ভদ্রবিত্তের কাছে 'তুচ্ছ' বলেই হকারদের কথা আজও ভাবে না প্রশাসন?

Kolkata Hawker Struggle: গড়িয়াহাটের পথহকারের সংগ্রাম, 'হে-মার্কেট' চত্বরের শ্রমিক জমায়েতের তুলনায় কম আলোচ্য সংগ্রাম হিসেবেই থেকে গিয়েছে।

প্রতিটি ঐতিহাসিক বাঁকবদলের মতোই, মে-দিবস, আজ যা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়, তা ঘটেছিল সম্পূর্ণ 'দুর্ঘটনা'-ক্রমে। ১৯২৯ সালের টাইমস পত্রিকা লিখেছিল, "পুরাতন ধাঁচের মানুষের কাছে মে মাসের প্রথম দিন মানে ফুল, ঘাস, পিকনিক, শিশুদের দল আর পরিচ্ছন্ন পোশাক। কর্মঠ সমাজতন্ত্রী এবং কমিউনিস্টদের কাছে এই দিনটির দ্যোতক হলো বক্তৃতা, কুচকাওয়াজ, বোমা, ইঁট, পাটকেল, বিবেকবান সহিংসতা। এই নতুন 'অর্থ' ১৮৮৬ সালের মে দিবস থেকে এসেছে, যখন প্রায় ২,০০,০০০ মার্কিন শ্রমিক আট ঘণ্টা কর্মদিবসের জন্য দেশব্যাপী ধর্মঘট পরিচালনা করেছিলেন।"

১৮৮৬ সালের ১ মে-র শ্রমিক আন্দোলন কেবল কোনও সাধারণ ধর্মঘট ছিল না। এটি ছিল হে-মার্কেট অঞ্চলের দুর্ঘটনা। সেই বছরের ১ মে শিকাগো (অন্যান্য শহরগুলির সঙ্গে) শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কর্মদিবসের সমর্থনে একটি বড় ইউনিয়ন বিক্ষোভের স্থান ছিল। শিকাগোতে হওয়া বিক্ষোভগুলির বেশ কয়েকটি দিনের কর্মদিবসের অংশ হওয়ার কথা ছিল। ৩ মে, শহরের ম্যাককরমিক রিপার প্ল্যান্টে ধর্মঘট সহিংস হয়ে ওঠে; পরের দিন, হে-মার্কেট স্কোয়ারের একটি শান্তিপূর্ণ সভা আরও জোরালো বিক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ১৮৮৬ সালের ৪ মে রাত দশটার কয়েক মিনিট পরে, শিকাগোতে শ্রমজীবীদের পদচারণায় 'ঝড়' শুরু হয়। বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে, প্যাকিং হাউস জেলার হে-মার্কেট স্কোয়ারে জনতার জোয়ারের ঢেউ ভেঙে পড়তে শুরু করে। শহরের মেয়র, যিনি ঝামেলার আশায় অপেক্ষা করেছিলেন, বাড়িতে ঘুমাতে চলে যান। জমায়েতের শেষ বক্তা যখন তাঁর বক্তৃতা শেষ করছিলেন, ঠিক তখনই ১৮০ জন পুলিশের একটি প্রতিনিধিদল স্টেশন থেকে মিছিল করে সভার অবশিষ্ট অংশ ভেঙে ফেলতে এগিয়ে আসে। তারা স্পিকারের গাড়ি থেকে কিছু দূরে থামেন। একজন ক্যাপ্টেন যখন সভা ছত্রভঙ্গ করার নির্দেশ দেন এবং বক্তা চিৎকার করে বলেন যে এটি একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, তখন পুলিশ র‍্যাঙ্কে একটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ৬৭ জন পুলিশ আহত হন, যার মধ্যে সাতজন মারা যান। পুলিশ গুলি চালায়, বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে এবং ২০০ জন আহত হয়। এই হে-মার্কেট ট্র্যাজেডি মার্কিন ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে।

১৮৮৯ সালে, আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলন ঘোষণা করে যে, হে-মার্কেট ঘটনার স্মরণে, ১ মে শ্রমিকদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক ছুটির দিন হবে, যা এখন আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস নামে পরিচিত।

আরও পড়ুন-রাষ্ট্র ভুলে যায়, ক্ষমতার গদি উল্টে দিতে জানে উচ্ছেদ হওয়া হকাররা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ঠান্ডা যুদ্ধের প্রাথমিক সময়ে কমিউনিস্ট-বিরোধী উত্তেজনার সময় এই ছুটির দিনটি বিশেষভাবে অবজ্ঞার শিকার হয়। ১৯৫৮ সালের জুলাই মাসে, রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার মে দিবসে 'বিশ্বের শ্রমিকদের' সঙ্গে সংহতির কোনও ইঙ্গিত এড়াতে ১ মে 'আনুগত্য দিবস' নামে একটি প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেন। প্রস্তাবে ঘোষণা করা হয় যে এটি 'আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য পুনর্ব্যক্ত করার এবং আমেরিকান স্বাধীনতার ঐতিহ্যের স্বীকৃতির জন্য একটি বিশেষ দিন' হবে।

শিকাগোর হে-মার্কেট স্কোয়ার, যাকে এখন কাকতালীয়ভাবে শহরটির মানচিত্রেই আর দেখা যাচ্ছে না, তবুও এর স্থানিক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক তাৎপর্য নিয়ে আজও বিতর্ক জন্ম নিচ্ছে। এই বিতর্ক একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে পুঁজিবাদী প্রচারযন্ত্রের ভাষাসন্ত্রাসের মাধ্যমে হে-মার্কেট অঞ্চলে 'দাঙ্গা', নৈরাজ্যবাদের মাধ্যমে ঘটানো সামাজিক পরিবর্তনের সংগ্রামের 'শহিদদের' স্মরণ করার বদলে তাকে আরও বিস্মরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

২০১১ সালে এই বিরোধের এক অভূতপূর্ব প্রকাশ ঘটে। ১৮৮৬ সালের ৪ মে বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষের ১২৫ তম বার্ষিকীতে সেই ঐতিহাসিক ঘটনাবলী 'হে-মার্কেট' চত্বরে পুনরাভিনীত হয়। এই অনুষ্ঠানে একজন অজ্ঞাত নৈরাজ্যবাদীর বোমা হামলা, পুলিশি দাঙ্গা, প্রহসনমূলক বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের ঘটনাটিকে পুনরাভিনয় করে দেখানো হয় বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনগুলির মাধ্যমে। এই পুনরাভিনয়ের দৃশ্যাবলী, শিকাগোর বাইরেও প্রতিধ্বনিত হয়। কারণ এটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্তকেই কেবল স্মরণ করে না, বরং হেনরি লেফেব্রে কথিত, নিপীড়িত জনতার 'শহরের অধিকারে'-র চলমান সংগ্রামকে পুনরুজ্জীবিত করে। উত্তরাধুনিক শহরের উৎপাদন এবং সংবহন নিয়ে দ্বন্দ্ব সমস্ত বিশ্বায়িত শহরগুলির মতো, বারবার এমন জায়গায় পারফর্ম্যান্স-নির্ভর রাজনৈতিক সমাবেশের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে যেখানে, রাষ্ট্র সর্বদা তার জনসাধারণকে আইনি স্বীকৃতি দেয় না।

আরও পড়ুন-উচ্ছেদ হওয়া রেল হকারদের ভরসা দেবেন না ট্রেনে চা ফেরি করা মোদিজি?

কলকাতা শহরে এমন একটি শ্রমনিবিড় স্থান হলো গড়িয়াহাট চত্বর। এখানেও তথাকথিত 'বাম' শাসনকালে অপারেশন সানশাইন, নামক কুৎসিত নগরায়ন প্রকল্পকে সামনে রেখে, ভদ্রবিত্তদের প্রিয়তম বিশেষ সংবাদসংস্থাকে দিয়ে গণসম্মতি উৎপাদন করে, পুলিশি নিপীড়নের মাধ্যমে হকার উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। পরবর্তীতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে তারা ফুটপাতে হকারি করবার আইনি অধিকার, দ্য স্ট্রিট ভেন্ডারস (প্রটেকশন অফ লাইভলিহুড অ্যান্ড রেগুলেশন অফ স্ট্রিট ভেন্ডিং) অ্যাক্ট, ২০১৪ অর্জন করেছেন। কিন্তু, বাঙালি ভদ্রবিত্তের ইতিহাসলিখন ভদ্রবিত্তকেন্দ্রিক হওয়ায় গড়িয়াহাটের পথহকারের সংগ্রাম, 'হে-মার্কেট' চত্বরের শ্রমিক জমায়েতের তুলনায় কম আলোচ্য সংগ্রাম হিসেবেই থেকে গিয়েছে।

তাই, মে-দিবসের প্রাক্কালে গড়িয়াহাট ফুটপাতের কিছু হকারদের সঙ্গে ইনস্ক্রিপ্টের তরফে কিছু প্রশ্ন নিয়ে আলাপচারিতা করতে পৌঁছই। অনুসন্ধানের মূল লক্ষ্য ছিল, শ্রমনিবিড় পেশা হিসেবে ফুটপাতে হকারির কয়েকটি বস্তুগত সত্যকে জানা, আমাদের সমসময়ের নিরিখে জানা।

টেবিলক্লথ, বেডকভার বিক্রেতা এবং গড়িয়াহাট ইন্দিরা হকার্স ইউনিয়নের ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট সুমন সাহা জানান, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কাজ করা তাদের অনেকেরই 'স্বাস্থ্য' সুরক্ষিত নয়। নেই ব্যক্তিগত মেডিক্লেম, জীবনবিমা। বিগত দু-তিনবছরে ক্রমাগত বাড়তে থাকা তীব্র দাবদাহের মরসুমে, দোকানদারি তেমন চলছে না। যা বিক্রিবাটা হয়, সন্ধের পর। প্রতিনিয়ত ঘামতে থাকা নাজেহাল অবস্থায় হকারি করতে হয় তাঁদের। দোকান খুলতে গিয়ে মাথা ঘুরে গিয়ে মাটিতে বসে থাকছেন তাঁরা। প্রশাসনের প্রতি খানিক অনুযোগের সুরেই তিনি বলেন, "স্থানীয় থানা কি পারে না দুটো ওআরএসের প্যাকেট হকারদের দোকানে দোকানে পৌঁছে দিতে?" তিনি আরও বলেন, বর্তমানে রাজ্যের শাসকদলকে তিনি সমর্থন করেন কিন্তু এই ভয়াবহ গরমে হকারদের বেচাকেনার হালহকিকত জানতে শুধুমাত্র তৃণমূল কংগ্রেস নয়, কোনও রাজনৈতিক দলই তাঁদের কাছে আসছে না।

মহিলাদের রেডিমেড গার্মেন্টসের বিক্রেতা মনোরঞ্জন মণ্ডল জানিয়েছেন, সুভাষগ্রাম, গড়িয়া, সোনারপুর থেকে দূরপাল্লার ট্রেনে নিত্যযাত্রী হয়ে আসা হকাররা সানস্ট্রোকের ভয় পাচ্ছেন। তিনি চান, প্রশাসন হকারদের দোকানের ছাউনি বাড়ানোর সুযোগ দিক এবং সেই ছাউনিতে প্লাইউডের আস্তরণ তৈরি করে দিক। এতে গ্রীষ্ম, বর্ষা দুই ঋতুতেই তাঁরা শান্তিতে হকারি করতে পারবেন বলে তাঁর মত। নোটবন্দি, কোভিড মহামারী এবং ডিজিটাল অ্যাপনির্ভর কেনাবেচার ত্রিমুখী প্রভাব কীভাবে হকারদের আর্থব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, "ক্রেতারা ওদিকে (ডিজিটাল কেনাবেচা অথবা শপিং মলের) দিকে ঝুঁকলেও, হাতে দেখে জিনিস কেনার তাগিদেই আজও গড়িয়াহাটে আসছেন।" তাঁর মতে, এক পণ্য অর্ডার করে অন্য পণ্য বাড়িতে চলে আসায় ক্রেতারা ডিজিটাল কেনাবেচায় বিশেষ ভরসা রাখতে পারছেন না। এছাড়াও দীর্ঘদিনের ক্রেতা-বিক্রেতার আত্মিক সম্পর্কও একটি জরুরি বিষয়। তাঁর ভাষায়, 'কাস্টমাররা (ন্যাড়া) অ্যামাজন-ফ্লিপকার্টের বেলতলায় বারবার যাচ্ছে না।"

কাপড়ের ব্যাগবিক্রেতা প্রবীণ হকার দিলীপকৃষ্ণ দাস এই প্রবল গরমে প্রতিমুহূর্তে মুখে জলের ঝাপটা দিয়েই দোকান চালাচ্ছেন, দিন গুজরান করছেন। যে জিনিস কিনে এনে তিনি বেচেন, পরবর্তীতে কিস্তিতে কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করতে হয় তাঁকে। ক্রমশ ক্ষয়ে যায় জমানো পুঁজি। তিনি জানিয়েছেন, অসংগঠিত শ্রমিক হিসেবে তাঁর দাবি নামমাত্র ভাতা নয়। তিনি চান তাঁর ব্যবসায়িক উদ্যোগের জন্য কম সুদে ক্ষুদ্রঋণের বাস্তুতন্ত্র। যার 'গ্যারান্টার' থাকবে সরকার। গরম থেকে হকারদের বাঁচাতে, তাঁর নিদান টিন বা লোহার বর্তমান কাঠামো ছেড়ে, পুরনো কাঠ বা বাঁশের দোকানের কাঠামোতে ফেরত যাওয়া। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে দোকানকে ঘাস বা শণের খসখস দিয়ে মোড়ার কথা বলছেন বহু ঝাড়ঝাপটা, দাবদাহে ফুটপাত আগলানো দিলীপকৃষ্ণ।

আরও পড়ুন-অন্তরঙ্গতাই উপার্জন, অন্তরঙ্গতাই ভয়: শহরের মহিলা সেবাশ্রমিকদের রোজনামচা

হেনরি লেফ্রেবের যে 'রাইট টু সিটি' বা 'শহরের অধিকার' অবধারণাটি নিয়ে যে আলোচনা শুরু করেছিলাম, তা হলো একটি শহর যে মানবসম্পদের প্রতিনিধিত্ব করে, তা তার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পদের অধিকারের চেয়ে অনেক বেশি; এটি নগরায়নের প্রক্রিয়াগুলিকে আরও গণতান্ত্রিক রূপ দেওয়ার একটি সম্মিলিত অধিকারও। হকারদের মতো যারা নাগরিক সম্প্রদায়ের কাছে 'তুচ্ছ' জীব, তারা প্রায়শই নগর নীতি নির্ধারণ এবং পরিকল্পনার মতো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলিতে সীমিত প্রবেশাধিকার পান। এর ফলে নগর পরিকল্পনায় তাদের সীমিত প্রতিনিধিত্ব থাকে। অথচ, ফুটপাত তাদের। এ শহরের বুকে আদপে তারা সংখ্যালঘু অথবা, প্রান্তিক কোনওটাই নন।

তদুপরি, 'গ্লোবাল সাউথ' নাম বৈশ্বিক অঞ্চলটিতে, নাগরিক জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশ অসংগঠিত অর্থনীতিতে নিযুক্ত, শহুরে কর্মসংস্থানের ৫০ থেকে ৮০ শতাংশই তাই। আফ্রিকার শহুরে এলাকায় ৭৫ শতাংশেরও বেশি, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৫১ শতাংশেরও বেশি শহুরে কর্মসংস্থানের এবং ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে শহুরে কর্মসংস্থানের ৫০ শতাংশে অসংগঠিত কর্মসংস্থান রয়েছে। অন্ততপক্ষে, ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) ২০১৮ সালের রিপোর্ট তাই বলছে। সুতরাং, বৈশ্বিক দক্ষিণে (গ্লোবাল সাউথে) অসংগঠিত শ্রমিকের অর্থনীতি এবং নাগরিক দারিদ্র্য অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এই যোগসূত্রটিকে ব্যবহার করে শহর ও আধা-শহর অঞ্চলে বৃহৎপুঁজির বিনিয়োগ স্তরের বাইরে থাকা সম্প্রদায়ের (যেমন, বাংলার হকার-কারিগর-চাষিবর্গের মানুষেরা) আর্থব্যবস্থা সম্পর্কে জনমানসে আরও সুনির্দিষ্ট ধারণা প্রদান করতে হবে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের অর্থনীতিতে কর্মরত শ্রমসম্প্রদায়ের মধ্যে যাদের কার্যকলাপ জনসাধারণের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে বেশি দৃশ্যমান এবং প্রয়োজনীয়, তারা হলেন ফুটপাতের বিক্রেতা হকার এবং বর্জ্য সংগ্রহকারী শ্রমিকেরা। এছাড়াও শহরাঞ্চলে অসংগঠিত শ্রমিকদের একটি বড় অংশ, নারী গৃহশ্রমিকেরা, যারা দৃষ্টির বাইরে থাকেন এবং প্রায়শই 'শ্রমিক' হিসেবে স্বীকৃতও হন না।

জলবায়ু সংকটের বিপ্রতীপে প্রয়োজনীয় 'ক্লাইমেট জাস্টিসের' জন্য রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা, বিশেষ করে এদেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমশক্তির প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত দৃশ্যমান। অপর্যাপ্ত রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে জলবায়ু সংকটের বিষয়টি। প্রায়শই বিষয়টি সম্পর্কে অগ্রাধিকারের অভাব দেখা যায় এবং আর্থিক সম্পদ ও কর্মীদের পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাব দেখা যায়। একমাত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতির প্রয়োগ এবং সামাজিকভাবে মধ্যবিত্ত নয়, অভদ্রবিত্ত পেশাজীবী সামাজিক নেতৃত্বের উঠে আসাই এই নিষ্ক্রিয়তা কাটাতে পারে। যার মাধ্যমে নতুন 'নীতিগত পদক্ষেপ' তৈরি হতে পারে। একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, হকার-চাষি-কারিগর ব্যবস্থা একটি স্বতন্ত্র উৎপাদন ব্যবস্থা। এমনকী এদের নিজস্ব বাস্তুতন্ত্র, নিজস্ব সংবহন মাধ্যম। এখানে কর্পোরেট বহুজাতিক অনুপ্রবেশ যতদিন কম থাকবে, ততদিন বিদ্যুতের ব্যবহার কম থাকবে। যতদিন বিদ্যুৎ খুব সাধারণ মাত্রায় ব্যবহৃত হবে, বা প্রায় হবেই না, যা এই উৎপাদন ব্যবস্থায়, এই সংবহনতন্ত্রে অত্যন্ত সহজ একটি ব্যপার, ততদিন এই উৎপাদন ব্যবস্থাই একমাত্র উৎপাদন ব্যবস্থা হিসেবে এই দুনিয়ায় টিকে থাকবে, যেখানে উৎপাদনশীলতা আর কার্বনের উদগীরণ সমানুপাতিক নয়। এই উৎপাদন ব্যবস্থাই একমাত্র পরিবেশবান্ধব 'জিরো-কার্বন-ফুটপ্রিন্ট'-এর উৎপাদন ব্যবস্থা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রাখে। সুতরাং, এই মে দিবসের শপথ হোক, হকার-চাষি-কারিগর আর্থব্যবস্থার রাষ্ট্রনিরপেক্ষ সংরক্ষণ, যাতে তাদের অজান্তেই জলবায়ু উদ্বাস্তুতে (ক্লাইমেট রিফিউজি) পরিণত হতে না হয়। দেদার উন্নয়নমুখী অর্থনীতির বিনাশকারী উচ্ছেদের ঢক্কানিনাদ পেরিয়ে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষার্থে সবুজ অর্থনীতির বিকাশ প্রার্থনা করি।

 

[এই প্রতিবেদনটি লিখতে পারার জন্য অসংখ্য কৃতজ্ঞতা জানাই ন্যাশনাল হকার ফেডারেশনের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব শক্তিমান ঘোষকে এবং জ্ঞানগঞ্জ গবেষণা দলের সর্বক্ষণের সঙ্গী, বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্রশিল্পী সঙ্ঘের সংগঠক বিশ্বেন্দু নন্দকে]

মতামত লেখকের ব্যক্তিগত, এর দায় ইনস্ক্রিপ্টের নয়।

More Articles