গোটা গ্রামটাই যেন ক্যানভাস, রং তুলির আঁচড়ে রোজ যেভাবে সেজে ওঠে খোয়াব গাঁ

Story of khwab gaon : সপ্তাহান্তের ছুটিতে কলকাতার আশেপাশে অল্প খরচের মধ্যে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করছেন? ঘুরে আসতে পারেন লোধা-শবর-কুড়মিদের 'খোয়াব গাঁ'

খাতা অথবা সাদা কাগজ নয় গোটা একটা গ্রাম যেন আস্ত ক্যানভাস, আর তাতেই বিভিন্ন সব রঙের চলাচলে স্বপ্নের মতো সেজে উঠেছে জায়গাটি। ঝাড়গ্রাম থেকে মাত্র চার কিলোমিটার পথ। গ্রামের নাম লালাবাজার। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির মাটি লেপা দেওয়ালে বিভিন্ন রঙের মিশেলে গড়ে উঠেছে একের পর এক ছবি। প্রকৃতির সঙ্গে নিখাদ বন্ধুত্ব করতে চাইলে লাল মাটির মেঠো পথের উদ্দেশ্যে রওনা হতে পারেন আপনিও। ঝাড়গ্রামের মধ্যেই এক টুকরো রূপকথার রাজ্য রচনা করেছে এই লালবাজার গ্রামটি। যদিও বর্তমানে এই গ্রামটিকে সকলে চেনেন ‘খোয়াব গাঁ’ নামেই। কিন্তু একটা সাদামাটা গ্রাম থেকে আজকের এই রঙিন ‘খোয়াব গাঁ’ হয়ে ওঠার জার্নিটা শুরু হল কীভাবে? কেই বা তাকে সাজালো এমনভাবে? এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে তাকাতে হবে একটা গল্পের দিকে।

মাটিলেপা দেওয়াল, খড় টালির ছাউনি, তার মধ্যেই এক চিলতে সংসার যাপন এই ছিল ঝাড়গ্রামের লালবাজার গ্রামের লোধা শবরদের রোজনামচা। তারপর হঠাৎই যেন একদিন জাদু কাঠির ছোঁয়ায় সবটা বদলে যেতে শুরু করল। মাছ ধরে আর কাজুবাদাম সংগ্রহ করে অথবা কাঠ পাতা কুড়িয়ে এতদিন সংসার চালাত লোধা শবরদের ১৩টি পরিবার। অতঃপর চালচিত্র অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক চিত্রশিল্পী মৃণাল মণ্ডল এবং তাঁরা শিল্পী সহকারী টিমের সহায়তায় একদিন এই গ্রামের প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালে শুরু হল রং তুলি দিয়ে ছবি আঁকা। অল্প দিনের মধ্যে রূপ বদলে গেল লাল মাটির গ্রামটির। একটা গ্রাম ধীরে ধীরে হয়ে উঠল ‘ওপেন স্টুডিয়ো’। শিশুরা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হতে তুলে নিতে শুরু করল রং তুলি। মাটি লেপা দেওয়ালে কাঁচা পাকা হাতের ছোঁয়ায় ছবির পর ছবি তৈরি হল। কোথাও দেওয়ালে দেওয়ালে গল্প বলা হল পুরাণের কোনও লোককথার, কোথাও আবার রং তুলির আঁচড়ে সেজে উঠল নতুন গল্প। এখানেই শেষ নয়, হাতের কাজের দক্ষতা দেওয়ালের আঁকা ছড়িয়ে এখন ছড়িয়ে পড়েছে নিত্যতনতুন জিনিস তৈরিতেও। কচিকাঁচাদের হাতেই সেজে উঠছে বাঁশ-কাঠের তৈরি ময়ূর, গণেশের মুখ, কাঁকড়া বিছের পসরা।

ঘিঞ্জি দীঘা, পুরী অথবা দার্জিলিং এর প্রতি আকর্ষণ ক্রমেই কমছে, তার ওপর ব্যস্ত জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছুটি বলতে সপ্তাহান্তের ওই সময়টুকুই। তাতে খুব বেশি দূরে ঘুরতে যাওয়াও সম্ভব হয় না কারোরই। তাই বাঙালি এখন ঝুঁকছে অফবিট ভ্রমণের দিকেই। কাছেপিঠে কোনও নিরিবিলি পরিবেশে একান্তে সময় কাটানোর জন্য দারুণ বিকল্প হতে পারে লালমাটির এই খোয়াব গাঁ।

আরও পড়ুন - দুই বাংলার স্রোত মেশে এখানে, একদিনের ছুটিতে ঘুরে আসুন এই ‘মিনি সুন্দরবন’ থেকে

তথাকথিত পিছিয়ে পড়া আদিবাসীদের পরিবার নিয়ে এই গ্রামে কাজ শুরু হয় ২০১৮ সাল থেকে। পশ্চিমবঙ্গ চালচিত্র একাডেমির দায়িত্বে থাকা মৃণাল মন্ডল এবং তাঁর সহকারীরা প্রথম দিকে এই সব ছবি আঁকলেও সময়ের সঙ্গে লোধা শবরদের সন্তানরাই এই শিল্পের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে বর্তমানে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে এই গ্রামটি। আশেপাশের জেলা বা রাজ্য থেকে তো বটেই এমনকী বাইরের দেশ থেকেও পর্যটকদের ভিড় হয় এই গ্রামে। রং তুলির কাজের টানে বহু মানুষ জড়ো হন লাল মেঠো খোয়াব গাঁয়ে।

জঙ্গলের গাছ কেটে জীবিকা নির্বাহ করত যারা তাদের হাতে রং তুলি তুলে দেওয়ার কাজটা মোটেই খুব সহজ ছিল না। প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল না বেশিরভাগ জনই, তাই প্রাথমিকভাবে জীবিকা নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা তো ছিলই, যদিও সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন আসে। পর্যটকদের আগমনে চাঙ্গা হয়ে ওঠে গ্রামীণ অর্থনীতি। ফলে এখন গোটা গ্রাম জুড়েই এই কাজকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। খোয়াব গাঁতে ইতিমধ্যেই নানান কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। ললিতকলা অ্যাকাডেমি এবং চালচিত্র অ্যাকাডেমির তরফে বারবার নানান অনুষ্ঠানে সেজে উঠেছে এই অঞ্চল। পটচিত্র, আলপনা ও হাতের কাজের বিভিন্ন পসরা সবই ছিল সেখানে যার মধ্যে বেশিরভাগটাই এই অঞ্চলের শিশুদের হাতে তৈরি। তাই ছবি আর প্রকৃতি যদি একযোগে আপনাকে আকর্ষণ করে তাহলে ঘুরে আসতেই পারেন ঝাড়গ্রামের খোয়াব গাঁ থেকে।

 

More Articles