ্যিক সামাজিকতা, যা তাঁদের ব্রাত্য করে, তার থেকে পৃথক এবং নিরাপদ।
হিজড়েরা মনে করেন তাঁদের এই বিশেষ ভাষা তাঁদের পরিচয় প্রকাশের নিজস্ব ও স্বাভাবিক রীতি। দীর্ঘকাল ধরে সমাজে সুবিধাবঞ্চিত সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক সম্প্রদায় হয়ে থেকেছে হিজড়েরা। হিজড়েরা আর পাঁচজনের থেকে সহনাগরিকের মর্যাদা পান না, অধিকার পান না, অধিকার চাইতে যাওয়ার সাহসটুকুও পান না। ঘৃণা, অবহেলা আর অপমানের অসুস্থ আচরণে তাঁদের এই নিজস্ব ভাষাই তাঁদের হাতিয়ার, যা আত্মগোপনের নিরাপদ বাসা জোগায় এই ভরা সমাজে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই এই বিশেষ ভাষা হিজড়ে সম্প্রদায়কে আরও জুড়ে জুড়ে থাকতে শিখিয়েছে। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর, বন্ধুমহলে নিগৃহীত হওয়ার পর এই সাংকেতিক ভাষাই তাঁদের অন্য এক পরিবার, নিজস্ব এক সমাজ দিয়েছে, সেই সমাজে সংহতিও দিয়েছে।
হিজরা ফার্সি এবং গুপ্তি ভাষা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। আসলে এই উল্টিভাষা একটি সম্পূর্ণ ভাষা। মানে, শুধুমাত্র কিছু সাংকেতিক শব্দমালা নয়, পরিচিত কোনও ভাষা থেকে নেওয়া গোপন শব্দগুচ্ছ নয়, গুপ্তিভাষা বা হিজড়া ফার্সি এক আস্ত ভাষা যার নিজস্ব শব্দভাণ্ডার রয়েছে, নির্দিষ্ট ব্যাকরণ এবং বাক্য গঠন রীতি আছে, একটি ভাষার সমস্ত উপাদান- বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়াপদ সবটাই আছে। এমনকী সংখ্যার জন্যও নিজস্ব শব্দ আছে। মূলত মুদ্রার বিভিন্ন মূল্যের জন্য পৃথক শব্দ আছে, যেমন, দাসোলা মানে দশ, আধি ভাদভি হচ্ছে পঞ্চাশ, ভাদভি মানে একশো, পাঞ্জ ভাদভি মানে পাঁচশো ইত্যাদি।
হিজড়া ফার্সিতে ১০,০০০-এরও বেশি শব্দ রয়েছে, যার মধ্যে হিন্দি এবং উর্দুর মতো অন্যান্য ভাষা থেকে ধার করা কিছু শব্দও রয়েছে। এই ধার করা শব্দগুলি তৈরি হচ্ছে হিজড়েরা ভারতের কোন অঞ্চলের মানুষ তার উপর নির্ভর করে। মুম্বইয়ের হিজড়েরা হিন্দি, মারাঠি এবং উর্দু থেকে ধার করা শব্দ ব্যবহার করেন। করাচির হিজড়েরা উর্দু এবং পশতু থেকে শব্দ ধার নেন। তবে এই ভাষার কোনও লিখিত লিপি বা উপভাষা নেই।
হিজরা ফার্সি ভাষা এই সম্প্রদায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই ভাষা তাঁদের বেঁচে থাকতে শিখিয়েছে। একসঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকতে শিখিয়েছে। শুধু তাই নয়, কোণঠাসা মানুষ এই ভাষাতেই ক্ষমতায়নের গন্ধ খুঁজে পেয়েছেন। সাংকেতিক ভাষা হয়ে উঠেছে সবচেয়ে নিরাপদ যোগাযোগের ভাষা। হিজড়েদের বেঁচে থাকার নিজস্ব হাতিয়ার, গোপন অস্ত্র এবং বহু ক্ষতের বিশ্বাসযোগ্য মলমও। ভাষা এমন কথাও বলে যা সকলে বোঝে না, কিন্তু যারা বোঝেন তারা এ জন্মের মতো বেঁচে যান। বাঁচিয়ে নেন নিজেদের, যেমন নিয়েছেন ভারতের হিজড়েরা। বেঁচে থাক উল্টিভাষা- স্বতন্ত্র পরিচয়।
তথ্যঋণ-
https://scroll.in/article/1044233/international-mother-language-day-the-story-of-the-secret-language-of-hijras