শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গই ছিলেন শিক্ষাচিন্তক রবীন্দ্রনাথ
Rabindranath Tagore: রবীন্দ্রনাথের জীবনে বারবার যে শোকই কেবল আঘাত হেনেছে তাই নয়, তিনি আক্রান্ত হয়েছেন কুৎসার দ্বারা, কখনও-কখনও নিজেকে মনে করেছেন একাকী, নিঃসঙ্গ। এ-লেখা সেই রবীন্দ্রনাথকেই খানিক ছুঁয়ে থাকার চেষ্টা মাত্র
মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তিনি জড়িয়ে ধরছেন রবীন্দ্রনাথকে। সাহস পাচ্ছেন তাঁর কবিতা থেকে। কুড়ি বছরের এই তরুণের নাম ছিল দীনেশ গুপ্ত। শুধু দীনেশ গুপ্ত একা নন। সেই রুদ্র-সময়ে কত বিপ্লবীরই মানসিক দার্ঢ্যের অন্যতম আশ্রয় ছিল রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান। আজও কত মানুষকে জীবনের দিকে ফিরিয়ে আনে তাঁর রচনা। বহু মানুষের মানসিক শক্তি ও শান্তির আশ্রয় যে-কবি, সেই রবীন্দ্রনাথই কিন্তু আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন! আশ্চর্য মনে হলেও এ কথা সত্যি। ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯১৪, পুত্র রথীন্দ্রনাথকে ৫৩ বছরের রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “দিনরাত্রি মরবার কথা এবং মরবার ইচ্ছা আমাকে তাড়না করেছে”। মনে রাখা প্রয়োজন যে, ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি ঘটে গেছে। তবুও কবির মনে হচ্ছিল,
“মনে হয়েছে আমার দ্বারা কিছুই হয়নি এবং হবে না, আমার জীবনটা যেন আগাগোড়া ব্যর্থ; অন্যদের সকলের সম্বন্ধেই নৈরাশ্য এবং অনাস্থা।”
কেবল পুত্রকেই তিনি যে তাঁর এই অবসাদগ্রস্ত জীবনের কথা জানিয়েছিলেন, তা নয়। বন্ধু সি. এফ. অ্যান্ড্রুজকে লেখা চিঠিতেও এই ধরনের অবসাদের কথা আছে। অবসাদ আসলে অনেকটা প্রেমেরই মতন; কখন যে কাকে আক্রমণ করে, পেড়ে ফেলে তা আগে থেকে ঠিক সবসময় বোঝা যায় না।
আসলে, রবীন্দ্রনাথ বলতেই যে-ছবিটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সেই ছবিটা এক খণ্ডিত রবীন্দ্রনাথের। পূর্ণ রবীন্দ্রনাথ যেমন অনেকাংশেই একেবারেই সাধারণ মানব ছিলেন না, তেমন আবার বহুলাংশেই ছিলেন একেবারেই আমাদের রাম-শ্যাম-যদু-মধুর মতো এক কবি। সত্যি বলতে কী, রবীন্দ্রনাথের জীবনে বারবার যে শোকই কেবল আঘাত হেনেছে তাই নয়, তিনি আক্রান্ত হয়েছেন কুৎসার দ্বারা, কখনও-কখনও নিজেকে মনে করেছেন একাকী, নিঃসঙ্গ। এ-লেখা সেই রবীন্দ্রনাথকেই খানিক ছুঁয়ে থাকার চেষ্টা মাত্র।
আরও পড়ুন- বিমলাকে ‘শিক্ষা’ দিলেন না নিখিলেশ, পদাবলির বিরহকে ঘরে-বাইরে মিশিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ
আজ যদি রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতেন তাহলে রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে নেটিজেনদের ট্রোলের প্রধান লক্ষ্য যে হতেন তিনি, সে বিষয়ে নিশংসয় হওয়া যেতে পারে। জীবদ্দশায়ও রবীন্দ্রনাথকে কম কুৎসার মুখোমুখি হতে হয়নি। সহ্য করতে হয়নি কম আক্রমণ। দু'টি ঘটনার কথা বলা যাক। ১২৯৫ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের “কড়ি ও কোমল” কবিতা সংকলনটি প্রকাশ পেয়েছিল। সেই সময়ের নিরিখে যথেষ্ট এগিয়ে থাকা এই কাব্যগ্রন্থটির জন্য রবীন্দ্রনাথকে কম নিন্দেমন্দর মুখোমুখি হতে হয়নি। ওই বছরই ‘রবিরাহু’ ছদ্মনাম ব্যবহার করে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ “মিঠেকড়া” শীর্ষক পুস্তিকায় “কড়ি ও কোমল”-এর কবিতাগুলিকে কটাক্ষ করে ছড়া লিখেছিলেন। পুস্তিকাটির আখ্যাপত্রে তিনি লিখেছিলেন, “ইহা কড়িও নহে, কোমলও নহে, পুরো সুর মিঠে কড়া”। ভূমিকায় লিখেছিলেন,
“যদিও ইহাতে রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘কড়ি ও কোমলের’ ন্যায় ‘স্তন’ নং ১, ‘স্তন’ নং ২, ‘চুম্বন’, ‘বিবসনা’ প্রভৃতি সুরুচি সঙ্গত কবিতা লিখি নাই, তথাপি তদ্রূপ ঈশ্বর প্রেমাত্মক এক আধটি কবিতার অভাব হইবে না। মন্দ লোকের মন্দ ভাব–আমার মনে পাপের লেশমাত্র নাই”।
কেমন কটাক্ষ করেছিলেন কালীপ্রসন্ন? “কড়ি ও কোমল'” কবিতা-সংকলনের 'পত্র' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
“চোখের আড়াল প্রাণের আড়াল
কেমন তরো ঢঙ এ গো!
তোমার প্রাণ যে পাষাণ-সম
জানি সেটা long-ago”
একইভাবে 'চিঠি' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
“ধার করা নাম নেব আমি
হবে না তো সিটি।
জানই আমার সকল কাজে
originality”।
সেই সময় কবিতার ভেতরে এইভাবে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ এই ইংরেজি শব্দ ব্যবহারকে ভালো চোখে নেননি। ‘পত্র’ ও ‘চিঠি’ কবিতায় ব্যবহৃত 'long-ago' এবং 'originality' শব্দ দু'টিকে কটাক্ষ করে রবিরাহু তাঁর ‘গ্রন্থসূচনা'-র একস্থানে লিখলেন:
“মাঝেতে ইংরাজী কথা
(জানা আছে যতদূর)
ঢুকায়ে করিব সুখে
বঙ্গ ভাষা দর্পচুর
গড়িব নূতন শব্দ
ব্যাকারণ ‘গো টু হেল'
অই শুন ইংরাজী
ভারতী' বা হয় 'ফেল'”।
তবে “কড়ি ও কোমল” নিয়ে আরও ভয়ংকর আক্রমণটি এসেছিল নিত্যকৃষ্ণ বসুর কাছ থেকে। তাঁর লেখা পড়ে বোঝা যায়, তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের নিবিষ্ট পাঠক। কিন্তু দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সম্পাদিত ১৩০০ বঙ্গাব্দের ‘নব্যভারত' পত্রিকার ভাদ্র সংখ্যায় “চতুর্দশী কবিতা” শিরোনামে “কড়ি ও কোমল”-এর সনেটগুলিকে আক্রমণ করে তিনি যা লিখেছিলেন, তা শেষ পর্যন্ত সাহিত্য সমালোচনার পরিবর্তে ব্যক্তি আক্রমণে রূপান্তরিত হয়েছিল। তিনি লিখেছিলেন,
“রবীন্দ্রবাবুর অধিকাংশ কবিতার যা দোষ, আমাদের মতে, তাহা তাঁহার সনেটও স্পর্শ করিয়াছে। দুই চারিটিকে ছাড়িয়া দিলে বাকিগুলি কেবল — Ingenious conceits and maudlin sentiments.”
সনেটগুলিতে “ভাবের গাম্ভীর্য নাই” ও “ভাষার তেজ নাই” বলেও তিনি মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু এরপর তিনি যা লিখেছিলেন তা কল্পনাতীত। নিত্যকৃষ্ণ বসু লিখেছিলেন,
“কিন্তু যিনি মানবের সুখ-দুঃখের সঙ্গীত গাঁথিয়া ‘অমর আলয়’ রচনা করিতে চান, যুবতীর “স্তনের ছায়ায়” শয়ন করিয়া কেবল ‘অঞ্চলের বাতাস' সেবন করিলে তাহার চলিবে না”।
বলা বাহুল্য, সনেটগুলির একটির অপব্যাখ্যা করেই এই ব্যক্তিআক্রমণ করেছিলেন নিত্যকৃষ্ণ বসু। এই লেখার কোনও প্রত্যুত্তর রবীন্দ্রনাথ দেননি ঠিক, কিন্তু সুরেশচন্দ্র সমাজপতি তাঁর হয়ে ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় নিত্যকৃষ্ণ বসুর এই কদর্য ব্যক্তিআক্রমণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিশেষ করে যে-সনেটটি (‘হৃদয় আসন’) ছিল নিত্যকৃষ্ণ বসুর আক্রমণের লক্ষ্য, তার গুণগান করেছিলেন।
আরও পড়ুন- ক্রমে জমি জালিয়াতিতে ডুবে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের সাধের শান্তিনিকেতন
ব্যক্তিআক্রমণ রবীন্দ্রনাথকে যে সহ্য করতে হতো, মাঝে মাঝে তার কারণ হয়ে উঠতেন তিনি নিজেও। যেমন ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের “চৈতালী” কবিতা সংকলনটির বিরুদ্ধ-সমালোচনা করে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ। পরে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় “দাসী” পত্রিকায়। এর কিছুদিন পরে ওই হলেই একই সভাপতির সভাপতিত্বে “গান্ধারীর আবেদন” নাটকটি পাঠ করার আগে রবীন্দ্রনাথ হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের ওই ভাষণটিকে কটাক্ষ করে কয়েকটি কথা বলেছিলেন। এ থেকে বোঝাই যায় যে, সবসময় বিরুদ্ধ-সমালোচনা রবীন্দ্রনাথ যে শান্ত চিত্তে গ্রহণ করতে পারতেন, তা নয়। এই সমালোচনার ফল হয়েছিল মারাত্মক। প্রায় দেড় বছরের মাথায় ১৩০৬ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যার ‘সাহিত্য' পত্রিকায় হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ "প্রণয়ের পরিণাম" নামে প্রায় গল্পের ঢঙে একটি লেখা লেখেন যেখানে শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, সমস্ত ঠাকুরবাড়িই হয়ে ওঠে তাঁর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের লেখাটি ছিল এই রকম:
“আমি বড়ঘরের ছোট ছেলে, বিশেষ অল্প বয়সে মাতৃহীন। কাজেই সকলের বড় আদরের পাত্র। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে ব্যবসায়ে লিপ্ত থাকিয়া অনেক বাঙালী অর্থ সংগ্রহ করিয়াছিলেন। অল্পদিনে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করিতে দেখিয়া লোকে তাঁহাদিগকে আঙুল ফুলিয়া কলাগাছ বলিত। আমার পিতামহ তাঁহাদিগের একজন। তাঁহার অর্থ সদুপায়ে সংগৃহীত হইয়াছিল কি না, সে বিচারে প্রবৃত্ত হওয়া আমার পক্ষে অসঙ্গত। আমি সে বিচারে প্রবৃত্ত হইব না। পিতামহ যে পরিমাণ সম্পত্তি করিয়াছিলেন, যে পরিমাণ বিলাসবহুল জীবন যাপন করিতেন, তাহাতে তাঁহার পক্ষে একটা রাজা বা মহারাজা খেতাব ক্রয় করা আদৌ কষ্ট সাধ্য হইত না। বিশেষতঃ বহু ইংরাজ পুরুষ তাঁহার বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। কিন্তু আমার পিতামহ দেশীয় খেতাব ক্রয় করেন নাই। তাঁহার আরো বড় একটা সম্মান লাভের আশা ছিল। ইংলন্ডে অকালে তাঁহার মৃত্যু হওয়ায় সে সম্মান লাভ করা তাঁহার ভাগ্যে ঘটিয়া ওঠে নাই। তাই আমরা 'মহারাজা', 'রাজা', ‘কুমার' নহি – কেবল 'বাবু'। ইহাতে আমাদিগের একটা বিশেষ সুবিধা হইয়াছে। সময়মত লাটসাহেবকে ভোজ দিয়া আপনাদিগের আভিজাত্যের গর্বও করা চলে, আবার সুবিধামত রাজনৈতিক বৈঠকে বক্তৃতা করিয়া সাধারণের করতালি লাভ করাও অসম্ভব হয় না। আমাদের উদরান্নের কোন চিন্তা নাই। পিতামহের মৃত্যু হইলেও আমাদের জমিদারির অবসান হয় নাই। উদরান্নের ভাবনা ছিল না বলিয়াই বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত আমাদিগের অত্যন্ত বিরোধ ছিল। লোকে যেমন সখ করিয়া পায়রা পোষে, মাছ ধরে, ঘোড়ায় চড়ে, নাচগান দেখিতে যায়, তেমনি আমরাও সখ করিয়া কেহ চিত্রশিল্পী, কেহ কবি, কেহ নাট্যকার, কেহ দার্শনিক। কেবল আমার মেজদাদা উচ্চশিক্ষা লাভ করিয়া বিদেশের পরীক্ষায় সফল হইয়া এদেশের শাসন ও বিচার বিভাগে প্রবেশ করিয়াছিলেন। তিনি পুণায় উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত ছিলেন”।
এই কদর্য আক্রমণের উত্তর দিয়েছিলেন গল্পকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় “একটি কুক্কুরের প্রতিশোধ” শিরোনামে একটি সনেট লিখে। সেই সনেটে তিনি লিখেছিলেন:
“এতদিনে কুক্কুর কি হইল পাগল?
ভাসিছে নবীন রবি নভঃ উজলিয়া
তাহে কেন কুক্কুরের পরাণ বিকল?”
বলা বাহুল্য, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের এহেন আক্রমণকে রবীন্দ্রনাথ ভালো চোখে দেখেননি। প্রিয়নাথ সেনকে একটি চিঠি লিখে তিনি ওই কুৎসিত গল্পটির প্রসঙ্গে যদি প্রিয়নাথের কোনও ‘বন্ধুকৃত্য’ করার থাকে, তা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রিয়নাথ সেন হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের “প্রণয়ের পরিণাম” গল্পটির একটি প্রতিবাদ লিখে রবীন্দ্রনাথের অনুমোদনের জন্য পাণ্ডুলিপিটি তাঁর কাছে পাঠালে একটি চিঠিতে প্রিয়নাথ সেনকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
“ভাই,
তুমি ‘সাহিত্য’ সম্পাদকের উদ্দেশে যে পত্রখানি রচনা করিয়াছ – আমি তাহার সম্বন্ধে আর কি বলিব! তুমি তোমার অন্তরের আক্ষেপ যেরূপ আবেগের সহিত ব্যক্ত করিয়াছ; তাহার মধ্যে বন্ধুবাৎসল্য ও কর্তব্যবোধ দুই-ই ব্যথিতভাবে প্রকাশ পাইয়াছে। সেই উদার বন্ধু-প্রীতিটি আমি আমার অংশ বলিয়া প্রেমানন্দের সহিত গ্রহণ করিলাম। বাকিটা ‘সাহিত্য' সম্পাদকের হস্তে এবং সেই সূত্রে সাধারণের সম্মুখে উপস্থিত করা সঙ্গত হইতেছে কি না বিচার্য। অবশ্য প্রাইভেটভাবে সম্পাদক সুরেশবাবুর নিকট গেলে ক্ষতি দেখি না, কিন্তু ইহা লইয়া কাগজ-পত্রে বিচার বিতর্ক উপস্থাপিত করিতে কিছুতেই প্রবৃত্তি হয় না। এই সকল কথার প্রকাশ্য আলোচনায় এমন একটি অসম্ভ্রম আছে যে, তাহা সহ্য করিতে নিতান্ত সংকোচ বোধহয়।
ও দূর করিয়া দাও, যেমন করিয়া মাছি তাড়াইয়া দিতে হয়, তেমন করিয়া বাম হস্তের আঘাতে মন হইতে ওটাকে অপসৃত করিয়া দিলেই ঠিক হয়”।
বোঝাই যাচ্ছে যে, প্রাথমিকভাবে প্রিয়নাথকে বন্ধুকৃত্য করার অনুরোধ করলেও শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ কাদা ছোড়াছুড়ির ঘৃণ্যতাকে অতিক্রম করে যেতে পেরেছিলেন। ঠিক যেভাবে আত্মহত্যা প্রবণতাকেও তিনি শেষ পর্যন্ত অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। যে-চিঠিতে রথীন্দ্রনাথকে অবসাদের কথা তিনি লিখেছিলেন, সেই একই চিঠিতে তিনি এও লিখেছিলেন,
“...কিছুদিন সুরুলের ছাতে শান্ত হয়ে বসে আবার আমার চিরন্তন স্বভাবকে ফিরে পাব সন্দেহ নেই— মৃত্যুর যে গুহার দিকে নেবে যাচ্ছিলুম তার থেকে আবার আলোকে উঠে আসব কোনো সন্দেহ নেই।”
এভাবেই আক্রান্ত, নিঃসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ আক্রমণ এবং নিঃসঙ্গতাকে বারবার অতিক্রম করে গিয়েছেন। শুধু একটি ক্ষেত্রে মনে হয় এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতাবোধ তাঁকে শেষ পর্যন্ত গ্রাস করেছিল যা থেকে আর উত্তরণের পথ তিনি খুঁজে পাননি। এই নিঃসঙ্গতার অনুভূতি ছিল তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় বিশ্বভারতীকে নিয়েই। জীবদ্দশাতেই শান্তিনিকেতনে যে-সমস্ত পরিবর্তন তিনি চাক্ষুষ করেছিলেন, সেসব পরিবর্তন তাঁকে একেবারেই খুশি করতে পারেনি। যে-বিশ্বভারতী তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, জীবনের শেষ বেলায় তিনি বুঝে ছিলেন যে আদর্শগতভাবে সেই বিশ্বভারতীতেই তিনি হয়ে গেছেন নিঃসঙ্গ। ১৩৪২ বঙ্গাব্দের ৮ পৌষ শান্তিনিকেতনে প্রদত্ত একটি ভাষণে তিনি বলেছিলেন,
“আমার কবিপ্রকৃতি বলেই হয়তো, কনস্টিট্যুশন, নিয়মের কাঠামো— যাতে প্রাণ- ধর্মের চেয়ে কৃত্রিম উপায়ের উপর বেশি জোর, তা আমি বুঝতে পারি নে; সৃষ্টির কার্যে এটা বাধা দেয় বলেই আমার মনে হয়। যাই হোক, কনস্টিট্যুশনে নির্ভর রেখে আমি এর মধ্য থেকে অবকাশ নিয়েছি, কিন্তু এ কথা তো ভুলতে পারি নে যে, এ বিদ্যালয়ের কোনো বিশেষত্ব যদি অবশিষ্ট না থাকে তবে নিজেকে বঞ্চিত করা হয়। সাধ্যের বেশি অনেক আমাকে এর জন্য দিতে হয়েছে, কেউ সে কথা জানে না— কত দুঃসহ কষ্ট আমাকে স্বীকার করতে হয়েছে। অত্যন্ত দুঃখে যাকে গড়ে তুলতে হয়েছে সে যদি এমন হয় যা আরও ঢের আছে, অর্থাৎ তার সার্থকতার মানদণ্ড যদি সাধারণের অনগত হয়, তবে কী দরকার ছিল এমন সমূহ ক্ষতি স্বীকার করবার? বিদ্যালয় যদি একটা হাই-ইস্কুলে মাত্র পর্যবসিত হয় তবে বলতে হবে ঠকলাম। আমার সঙ্গে যাঁরা এখানে শিক্ষকতা আরম্ভ করেছিলেন, এখানকার আদর্শের মধ্যে যাঁরা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছিলেন, তাঁদের অনেকেই আজ পরলোকে। পরবর্তী যাঁরা এখন এসেছেন তাঁদের শিক্ষকতার আদর্শ, দূর থেকে ছাত্রদের পরিচালনা করা, এটা আমার সময় ছিল না। এরকম করে দূরত্ব রেখে অন্তঃকরণকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব হয় না। এতে হয়তো খুব দক্ষ পরিচালনা হতে পারে কিন্তু তার চেয়ে বড়ো জিনিসের অভাব ঘটতে থাকে। এখন অনেক ছাত্র, অনেক বিভাগ হয়েছে, সকলই বিচ্ছিন্ন অবস্থায় চলছে। কর্মী সমগ্র অনুষ্ঠানটিকে চিন্তার ক্ষেত্রে সেবার ক্ষেত্রে এক করে দেখতে পাচ্ছেন না–বিচ্ছেদ জন্মাচ্ছে”।
তলিয়ে ভাবলে মনে হয়, শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষাচিন্তক রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গই ছিলেন। আজও তাই আছেন। তাঁর দেখানো পথে শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা হাঁটিনি।
গ্রন্থঋণ
বিজন ঘোষালের ক্রুশবিদ্ধ রবীন্দ্রনাথ
কৃষ্ণা দত্ত ও অ্যান্ড্রু রবিনসনের দ্য মিরিয়াডমাইন্ডেড ম্যান